Wednesday, January 10, 2018

জমি অধিগ্রহণ বিল ও ধর্মান্তকরণ বিল, ২০১৭ প্রত্যাহারের দাবীতে ৮ জানুয়ারি ২০১৮, JDP ও ASA-র ভারত বনধ।










ঝাড়খণ্ড জমি অধিগ্রহণ বিল, ২০১৭ ও ঝাড়খণ্ড ধর্মান্তকরণ বিল, ২০১৭ প্রত্যাহারের দাবীতে ৮ জানুয়ারি, ২০১৮, ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযানের ডাকে ভারত বনধে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ব্যাপক সাড়া, বিপর্যস্ত রেল যোগাযোগ।
৯ ই জানুয়ারি, ২০১৮।

গত ৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযান সহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের অবরোধের জেরে বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রেল পরিষেবা। সোমবার সকাল ৬টা থেকে টানা অবরোধের জেরে বিভিন্ন স্টেশনে আটকে পড়ে একাধিক ট্রেন। নাকাল হন নিত্যযাত্রীরা। পরে অবরোধ উঠলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় পরিষেবা। অবরোধে পুরনো মালদহ ও গাজল স্টেশনে অবরোধের জেরে আটকে পড়ে উত্তরবঙ্গগামী একাধিক ট্রেন। সকাল ৬টা থেকে পুরনো মালদহ স্টেশনে আটকে যায় পদাতিক এক্সপ্রেস। প্রায় ঘণ্টা চারেক আটকে ছিল। মালদহ স্টেশনে ব্রহ্মপুত্র মেল-সহ ৪টি ট্রেন আটকে পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশনের বিভিন্ন স্টেশনেও অবরোধ দেখানো হয়। বিহারের কিষানগঞ্জ স্টেশনে আটকে পড়ে এনজেপি-কলকাতা শতাব্দী এক্সপ্রেস। অবরোধের ফলে দীর্ঘক্ষণ আটকে যায় গুয়াহাটি-হাওড়া সড়াইঘাট এক্সপ্রেস, এনজেপি-কাটিহার ডিএমইউ, এনজেপি-মালদহ ডিএমইউ। আটকে পড়ে আপ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস, দার্জিলিং মেলও। প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আটকে থাকে কোনও কোনও ট্রেন। কোনও ট্রেন আবার তার থেকেও বেশি সময় আটকে থাকে বলে রেলের তরফে জানানো হয়েছে।
জমি সংস্কার আইন, চাকরি-সহ একাধিক দাবিতে ঝাড়খণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারত বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি-সহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। রেল অবরোধেরও ডাক দিয়েছিল ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি। অভিযোগ, আগে থেকে জানা থাকলেও রেলের তরফে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। কথা বলা বলা হয়নি রাজ্য সরকারের সঙ্গেও। অভিযোগ, রেলের এই উদাসীন মনোভাবের জন্যই এ দিন পরিস্থিতি চরম আকার নেয়।
ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযানের রেল অবরোধের জেরে সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন থাকল উত্তর পূর্ব ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ। ঘন কুয়াশা এবং কনকনে ঠান্ডায় বিভিন্ন স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকল অন্তত দশ জোড়া এক্সপ্রেস সহ অসংখ্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন। অন্য দিকে মালদহের একাধিক জাতীয় ও রাজ্য সড়কও অবরোধ করে রাখায়  জেলার একাংশ তো বটেই, এমনকী উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এ দিন সকাল আটটা থেকে থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত ৩৪, ৮১ ও ৫১২ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে কোনও যানবাহনই চলাচল করেনি। পাশাপাশি মালদহ-নালাগোলা রাজ্য সড়কে অবরোধ থাকায় সেই রুটেও কোনও যানবাহন চলাচল করেনি। ফলে সমস্ত রুটের যাত্রীরাই এ দিন বিপাকে পড়েন। বিকেল তিনটের পর অবরোধ উঠলেও এ দিন বেশিরভাগ রুটে বেসরকারি বাস পরিষেবা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ অব্যাহত ছিল। ছোট পিকআপভ্যান, ম্যাজিক গাড়ি করে মানুষকে যাতায়াত করতে হয়েছে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যাত্রী সহায়তা কেন্দ্র এ দিন দুপুর একটা পর্যন্ত ফাঁকা পড়েছিল। শেষে যাত্রীদের কয়েকজন ক্ষোভ জানালে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার তাপস দেবের হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটে। তিনি বলেন, ‘‘সাধ্য মতো যাত্রীদের পরিষেবা দেওয়া হয়েছে।’’
মালদহের বেসরকারি বাস সংগঠনগুলি জানিয়েছে, ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযানের ডাকা বন্‌ধের জেরে ঝামেলা এড়াতে এ দিন তাঁদের বেশির ভাগ বাস চলেনি। মালদহ-কালিয়াচক ও মানিকচক হয়ে চাঁচল রুটে কিছু বাস চলেছে। ঝাড়খণ্ড দিসম পার্টির রাজ্য সম্পাদক মোহন হাঁসদা বলেন, ‘‘আমরা বিকেল তিনটের পর গাজোল ও হবিবপুর থেকে পথ অবরোধ তুলে নিয়েছি।’’
সোমবার, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির (জেডিপি) ডাকা ভারত বন্‌ধে তিন স্টেশনে রেল অবরোধের জেরে পুরো আদ্রা ডিভিশনে ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত হয়েছে। রেল সূত্রের খবর, সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা ওই অবরোধের জেরে বাতিল হয়েছে একটি এক্সপ্রেস-সহ ১৪টি ট্রেন। যাত্রাপথ সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে ৮টি ট্রেনের। যাত্রাপথ বদল করতে হয়েছে ভুবনেশ্বর-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস-সহ ৪টি ট্রেনের।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘণ্টা সাতেক ডিভিশনের বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়েছিল ১৫টি ট্রেনকে। আদ্রা ডিভিশনের রেলের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘মধুকুণ্ডা, ইন্দ্রবিল ও কাঁটাডি স্টেশনে রেল অবরোধের জেরে ট্রেন চলাচল প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়েছে। রাজধানী এক্সপ্রেসটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমরা অবরোধকারীদের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু ওঁরা রাজি হননি।’’ বাঁকুড়ার ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজধানী এক্সপ্রেস খড়গপুর-টাটা রুটে ঘুরিয় দেওয়া হয় শেষে। আদ্রা থেকে যাঁদের রাজধানীতে ওঠার কথা ছিল, বিশেষ ট্রেনে তাঁদের বোকারো পোঁছে দেওয়া হয়।
ঝাড়খণ্ডে বিজেপি-র রাজ্য সরকার গত বছর ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭ ও ধর্মান্তকরণ আইন, ২০১৭ এনেছে। আইন দুটি প্রত্যাহারের দাবিতে গত সোমবার ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ ভারত বন্‌ধের ডাক দিয়েছিল ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি (JDP) ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযান।
এ দিন ভোর ৬টা থেকে আদ্রা-আসানসোল শাখার মধুকুণ্ডা, আদ্রা-মেদিনীপুর শাখার ইন্দ্রবিল, আদ্রা-চান্ডিল শাখার কাঁটাডি স্টেশনে অবরোধ শুরু করেন ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি (JDP) ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযানের কর্মী সমর্থকেরা। তির-ধনুক, ধামসা, মাদল নিয়ে রেল লাইনের উপরে বসে পড়েন তাঁরা। তাঁরা ভোর ৬টা থেকে থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত, ৮ ঘণ্টা আদ্রা ডিভিশনে ট্রেন চলাচল স্তব্ধ করে দেন।
সোমবার দিনভর এ রকম নানা ভোগান্তির ছবি দেখা গিয়েছে বিভিন্ন স্টেশনে। সকাল থেকেই ডিভিশনের তিন স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিলেন রেলের আধিকারিক ও আরপিএফ-এর কর্মীরা। তাঁরা কেন অবরোধ তুলতে পারলেন না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন যাত্রীদের একাংশ। রেলের কর্তাদের দাবি, অনেকবার অবরোধ তোলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে রেল অবরোধ করে ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকারের উপরে কী ভাবে চাপ তৈরি সম্ভব, অবরোধকারীদের উদ্দেশে সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি (JDP) ও আদিবাসী সেঙ্গেল অভিযানের রাজ্য সভানেত্রী পানমণি বেশরা বলেন, ‘‘ঝাড়খন্ডের রাজ্য সরকারের আনা ভূমি অধিগ্রহন ও ধর্মান্তকরণ আইনে আদিবাসীদের চূড়ান্ত সর্বনাশ হবে। আইন প্রত্যহারের জন্য রাস্তায় নামা ছাড়া কোনও পথ খোলা ছিল না।’’ সাধারণ যাত্রীদের অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের জমি-বাড়ি, অন্যান্য সম্পত্তি সুরক্ষার আইন ছোটনাগপুর টেনেন্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগনা টেনেন্সি অ্যাক্টসংশোধনের প্রস্তাব রাজ্যপালের কাছে পেশ করেছে ঝাড়খণ্ড সরকার। তাতেই আপত্তি আদিবাসী নেতাদের। তাঁদের বক্তব্য, ওই আইন সংশোধন করলে আদিবাসীদের অধিকার খর্ব হবে। তাই রেল অবরোধ।
ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের সমস্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রেল অবরোধ কেন? ‘‘ঝাড়খণ্ড বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, আদিবাসীরা এক। অধিকার খর্ব হওয়া মানে সকলেই বিপদে পড়তে পারেন। তাই অবরোধ,’’ বলেন ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি পানমণি বেসরা।
অবরোধের ডাক দেওয়া হয়েছিল অনেক দিন আগেই। রেল এবং স্থানীয় প্রশাসনও তা জানত। কিন্তু তার মোকাবিলায় রেল ব্যবস্থা না-নেওয়ায় দূরপাল্লার বিভিন্ন ট্রেনের হাজার হাজার যাত্রী বিপাকে পডলেন। যাত্রীদের অভিযোগ, আগে থেকে সব জেনেও পরিস্থিতির মোকাবিলায় রেল কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কথা বলেনি রাজ্যের সঙ্গে। তাই পরিস্থিতি চরম আকার নেয়। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের খবর, ভোর ৬টা থেকে অবরোধের ফলে রাজধানী, শতাব্দী এক্সপ্রেস-সহ বহু ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকে পড়ে। ওল্ড মালদহ স্টেশনে আটকে ছিল পদাতিক এক্সপ্রেস। মালদহ স্টেশনে ব্রহ্মপুত্র মেল-সহ চারটি ট্রেন থমকে যায়। অবরোধ ও কুয়াশার জেরে বিভূতি এক্সপ্রেস বর্ধমানে পৌঁছয় সাড়ে ছঘণ্টা দেরিতে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশনে অবরোধ হয় আদ্রা, মধুকুণ্ডা, ইন্দ্রবিল ও কাঁটাডি স্টেশনে। ভুবনেশ্বর-নয়াদিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস বাঁকুড়ার ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। পরে সেটিকে চালানো হয় ঘুরপথে। আদ্রায় প্রায় সাত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল হাওড়ামুখী পুরুলিয়া-হাওড়া এক্সপ্রেস। বর্ধমান কর্ড লাইনে লোকাল-সহ বহু ট্রেন আটকে পড়ে। আরপিএফ অবরোধ তুলে দিলে ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
ডালখোলা-সহ বিহারের বিভিন্ন স্টেশনে রেল অবরোধ শুরু হয় সকাল ৬টায়। চলে সড়ক অবরোধও। খুরিয়াল স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে নিউ জলপাইগুড়িমুখী দার্জিলিং মেল। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস আজমনগরে এবং পদাতিক এক্সপ্রেস ওল্ড মালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। কাটিহার স্টেশনে সকাল থেকে আটকে পড়ে রাজধানী এক্সপ্রেস এবং ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস। চেন্নাই এগমোর এক্সপ্রেস কিসানগঞ্জে, কামাখ্যাপুরী এক্সপ্রেস তেলতা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘ ক্ষণ। কলকাতা-গুয়াহাটি গরিবরথ এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল সুধানি স্টেশনে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আটকে পড়ে দিল্লিগামী অওধ-অসম এক্সপ্রেস এবং কলকাতামুখী কাঞ্জনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। দুপুরের পরে অবরোধ উঠে যায়। খুরিয়াল স্টেশনে দীর্ঘ ক্ষণ আটকে থাকা দার্জিলিং মেল ছাড়ে বেলা আড়াইটে নাগাদ।
পূর্ব রেলের খবর, হাওড়া ও শিয়ালদহমুখী ট্রেনগুলি দেরিতে পৌঁছনোয় রাতের বহু ট্রেনই বাতিল করতে বা সূচি বদলে চালাতে হয়েছে।

ঋণ স্বীকার – আনন্দবাজার পত্রিকা। 

No comments:

Post a Comment