অসুরনাশিনী তত্ত্বেই আপত্তি, বিতর্ক কলকাতা শহরে।
পুজোর বাকি আর মাত্র সপ্তাহ
খানেক৷ বহু
অপেক্ষার সেই লাগামহীন আনন্দের জনস্রোতের মাঝে শোকের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন
একদল মানুষ৷ দেবীর বোধন থেকে বিসর্জন এই পুরো সময়টাই তাঁদের কাছে শোকের পর্ব৷ কারণ
তাঁরা মনে করেন, মহিষাসুরের মৃত্যু আসলে ‘খুন’৷ পরাক্রমশালী অনার্য রাজা মহিষাসুরকে
হারাতে না -পেরে ছল করে তাঁকে খুন করেছে আর্যরা৷ তাঁরা নিজেদের অসুর বলে পরিচয় দেন৷
দেবীপক্ষ তাঁদের কাছে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা বয়ে আনে৷ দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়া, উত্তরবঙ্গের
বিভিন্ন এলাকায় অনেকদিন ধরেই অসুর উৎসব বা অসুর স্মরণসভা পালন
করে আসছেন আদিবাসী মানুষ৷ কিন্তু এ বছর রাজ্যের বিভিন্ন
প্রান্তে অসুর স্মরণসভা পালন করতে রীতিমতো কমিটি গড়া হয়েছে৷ সব কিছু ঠিক থাকলে রাজ্যে
এ বছর নজিরবিহীন ভাবে অন্তত ৮৫০-৯০০ অসুর স্মরণসভা পালন করা হবে৷ কোথাও বাধার মুখে
পড়লে যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাই এই কোঅর্ডিনেশন কমিটি গড়া হয়েছে৷ ২ সেপ্টেম্বর সোনারপুরে
প্রথম বৈঠকে বসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহিষাসুর স্মরণসভা সমিতি৷ সেখানে মালদহ, মুর্শিদাবাদ,
দুই দিনাজপুর, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এমনকী কলকাতা থেকেও
প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন৷ ঠিক হয়েছে, দলিত-প্রান্তিক, আদিবাসী এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের
সামিল করে বিভিন্ন এলাকায় অসুর স্মরণসভা আয়োজন করা হবে৷ কাল, মঙ্গলবার মহালয়ার দিন
দমদমের দুর্গানগরে অসুর স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়েছে৷ কলকাতা ও তার আশেপাশের তালিকায়
রয়েছে গড়িয়া, সোনারপুর, বিড়া, গুমা, অশোকনগর, জয়নগর, মথুরাপুরের মতো এলাকায় অসুর স্মরণসভা
হবে৷ আয়োজকদের ভূমিকায় বাবা সাহেব আম্বেদকরপন্থী দলিত সমাজকর্মীরা৷ অসুর স্মরণসভার
দিন যুদ্ধবিরোধী শোভাযাত্রা, আদিবাসী নৃত্য, অসুর ও দুর্গাপুজো নিয়ে নানা গুণী ও গবেষকদের
আলোচনা সভা আয়োজন করা হচ্ছে৷
রাজ্য মহিষাসুর স্মরণসভা
সমিতির কোঅর্ডিনেটর এবং দলিত বহুজন সলিডারিটি মুভমেন্টের সক্রিয় সদস্য শরদিন্দু উদ্দীপনের
বক্তব্য, ‘দুর্গাপুজোর উৎসবের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব
নেই৷ কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনে এ দেশের প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়ের
নিজস্ব কথাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে৷ আমরা চাই সেই কথাগুলোও আসুক৷’ রাজ্য আরএসএসের সাধারণ
সম্পাদক জিষ্ণু বসুর বক্তব্য, ‘দেশকে যাঁরা টুকরো টুকরো করতে চায় এগুলো তাঁদেরই কার্যকলাপ৷’ শরদিন্দু
জানাচ্ছেন, বাংলা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এবং ওডিশার জঙ্গলমহলের আদি নিবাসীদের এবং উত্তরবঙ্গ
ও দক্ষিণভারতের বেশ কিছু সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন, মহিষাসুর একজন প্রবল পরাক্রমশালী
বীর অনার্য রাজা ছিলেন৷ বিদেশি আর্যরা ভারত দখলের সময় প্রাচীন মগধ, বঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব
ও দক্ষিণ ভারতে অসুর রাজাদের দাপটে ঢুকতে পারছিলেন না৷ তাই মহিষাসুরের মতো এক বীর রাজাকে
ছল করে এক নারী বিয়ের পর নবম রাতে হত্যা করেন৷ সেটাকেই পরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দেবী দুর্গার
বিজয় কাহিনি হিসেবে দেখিয়ে আসছে৷ যদিও এই তত্ত্বের প্রামাণ্য কোনও পাঠ্য নেই৷ পুরোটাই
আদিবাসীদের নিজস্ব লোকগাথা৷ পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর বক্তব্য, ‘মহিষাসুর বধ আসলে
শুভ এবং অশুভর মধ্যে লড়াই৷ দুর্গাপুজোয় কিন্তু মহিষাসুরও পুজো পান৷’
উল্টো কথা মনে করেন নৃতত্ত্ববিদ পশুপতি মাহাতো৷ তাঁর বক্তব্য, ‘বেদ-পুরাণে অসুরের ইতিহাস
না থাকাটাই স্বাভাবিক৷ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দলিতরা বহুদিন কোনও
কথা বলতে পারেননি৷’
সৌজন্য – এই সময়, ১৮/০৯/২০১৭, জয় সাহা।
http://www.epaper.eisamay.com/Details.aspx?id=34716&boxid=132031588
No comments:
Post a Comment