৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
অবশেষে লাগাতার যৌন নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেল রানী বাঁধের পাচার হয়ে যাওয়া
আদিবাসী কিশোরী। পরিবারের বারবার আর্জির পরে পুলিশ ও চাইল্ড লাইনের যৌথ প্রচেষ্টায়
উত্তরপ্রদেশের অন্ধকার ঘুপচি ঘর থেকে উদ্ধার হল রানিবাঁধের কিশোরী। সোমবার রাতে উত্তরপ্রদেশের
আগ্রা থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে তুন্ডলা থানার হরিশচন্দ্রপুর এলাকার বাসিন্দা বাবলু যাদবের
বাড়ি থেকে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার হয়। বাবলু যাদবের নাগাল না পাওয়া গেলেও তার ভাই শৈলেন্দ্র
যাদবকে ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন,
‘‘ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত অভিযোগে শৈলেন্দ্র যাদব নামের এক ব্যক্তিকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতকে বাঁকুড়ায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” তবে কাজের টোপ দিয়ে
দশম শ্রেণির পড়ুয়া ওই কিশোরীকে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেওয়ায় মূল অভিযুক্ত
কাঞ্চনী টুডুর হদিস অবশ্য এখনও পায়নি পুলিশ। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘কাঞ্চনীর
খোঁজ চলছে।” উদ্ধার হওয়ার পরে প্রাথমিক কাউন্সেলিং-এ ওই নাবালিকা উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদ
চাইল্ড লাইনের কাছে অভিযোগ করেছে, তার উপরে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। ফিরোজাবাদের
চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সাকির জাহির বলেন, ‘‘ওই কিশোরী জানিয়েছে, ৫০ হাজার টাকার
বিনিময়ে তাকে কিনে নিজের বাড়িতে বন্দি করে রাখে বাবলু। এরপর দিনভর দফায় দফায় বাবলু,
তার ভাই সেরেন্দ্র-সহ আরও এক ব্যক্তি যৌন নির্যাতন চালাত তার উপরে। সে আপত্তি করলে
অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়ানো হতো।” জাহির জানান, গোটা ঘটনায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছে
ওই নাবালিকা। উদ্ধার হওয়ার পরেও তার মন থেকে আতঙ্ক কাটছে না। মঙ্গলবার ফিরোজাবাদ আদালতে
তোলা হয় ধৃত ব্যক্তিকে। পুলিশ ও ফিরোজাবাদ চাইল্ড লাইন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই নাবালিকা
যে মোবাইল নম্বর থেকে লুকিয়ে বাড়িতে ফোন করত সেই মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন-এর সূত্র ধরেই
হরিশচন্দ্রপুর এলাকায় বাবলুর বাড়ি খুঁজে পায় পুলিশ। সোমবার রাতে বাঁকুড়া পুলিশের সঙ্গে
তুন্ডলা থানার পুলিশ ও চাইল্ড লাইনের কর্তারা ওই বাড়িতে অভিযান চালান। বাবলুর বাড়িতে
ঢুকে একটি কামরার ভিতর থেকে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করা হয়। শৈলেন্দ্রকে ঘটনাস্থল থেকেই
গ্রেফতার করা হয়। বাবলুকে অবশ্য পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে,
শৈলেন্দ্রর সঙ্গে ওই নাবালিকার বিয়েও হয়েছে। গত ২৩ জুলাই রানিবাঁধ থেকে নিখোঁজ হয়ে
গিয়েছিল ওই নাবালিকা। ২২ অগস্ট বাড়ির আত্মীয়দের ফোন করে সে জানায়, কাজের টোপ দিয়ে পাশের
গ্রামের মহিলা কাঞ্চনী তাকে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। ওই কাজে যুক্ত
ছিল এলাকার এক যুবক অপূর্ব টুডুও। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও তেমন কিছু তথ্য পাওয়া
যায়নি বলে দাবি করা হয়। সে দিন ফোনে ওই কিশোরী জানিয়েছিল, সেখানে তার উপরে নির্যাতন
চলছে। ওই নাবালিকার ফোন পেয়ে প্রথমে তার পরিবার রানিবাঁধ থানায় কয়েকবার অভিযোগ জানাতে
গেলে, পুলিশ অভিযোগ নেয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। পরে বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের হস্তক্ষেপে পুলিশ
অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু গোড়া থেকেই ওই কিশোরীর পরিজনেরা পুলিশকে উত্তরপ্রদেশে
গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনার জন্য পুলিশের কাছে দাবি জানাতে থাকেন। বাঁকুড়ার জেলা শাসক
মৌমিতা গোদারা বসুও পুলিশের কাছে তদন্ত সম্পর্কে লাগাতার খোঁজখবর নিতে থাকেন। কিন্তু
পুলিশ প্রথম দিকে সক্রিয়তা দেখায়নি বলে অভিযোগ। উপায় না দেখে ওই কিশোরীর মাসতুতো দিদি
রানিবাঁধের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বাঁকুড়া শহরে পুলিশ সুপারের অফিসে এসে আর্জি জানান।
প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও জানান তিনি। সে দিনই
পুলিশের এক কর্তা জানান, তদন্ত দল তৈরি করা হচ্ছে। তারপরেই উত্তরপ্রদেশে ওই কিশোরীকে
উদ্ধারে রওনা দেয় পুলিশের দল।
এ দিন ওই নাবালিকার মাসতুতো দিদি ফোনে বলেন, ‘‘বোন তো প্রাণহানির আশঙ্কাও করছিল।
তবে দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশ নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। বোনের সঙ্গে এখনও আমার
কথা হয়নি। ও ফিরে আসছে শুনে বাড়ির সবাই বড় স্বস্তি পেয়েছি।” জেলাশাসক এ দিন বলেন,
‘‘ওই নাবালিকার উদ্ধার হওয়ার খবর শুনে উদ্বেগ কাটল। তাকে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে
আনাই আমাদের লক্ষ্য।” বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল বলেন, ‘‘বাঁকুড়ায়
ফিরলেই ওই নাবালিকার কাউন্সেলিং শুরু করব আমরা। অতীত ভুলে সে যাতে নতুন করে জীবন শুরু
করতে পারে, আমরা সেই চেষ্টা করব।”
No comments:
Post a Comment