Wednesday, January 31, 2018

প্রশাসন সক্রিয় না হলে টুসু মন্দির নির্মাণ নিয়ে জঙ্গলমহল উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা।



খুব সম্প্রতি টুসু উৎসব পালিত হল সারা জঙ্গলমহল জুড়ে। টুসু প্রতি বছরেই আসে শীতকাল জুড়ে আনন্দের বার্তা নিয়ে। খাতায় কলমে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা হলেও দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার জঙ্গলমহল এলাকায় অলিখিত বড় উৎসব অবশ্যই মকরসংক্রান্তির টুসু পরব।
কিন্তু এ বছর টুসু পরব আনন্দ নিয়ে আসার পাশাপাশি একটা বিতর্কও নিয়ে এসেছে জঙ্গলমহল জুড়ে। ঝাড়গ্রাম জেলার বেলিয়াবেড়া থানার নাদনগেড়িয়া গ্রামের টুসু মন্দির নির্মাণ করাকে কেন্দ্র করে জঙ্গলমহলের একাংশ ক্ষোভে ফুঁসছে। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রতিবাদ। একের পর এক পোস্ট, কমেন্ট আছড়ে পড়তে থাকে টুসু মন্দির কমিটি ও সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের প্রশ্ন, টুসুর আবার মন্দির হয় নাকি? টুসু সম্পূর্ণ ভাবেই লৌকিক দেবতা। যাকে কখনোই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে পুজো করা যায় না।
জঙ্গলমহলের টুসু উৎসবের মূল পৃষ্ঠপোষক আদিবাসী কুড়মী সমাজের বুদ্ধিজীবী মহল এটিকে প্রান্তিক এনিমিস্ট সংস্কৃতির উপর উচ্চবর্ণীয় আর্য-আগ্রাসন বলেও উল্লেখ করেছেন। এটি হাজার বছরের পুরোনো টুসু ঐতিহ্যকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। তাদের বক্তব্য, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুসু মন্দিরের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন তা কূড়মী সমাজের অন্য সাংস্কৃতিক উন্নয়নে খরচ করা হোক বা কুড়মালী ভাষা উন্নয়নের জন্য অ্যাকাডেমি গঠন করা হোক।
৬ নং জাতীয় সড়কের (মুম্বই রোড়) লোধাশুলি থেকে ভেঙে যে রাস্তাটা দক্ষিণে চলে যাচ্ছে রগড়ার দিকে, সেই রাস্তা ধরে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার এগোলেই নাদনগেড়িয়া গ্রাম। যা বেলিয়াবেড়া থানার অধীনস্থ। ওই গ্রামই সম্প্রতি টুসু মন্দির নির্মাণ করাকে কেন্দ্র করে সংবাদের শিরোনামে এসেছে। ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আর অর্জুন, মহকুমা শাসক নকুল চন্দ্র মাহাত, গোপীবল্লভ পুর ২ ব্লক এর বিডিও টুসু মন্দির সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বরাদ্দ অর্থ দিয়ে পরিকাঠামো নির্মাণ করে এই জায়গাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। টুসু মন্দির নির্মাণ প্রকল্পের সভাপতি লক্ষণ রায় জানান, টুসু মন্দির সংলগ্ন যে পাঁচ বিঘা জায়গা রয়েছে, সেখানে উদ্যান, জলাশয়, নির্মাণ করে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা হবে। আদিবাসী সংস্কৃতিচর্চার জন্য নির্মাণ করা হবে একটি অডিটোরিয়ামও।
আদিবাসী কুড়মী সমাজের রাজ্য সম্পাদক রাজেশ মাহাত বলেন, যে সমস্ত পরিকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে তা নিয়ে তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। আমাদের মূল আপত্তি টুসুর মন্দির নির্মাণ এবং মন্দিরের ভেতরে মূর্তি নির্মাণ করে সেখানে পূজোর্চনা করা নিয়ে। ওই এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র, হাসপাতাল যা খুশি করা হোক। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিকে অপমান করে এত সব কিছু আমরা মেনে নেব না। কুড়মী তথা আদিবাসী সংস্কৃতি ধ্বংস করার এটা একটা গভীর চক্রান্ত। ওই এলাকার মানুষ যে ভাবে নীরব আছেন তা খুবই নিন্দনীয়। টুসু মন্দির কথাটাই সোনার পাথর বাটির মতো। তা ছাড়া টুসুর কোনো মূর্তি হয় না, এটি সম্পূর্ণ ভবে চাষবাস কেন্দ্রিক একটি আদিবাসী লোকউৎসব মাত্র। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে টুসু ভাসানের মধ্য দিয়ে এই উৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রতি দিন সকাল-সন্ধ্যা পুজো করা টুসু সংস্কৃতির পরিপন্থী। আবেদন নিবেদনে কাজ না হলে বড়ো আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন রাজেশবাবু।
কী ভাবে এই টুসু মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু হল? টুসু মন্দির উন্নয়ন কমিটির সম্পাদক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা হরেন মাহাত বলেন, পরকল্পিত ভাবেই আমরা এই মন্দির নির্মাণ করেছি। ভারতবর্ষের কোথাও টুসু মন্দির নেই। আমরা চেয়েছিলাম নতুন কিছু করতে, যাতে আমাদের এলাকার সুনাম হয়। সেই মোতাবেকই আমরা মন্দির নির্মাণ করি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। হরেনবাবু বলেন, বছরদুয়েক হয়ে গেল মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আগে কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি। এখন মুখ্যমন্ত্রী এক কোটি টাকা বরাদ্দ করার পর কিছু লোক টাকার লোভে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
যদিও এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করে আদিবাসী কুড়মী সমাজের ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি অনুপ মাহাত বলেন, “এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। টুসু সংস্কৃতি সম্বন্ধে এদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। নিজেদের নাম কামানোর জন্য, নিজেদের ফুর্তির জন্য হাজার বছরের একটা প্রাচীন সংস্কৃতিকে কলুষিত করতেও এদের বাধে না। এটা আদিবাসী মূলবাসী সংস্কৃতির উপর পরিকল্পিত ব্রাহ্মণ্য-আর্য আগ্রাসন। আগামীতে আমরা বড়ো আন্দোলনে নামতে চলেছি।”
টুসু কী? খবর অনলাইন-এর এই প্রশ্নের উত্তরে এলাকার তরুণ গবেষক মৃন্ময় বশরিয়ার বলেন, টুসু কোনো অলৌকিক দেবী নন, যাকে মূর্তি বানিয়ে পূজা করা যায়। টুসু হল শস্যকেন্দ্রিক একটি উপজাতি পার্বণ। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে জমিতে রেখে আসা একটি ধানের আঁটিকে পূজো করে, সিঁদুর মাখিয়ে বাড়িতে আনা হয়। যা ডিনী মা নামে পরিচিত। এর পর পৌষের প্রথম দিন নতুন ধানের তুষ দিয়ে মাটির সরার মধ্যে রাখা হয়, যা টুসু স্থাপন নামে পরিচিত। এর পর প্রতি দিন একটি করে ফুল দিয়ে সন্ধ্যাবেলা টুসু গীত গাওয়া হয়। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন যা আদিবাসীদের কাছে ‘বাউড়ি’ নামে পরিচিত, ওই রাতে সারা রাত টুসুর জাগরণ করেন মহিলারা, পর দিন দুপুর পর্যন্ত নাচগান করে ডিনীকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলে। টুসুর কোনো মূর্তি হয় না। পুরুলিয়া, ঝাড়খণ্ডে টুসু মূর্তির কোনো প্রচলন নেই। ইদানীং নাচগানের সুবিধার জন্য বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের কিছু জায়গায় ছোটো ছোটো মূর্তি ব্যাবহার করা হয়। এই পার্বণে কোনো ব্রাহ্মণ ডাকা হয় না। মহিলারা গান গেয়ে গাঁদা বা আকন্দ ফুল দিয়ে আরাধনা করেন মাত্র। মন্দির নির্মাণ করে এত দিনের টুসুর সংজ্ঞাটাই বদলে দেওয়া হল।
যদিও অভিযোগ মানতে নারাজ টুসু মন্দির কমিটির সভাপতি লক্ষণ রায়। তাঁর কথায়, “না না, আমরা টুসু সংস্কৃতি ভাঙতে চাই না। আমরা সমৃদ্ধই করতে চাই এই সংস্কৃতি। আমরা চাই টুসুকে কেন্দ্র করে এই এলাকার সংস্কৃতির বিকাশ হোক। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হোক। আর্য বা ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের তত্ত্ব মানতে তিনি নারাজ। তিনি বলেন, সে রকম সম্ভাবনা নেই। টুসু মন্দিরে কোনো ব্রাহ্মণ বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে পুজো করবেন না। পুজো করছেন কুড়মী মাহাত সমাজেরই লায়া শশধর মাহাত। তিনি টুসু গান করেই পুজো করেন।
ঘটনা যা-ই হোক, প্রশাসন দু’ পক্ষকে নিয়ে সমস্যা সমাধান না করলে অদূর ভবিষ্যতে জঙ্গলমহল উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা। বড়ো আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে কুড়মীসেনা।
সৌজন্য – খবর Online, January 29, 2018, মৃণালকান্তি মাহাত

No comments:

Post a Comment