রানিবাঁধ, ৩১ অগস্ট, ২০১৭।
কাজের টোপ দিয়ে ভিন্ রাজ্যে নিয়ে গিয়ে এক কিশোরীকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠল পড়শি এক মহিলা ও এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। যদিও উত্তরপ্রদেশের যৌন পল্লি থেকে সেই কিশোরীকে উদ্ধার করে আনা যায়নি। নাবালিকার পরিবারের অভিযোগ, রানিবাঁধ থানার পুলিশ এই ঘটনার অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে। থানায় অভিযোগ না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের দ্বারস্থ হন নাবালিকার পরিজনেরা। চাইল্ড লাইনের হস্তক্ষেপে শেষে মঙ্গলবার অভিযোগ গ্রহণ করে রানিবাঁধ থানা। যদিও থানার বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ মানতে চাননি জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা। তবে ঘটনাটি জানতে পেরেই জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু পুলিশ সুপারকে দ্রুত কিশোরীকে ফিরিয়ে আনতে বলেছেন।
দশম শ্রেণির ওই ছাত্রী রানিবাঁধ থানা এলাকার বাসিন্দা। তার পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগেই ওই নাবালিকার বাবা মারা যান। তার মা দিন মজুরি করে সংসার চালান। পড়াশোনার জন্য ওই নাবালিকাকে বর্ধমানে মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তার মা। মাসখানেক আগে সে রানিবাঁধে মায়ের কাছে ফেরে। কিন্তু গত ২৩ জুলাই রানিবাঁধ থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় ওই নাবালিকা।
এর প্রায় এক মাসের মাথায় গত ২২ অগস্ট ওই নাবালিকার ভাই, মাসতুতো দিদি ও মেসোমশাইয়ের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ওই নাবালিকা ফোন করে জানায়, রানিবাঁধে তাঁদের পড়শি গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চনা টুডু ও অপূর্ব টুডু তাকে কাজ দেওয়ার নাম করে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গিয়ে একটি যৌনপল্লিতে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। বর্তমানে সে ওই যৌনপল্লিতে চরম নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দ্রুত পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধারের আর্তি জানায় ওই কিশোরী।
ওই নাবালিকার মাসতুতো দিদি বলেন, ‘‘ওরা মনে হয় কাজের টোপ দিয়ে মগজ ধোলাই করে বোনকে নিয়ে গিয়েছিল। না হলে বোন যাওয়ার আগে বাড়িতে নিশ্চয় আলোচনা করত। ওর ফোন পাওয়ার পর থেকেই খুব উদ্বেগে রয়েছি।“ তাঁর কথায়, ‘‘ফোনে বোন জানিয়েছে, প্রতিদিনই নানা লোকজনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সে। এমনকী তাকে খুনেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পরে আমরা ঘটনাটি জানতে পেরে রানিবাঁধ থানায় তিন-চার বার গিয়ে পুলিশের কাছে সাহায্য চাই। লিখিত অভিযোগও দিতে যাই। কিন্তু কখনও পুলিশ বলেছে অভিযোগপত্র ঠিক লেখা হয়নি, কখনও বা বলেছে, মেয়েটি বর্ধমানে থাকত, তাই সেখানেই অভিযোগ দিতে হবে।” এর পরে মঙ্গলবার বাঁকুড়ায় গিয়ে ওই তরুণী চাইল্ড লাইনের কাছে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানান। মঙ্গলবার বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল রানিবাঁধে গিয়ে ওই নাবালিকার পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত রানিবাঁধ থানার পুলিশ ওই নাবালিকার মাসতুতো দিদির অভিযোগ গ্রহণ করে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত অপূর্বকে বুধবার গ্রেফতার করে পুলিশ।
প্রশ্ন উঠছে, কেন ওই কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার পরেই থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেননি তার পরিবার ? অভিযোগকারিণীর দাবি, ‘‘মাসি (নিখোঁজ কিশোরীর মা) শারীরিক ভাবে অসুস্থ ও নিরক্ষর। তাই থানা-পুলিশ করার সাহস পাননি। ঘটনাটি জানাতে পেরেই থানায় যাই।” যদিও রানিবাঁধ থানা অভিযোগপত্র নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসির অভিযোগ মানতে চায়নি। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারও দাবি করেছেন, ‘‘ওই কিশোরীর পরিবার থানাতেই যাননি।” কিশোরীকে উদ্ধার করে আনার ব্যাপারে কী হচ্ছে ? তাঁর জবাব, ‘‘অভিযুক্তদের এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।”
বাঁকুড়ার জেলাশাসক বলেন, ‘‘চাইল্ড লাইনের কাছে জমা দেওয়া ওই কিশোরীর পরিবারের অভিযোগপত্র পুলিশ সুপারকে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাঁকে বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব ওই কিশোরীকে উদ্ধার করে আনতে হবে। দোষীরা যেন ছাড়া না পায়।” কিশোরীর পরিবারেরও আর্জি, ‘‘পুলিশ প্রথমে অভিযোগ না নেওয়ায় এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অবিলম্বে পুলিশের উচিত সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা।”
উত্তরপ্রদেশের যৌনপল্লি থেকে এক কিশোরী লুকিয়ে বাড়িতে ফোন করে বলছে — “মা আমাকে বাঁচাও”, আর বাঁকুড়া থেকে পুলিশ “তদন্ত চলছে” বলে দায় সারছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ তুললেন রানিবাঁধের নিখোঁজ কিশোরীর পরিজনেরা। উত্তরপ্রদেশের যৌনপল্লিতে বন্দি থাকা দশম শ্রেণির ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করতে কেন সেখানে পুলিশ রওনা দিচ্ছে না ? সেই প্রশ্ন তুলছেন ওই নাবালিকার মা ও মাসতুতো দিদি। দিদির কথায়, ‘‘বৃহস্পতিবারও একটি নম্বর থেকে ফোন করে বোন জানিয়েছে, ক্রমাগত তার উপর অসহনীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করা না গেলে হয়তো মেরেও ফেলা হতে পারে বলে জানিয়েছে সে। কিন্তু পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে সেখানে কেন যাচ্ছে না, বুঝতে পারছি না।” বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা বলেন, ‘‘ফোনের সূত্র ধরে মূল অভিযুক্ত কাঞ্চনী টুডু কোথায়, তা জানার চেষ্টা চলছে। আমরা ফোনেও কাঞ্চনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। দরকার হলে বাঁকুড়ার পুলিশ উত্তরপ্রদেশে যাবে।”
বাঁকুড়া চাইল্ড লাইন অবশ্য সচেষ্ট হয়েছে উত্তরপ্রদেশ চাইল্ড লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল বলেন, ‘‘ওই নাবালিকাকে ফিরোজাবাদের কোনও যৌনপল্লিতে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। তাই আমাদের কলকাতার অফিসে চিঠি দিয়ে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে উত্তপ্রদেশের ফিরোজাবাদ এলাকার চাইল্ড লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। ওকে নিয়ে আমরাও উদ্বেগে রয়েছি।” ওই কিশোরীর পরিজনদের দাবি, ২৩ জুলাই রানিবাঁধ থেকে নিখোঁজ হয়ে যায় সে। ২২ অগস্ট একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তার ফোন পেয়ে আত্মীয়েরা জানতে পারেন, পাশের গ্রামের কাঞ্চনী টুডু ও অপূর্ব টুডু কাজের প্রলোভন দেখিয়ে যোগসাজশ করে তাকে উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদের একটি যৌনপল্লিতে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। সেখানে দিনভর একের পর এক লোকজন আসে আর তার উপর নির্যাতন চালায়। কিশোরীর মাসতুতো দিদির অভিযোগ, সেই ফোন পেয়ে রানিবাঁধ থানায় তাঁরা কয়েকবার উদ্ধার করে আনার জন্য অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ নানা বাহানায় তা নিতে চায়নি। মঙ্গলবার চাইল্ড লাইনের দ্বারস্থ হওয়ার পরে থানা অভিযোগ নেয়। অপূর্বকে গ্রেফতার করে বুধবার। কিন্তু কিশোরীকে উদ্ধার করে আনতে পুলিশ উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রে খবর, অপূর্ব তদন্তকারীদের কাছে দাবি করেছে, কিশোরীটি কোথায় সে জানে না। উত্তরপ্রদেশের বধূ কাঞ্চনীই তাকে সেখানে নিয়ে যায়। পুলিশ কাঞ্চনীর ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ওই কিশোরীর ফোন আসা নম্বরগুলি ধরেও তদন্ত চলছে।
বুধবার চাইল্ড লাইনের কাছ থেকে গোটা ঘটনাটি শুনে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারকে দ্রুত ওই নাবালিকাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে বলেন বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করতে পুলিশ কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা নিয়ে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলব।”
এ দিন ফোনে ওই কিশোরী নিজের জীবনহানির আশঙ্কা জানানোর পরে তাকে ঘিরে পরিজনদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ওই নাবালিকার মা। এ দিন ফোনে তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়ে উপরে ওখানে দিনভর শারীরিক নির্যাতন চলছে, এটা ভেবে আমি স্থির থাকতে পারছি না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলছে — “মা আমাকে বাঁচাও”। আমরা তো পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ কিছুই করছে না।” পরিজনদের আশঙ্কা, পুলিশ গোড়া থেকেই কেন এই ঘটনায় দায়সারা মনোভাব নিয়েছে স্পষ্ট নয়। অহেতুক দেরির জন্য মেয়েটার জীবন যেন শেষ না হয়ে যায়।
যৌনপল্লি থেকে বন্দি কিশোরী— ‘বাঁচাও’ বলে ফোন করছে পরিজনদের। কিন্তু অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরে পুলিশ একবারও সেই পরিজনদের তলবই করেনি। তাই তদন্ত কত দূর এগোল, তা জানতে রানিবাঁধের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে হাঁটু সমান জল-কাদা পার হয়ে বাঁকুড়া শহরে পুলিশ সুপারের দফতরে ছুটে এলেন উত্তপ্রদেশের যৌনপল্লিতে বন্দি নাবালিকার দিদি। শুক্রবার বাঁকুড়া পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরার দফতরে যান তিনি। যদিও পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। তবে জেলার এক পুলিশ কর্তার সঙ্গে কথা বলেন ওই কিশোরীর মাসতুতো দিদি। পুলিশ সুপারের দফতর থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘‘রানিবাঁধ থানা তো প্রথম দিকে ক’দিন ধরে নানা বাহানায় অভিযোগই নিতে চায়নি। চাইল্ড লাইনের হস্তক্ষেপে মঙ্গলবার তারা অভিযোগ গ্রহণ করলেও এত দিন পর্যন্ত পুলিশ আমাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি। তাই বাধ্য হয়ে পুলিশ সুপারের অফিসে এসেছিলাম। এখানে এক পুলিশ অফিসার আমাকে জানিয়েছেন, বোনকে খুঁজতে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গড়া হচ্ছে। হদিস পেতে এখনও কিছু দিন নাকি সময় লাগবে।”
এ দিন বাঁকুড়ায় আসার পরে জানতে পারেন, পুলিশ তাঁদের গ্রামে গিয়েছে। তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না ওই যুবতী। তাঁর কথায়, ‘‘বোন রোজ নির্যাতিত হচ্ছে। এমনকী সে প্রাণনাশেরও আশঙ্কা করছে। তাকে উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদের যৌনপল্লিতে রাখা হয়েছে বলে বোন ফোনে জানানোর পরেও কেন তাকে উদ্ধার করতে পুলিশ এতদিনেও রওনা হল না, বুঝতে পারছি না। বোনকে উদ্ধার করতে দরকার হলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হব আমরা।”
এ দিন সন্ধ্যায় তিনি ছাতনার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক শুভাশিস বটব্যালের সঙ্গে দেখা করে পুরো ঘটনাটি জানান। শুভাশিসবাবু বলেন, ‘‘ওই কিশোরীকে দ্রুত উদ্ধার করার জন্য পুলিশ সুপারকে বলেছি।”
ওই নাবালিকার পরিবার জানাচ্ছেন, গত ২৩ জুলাই রানিবাঁধ থেকে নিখোঁজ হয় সে। ২২ অগস্ট বাড়িতে ফোন করে জানায়, পড়শি গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চনী টুডু ও অপূর্ব টুডু বাইরে কাজ দেওয়ার টোপ দিয়ে উত্তরপ্রদেশের একটি যৌনপল্লিতে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। সেখানে তার উপরে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। দ্রুত তাকে উদ্ধার করার আর্তি জানায় সে। এ দিকে, পুলিশে অভিযোগের পরে অপূর্বকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তার কাছ থেকে ওই কিশোরীকে উদ্ধারের ব্যাপারে বিশেষ কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি বলে পুলিশের দাবি। বৃহস্পতিবারও ফের ওই নাবালিকা বাড়িতে ফোন করে তার প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কার কথা জানায়। ওই ফোন পাওয়ার পরে নাবালিকার পরিবারের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। পুলিশ যাতে দ্রুত উত্তরপ্রদেশে গিয়ে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করে সেই দাবি তুলেছেন তার পরিবার। যদিও শুক্রবার পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ রওনা দেয়নি বাঁকুড়া পুলিশের দল। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপারের জবাব, ‘‘তদন্ত চলছে”।
বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কাছে গোটা ঘটনাটি শুনে ওই নাবালিকাকে দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পুলিশ সুপারকে বলেছিলেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ কী তদন্ত করছে, আমি তা নিয়ে খোঁজ খবর রাখছি।”
http://www.anandabazar.com/state/the-sister-wants-mamata-banerjee-s-help-to-save-her-sister-s-life-from-red-light-area-1.667956?ref=strydtl-rltd-state
please help her as early as possible
ReplyDelete