পশ্চিম বাংলা, বিহার,
উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ এর ২১ টি জেলা (পশ্চিমবাংলার তিন জেলা – মেদিনীপুর, পুরুলিয়া
ও বাঁকুড়া; বিহারের ১২ টি জেলা – সিংভুম, গিরিডি, রাঁচি, লোহারডাগা, গুমলা,
পালাউমৌ, হাজারীবাগ, ধানবাদ, দুমকা, গোড্ডা, দেওঘর ও সাহেবগঞ্জ; উড়িষ্যার ৪ জেলা –
সম্বলপুর, সুন্দরগড়, ময়ুরভঞ্জ ও কেওনঝড়; এবং মধ্যপ্রদেশ এর ২ জেলা – সরগুজা ও
রাইগড়) নিয়ে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনে পশ্চিমবাংলা সরকারের সহযোগিতা ও ঝাড়খণ্ডী
সাংস্কৃতিক অঞ্চলের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে সাঁওতালী, মুন্ডারি, কুরুখ,
নাগপুরি ও কুড়মালি ভাষায় পঠন পাঠনের দাবীতে ১৯৮৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারি
পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতা শহরের বিখ্যাত শহীদ মিনার ময়দানে ঝাড়খণ্ড সমন্বয়
সমিতি (Jharkhnd Coordination Committee)-র ডাকে ৫০,০০০ হাজার ঝাড়খণ্ডী সমবেত
হয়েছিলেন। এই ঝাড়খণ্ডী সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ রামদয়াল মুন্ডা, এন ই হোরো,
বিনোদ বিহারী মাহাতো, সন্তোষ রানা, সূর্য সিং বেসরা ও নরেন হাঁসদা সমেত তৎকালীন
সময়ের জনপ্রিয় ঝাড়খণ্ডী নেতৃবৃন্দ। ঝাড়খণ্ডীদের এই জনসমাবেশকে ভণ্ডুল করতে সবরকম
পন্থা অবলম্বন করেছিল তৎকালীন শাসক দল সিপিএম ও বামফ্রন্ট সরকার। কোলকাতায় সমাবেশ
করতে চরম অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছিল। ঝাড়খণ্ডী সমাবেশ গুলোর অন্যতম
অঙ্গসজ্জা তির ধনুকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার।
নিজেদের দাবীর পক্ষে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে তির ধনুকের ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ বের
করে এনেছিল বামফ্রন্ট সরকার। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মন্তব্য করেছিলেন যে
ঝাড়খণ্ডীরা কেন কোলকাতায় সমাবেশ করছেন? তারা তো দিল্লী যেতে পারেন। কোনদিনেই
ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন করা সম্ভব নয়। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিশেষ ক্যাবিনেট মিটিং
ডাকেন ও তির ধনুকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মুখ্যসচিব টি সি দত্তের নেতৃত্বতে
এক বিশেষ সেল গঠন করা হয়। কলকাতা শহরে ঢোকার সমস্ত রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড করা
হয়, যারা তির ধনুক বাজেয়াপ্ত করার অছিলায় ঝাড়খণ্ডী সমর্থকদের কলকাতা শহরে ঢুকতে
বাধা সৃষ্টি করেন। কিন্তু কোন কিছুই ঝাড়খণ্ডীদের দমাতে পারেনি। বিশাল ভাবে সফল হয়ে
সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সরকারের হৃদয়ে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছিল ঝাড়খণ্ডীদের এই ঐতিহাসিক
জনসমাবেশ। ঝাড়খণ্ডীদের এই সমাবেশ কে সফল করতে বিশাল সাংগঠনিক শক্তির পরিচয়
দিয়েছিলেন ৩২ বছরের তরুন যুবক ঝাড়খণ্ড পার্টির জনপ্রিয় নেতা নরেন হাঁসদা।
৩১ শে জানুয়ারি
১৯৮৯ কলকাতার রাজপথ ছেয়ে গিয়েছিল তির ধনুক হাতে ঝাড়খণ্ডী সমর্থক, সবুজ পতাকায় ও
সশস্ত্র পুলিস বাহিনীতে।
সমাবেশে সমস্ত
বক্তা বামফ্রন্ট সরকারের অসহযোগিতা মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। মঞ্চে ভাষণ দিতে
উঠে নরেন হাঁসদা তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন ‘তির ধনুকের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা
একটি জাতির বিশ্বাসের ওপর হামলার স্বরূপ। আমি শহীদ মিনার মঞ্চে উঠে এক হাতে তির,
অন্য হাতে ধনুক তুলে নিয়ে সরকারকে সতর্ক করে দিতে চায় যে মুসলিম ভাইদের টুপি,
পাঞ্জাবী ভাইদের কৃপাণ ও ঝাড়খণ্ডীদের তির ধনুক কেড়ে নেবার চেষ্টা হলে কেবল
পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতবর্ষেই আগুন জ্বলবে।’
সমাবেশে নরেন
হাঁসদার পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় ঝাড়খণ্ডী ছাত্র নেতা সূর্য
সিং বেসরা (সভাপতি, অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন তথা আজসু), রাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাত্তন উপাচার্য রামদয়াল মুন্ডা সহ বাকি ঝাড়খণ্ডী নেতৃবৃন্দ। ঝাড়খণ্ড সমন্বয়
সমিতির পক্ষ থেকে লিখিত স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয় তৎকালীন পশ্চিমবাংলার ভুমি ও
ভুমি সংস্কার দফতরের মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর হাতে। স্মারকলিপিতে সাক্ষর করেন ডাঃ
রামদয়াল মুন্ডা, এন ই হোরো, বিনোদ বিহারী মাহাত, নরেন হাঁসদা ও সন্তোষ রানা।
ঝাড়খণ্ডীদের
দাবিদাওয়া সম্বন্ধে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু চরম তির্যক মন্তব্য করেন।
জ্যোতি বসু জানান যে পশ্চিমবাংলায় আদিবাসীদের জনসংখ্যা অতি অল্প, মেদিনীপুর জেলায়
৪ %, বাঁকুড়া জেলায় ৮% আর পুরুলিয়া জেলায় ১৭% মাত্র, তাই পশ্চিমবাংলার প্রস্তাবিত
জেলাগুলি নিয়ে পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের কোন সম্ভবনায় নেই। আর ঝাড়খণ্ডীদের
মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের বিষয়ে জানান যে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে একজন বাঙালি ছাত্রেরও
বাংলা ভাষা নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়ার সুযোগ নেই তাই এই দাবীর কোন
সারবত্ততা নেই। জ্যোতি বসু অলচিকিকে ভাষা হিসেবেও উল্লেখ করেন। জ্যোতি বসুর এই
মন্তব্যগুলির চরম বিরোধিতা করে প্রতিবাদ জানান বিশিষ্ট নকশাল নেতা সন্তোষ রানা।
ঝাড়খণ্ডীদের জনসংখ্যা প্রসঙ্গে সন্তোষ রানা জানান যে শুধুমাত্র আদিবাসীরাই
ঝাড়খণ্ডী জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত নয়। আদিবাসীদের পাশাপাশি কুড়মি মাহাতো, বাগাল,
রাওতিয়া, প্রভৃতি অর্ধ আদিবাসী জনগোষ্ঠী, আবার হিন্দু ধর্মের শূদ্র জনগোষ্ঠী তথা
কামার, কুমোর, তাঁতি, বাগদি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীরাও ঝাড়খণ্ডী জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত।
এদের ধরে মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় ঝাড় খণ্ডীদের জনসংখ্যা ৯০-১০০%। অলচিকি
বিষয়ে জ্যোতি বসুর মন্তব্যের বিরোধিতা করে সন্তোষ রানা জানান যে এই ব্যাপারে
মন্তব্য করে জ্যোতি বসু নিজের অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। অলচিকি কোন ভাষা নয়, এটি
একটি লিপি। পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু এর আবিস্কারক। এই অলচিকি লিপির বৈশিষ্ট্য হল যে এই
লিপি দিয়ে সাবলীল ভাবে সাঁওতালী, মুন্ডারি, কুড়মালি সহ বিভিন্ন ভাষা লেখা ও পড়া
যায়, যা বাংলা লিপি দিয়ে কখনই সম্ভব নয়। এও জানিয়ে দেন যে পশ্চিমবাংলায় কোন স্কুলে
সাঁওতালী, মুন্ডারি বা কুড়মালি ভাষার মাধ্যম বা বিষয় হিসেবে পড়ানো হয় না। সিপিএমের
একসময়ের ‘মাতৃভাষাই মাতৃ দুগ্ধ’ জনপ্রিয় শ্লোগান টি জ্যোতি বসুকে মনে করিয়ে তাদের
দিচারিতাকে স্পষ্ট করেন। জ্যোতি বসু কে মনে করিয়ে দেন যে খোদ লেনিন রুশ ভাষা কে
সোভিয়েত ইউনিয়ন এর জাতীয় ভাষা করতে চাননি কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন এর অন্তর্গত বিভিন্ন
অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীগুলির ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থাকায়।
(আদিবাসি-মুলবাসীদের
অধিকার রক্ষার অন্যতম জনপ্রিয় আন্দোলন হল ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। এক সময় এই ঝাড়খণ্ড
আন্দোলন আদিবাসী-মূলবাসী সমাজে এক অদ্ভুত উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এই
আন্দোলন নিয়ে খুব বেশী লেখা, বই বা গবেষণা বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় না। বিভিন্ন
সুত্র থেকে সংগ্রহ করে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তথ্য উৎসুক পাঠকদের
সামনে তুলে ধরার এক সামান্য প্রচেষ্টা।)
No comments:
Post a Comment