বস্তারে স্থানীয় সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সমাজতত্ত্ববিদ ও শিক্ষকদের
উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ সংবাদ শিরোনামে কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীরাও আক্রান্ত, সেটা খবর নয় কেন ?
লিখেছেন রূপসা রায়।
সৌজন্য – এই সময়,
০৫/০৫/২০১৭
গত ২ মে ‘হাফিংটন পোস্ট ’-এ একটি খবর বেরোয়৷ রায়পুর সেন্ট্রাল জেলের
ডেপুটি জেলর বর্ষা ডোঙ্গরে ফেসবুকে একটি চমকপ্রদ পোস্ট করেছেন৷ হিন্দিতে তিনি সেই
পোস্টে লিখেছেন, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক আদিবাসী
মেয়েদের উপর যে অত্যাচার চলে,
তার
প্রত্যক্ষদর্শী আমি৷ থানাগুলিতে মহিলা পার্সোনেলরা চোদ্দো থেকে ষোলো বছর বয়সী
মেয়েদের বিবস্ত্র করে অত্যাচার করেন৷ তাদের হাতে ও বুকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়৷
আমি তার দাগ দেখেছি, আমি আতঙ্কিত৷
অপ্রাপ্তবয়স্কদের কেন থার্ড ডিগ্রি ?’ সোশ্যাল
মিডিয়ায় ছত্তিসগড় পুলিশের এক আধিকারিকের এই পোস্ট, সম্ভবত
ওই ‘সরকারি আধিকারিক’ পদটির কারণেই সংবাদ শিরোনামে৷ যে ভাবে গত বছর
নভেম্বরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে নড়ে চড়ে
বসেছিল সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম৷ সেই রিপোর্টে ছিল, বস্তারে অন্তত ১৬ জন আদিবাসীকে ধর্ষণ করার
অভিযোগ পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে৷ আরও ছিল অন্তত ৩৪ জনের কথা, যাঁরা সেনার হাতে কোনও না কোনও ভাবে শারীরিক
ভাবে নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছেন পুলিশের কাছে, যার মধ্যে যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনাও রয়েছে৷ এবং
সাম্প্রতিক ওই মহিলা পুলিশ আধিকারিকের পোস্টের মতো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের
রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়েছিল জাতীয় স্তরের সংবাদপত্রগুলিতে৷ কারণ সেগুলির মধ্যে ‘খবর’-এর
মান্যতা ছিল, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক
পদের সিলমোহর ছিল৷
আদিবাসীদের বিভিন্ন অধিকার
নিয়ে সরব হওয়ায়, স্থানীয় সংবাদপত্রে, বারবার কাঠগড়ায় উঠতে হয়েছে লিঙ্গরাম
কোপাডিকে৷ তাঁর উপর পুলিশি নজরদারি খবর হয়েছে৷ পুলিশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন
স্থানীয় এবং বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকরা৷ গ্রেফতার হয়েছেন কমল শুক্লা, দীপক জয়সওয়াল, সোমারু
নাগ, সন্তোষ যাদব, প্রভাত সিং৷ বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে
আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া সাংবাদিক মালিনী সুব্রমনিয়ামের৷
বস্তারে কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন সমাজতাত্ত্বিক নন্দিনী সুন্দর, অর্চনা প্রসাদ৷ বস্তার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা৷ আর সেখান থেকেই বিতর্ক উঠেছিল --- বস্তারে
কি তবে মিডিয়া ব্ল্যাকআউট ? কিছু দিন আগেই কলকাতায়
বক্তৃতা করতে এসেছিলেন সোনি সোরি৷ তিনি বলছিলেন, যে
সব সাংবাদিক ছত্তিসগড়ের স্থানীয় সংবাদপত্রে কাজ করেন, তাঁরা সারাক্ষণ পুলিশের নজরদারিতে৷ পুলিশের
বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই হামলার শিকার তাঁরা৷ পুলিশি হামলা এড়াতে তাঁদের প্রায় সব
রিপোর্টই নাকি ছাপা হয় পুলিস কর্তাদের তোষামোদ করে, তাঁদের
মৌখিক অনুমোদনের পরই প্রতিবেদন ছাপা হয়, সে
অভিযোগও উঠছে অনেক দিন ধরেই৷ স্বাধীন সাংবাদিকতা বস্তারে তাই ‘অসম্ভব’৷
কোনও খবর আসে না বস্তার থেকে৷ কিন্তু যখন সেনার গায়ে হাত পড়ে, সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণ হয়, তখন কিন্তু খবর হয়৷ খবর হয় প্রথিতযশা শিক্ষক-সাংবাদিকদের
গ্রেফতারি৷ কিন্তু বস্তারের মানুষের কথা, প্রতি
দিন পুলিশি অত্যাচার সহ্য করতে বাধ্য হওয়া এই মানুষগুলোর কথা তখনই খবর হয়, যখন কোনও ‘বিশ্বাসযোগ্য
প্রতিষ্ঠান’ বা ‘পদ’ তাদের
এই কথাগুলি বলে দেয়৷ এই যেমন ওই মহিলা জেলারই বলেছেন, ‘আদিবাসীরা এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারবেন না৷
কারণ এটাই তাদের জায়গা৷ ফলে পরের পর মিথ্যা মামলায় জেরবার হয়েও আদিবাসীরা এই
ভূমিতেই থাকতে বাধ্য হন৷’ বর্ষা
ডোঙরে যে কথাগুলি বলছেন,
সেই
কথাগুলি বস্তারের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে বলে এসেছেন৷ কিন্তু খুব বিশেষ কোনও ক্ষেত্র
না হলে সেই সব কথা খবর হয়নি৷ সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিকরা করলেও খবর হয়নি জাতীয়
স্তরে৷
সম্ভবত এই জায়গাটিতেই
সমস্যাটা জটিল, এবং বর্তমান গণতন্ত্রের
স্ববিরোধিতা৷ বস্তারের খবর কাগজে নেই৷ কাগজে বস্তারের খবর নেই৷ সেটাই খবর, যেটা আবার গণমাধ্যমে আসে৷ আবার যে সাংবাদিক
স্পটে ঢুকে সেই খবরটা করতে পারলেন না,
কিন্তু করার চেষ্টা করলেন এবং চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন পরিস্থিতির কারণে --- আর
সেটাই খবর হল নতুন করে৷ মতপ্রকাশ থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে তর্ক উঠল, যেটা হওয়াটাই কাম্য৷ কিন্তু যে জায়গাটি থেকে
শুরু হল এই ঘটনা, সেই জায়গাটি অনালোকিত রয়ে
গেল৷ বস্তারে এক দিকে পুলিশ,
এক
দিকে মাওবাদী৷ আর এই দুইয়ের উপরে বহুজাতিক সংস্থার সর্বব্যাপী অস্তিত্ব৷ তারা অনেক
দিন আগেই আবিষ্কার করেছে, ভারতের মধ্যভাগে যে
বিস্তৃত জঙ্গল-জমি, সেই জমির তলায় খনিজ
সম্পদের আড়ত্৷ সেই জমির মালিক আদিবাসীরা৷ ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন অনুযায়ী, আদিবাসীদের জমি তাদের অমতে অধিগ্রহণ করতে
পারবে না সরকার৷ এই কিছু দিন আগে,
২০১৬-র
শীতে যখন ‘দেশদ্রোহী’-‘দেশপ্রেমিক’ বিতর্কের
দিকে নজর ঘুরে গিয়েছিল গোটা দেশের সংবাদমাধ্যম, শিক্ষিত
বুদ্ধিজীবী, অশিক্ষিত আমজনতার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল
তুঙ্গে, আর ‘শহিদ’ নির্মাণের
খেলায় ব্যস্ত যখন ছিল রাজনীতি,
তখনই
ছত্তিশগড় সরকার অর্ডার পাশ করিয়ে সেই বনাধিকার আইন বলে পাওয়া জমির উপর আদিবাসীদের
অধিকারটি খর্ব করে৷ দিনটি ছিল ২০১৬-র ৮ জানুয়ারি৷ খবরটি সংবাদে আসে, কিন্তু সেই সময়ে আবার অন্যান্য নানা খবর ‘ইন’ ছিল
যে হেতু, তাই নিয়ে তেমন নাড়াচাড়া পড়েনি৷
আর ওই খবরেই ছিল রাজস্থান বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগম লিমিটেড ও আদানি মিনেরালস প্রাইভেট
লিমিটেডকে ওই জমির নীচের কোল ব্লক হস্তান্তরিত করার জন্যই এই নির্দেশ৷ অস্পষ্ট নয়, সরকারের চাই জমি৷ আর তার জন্য দরকার
আদিবাসীদের জমি থেকে তাড়ানো৷ সুতরাং প্রয়োজন উচ্ছেদ৷ বস্তুত বড়ো বহুজাতিক সংস্থার
স্বার্থে অনেক দিন ধরেই বস্তারে আদিবাসীদের জমি নেওয়ার চেষ্টা চলছিলই৷ অনেক
আন্দোলন-লড়াইয়ের পরে বাতিল হয় এসার-এর প্রকল্প৷ এবং আদিবাসীদের জমি বাঁচানোর
লড়াইটারও তকমা দেওয়া হয় নকশালবাদী লড়াই বলে৷ আদিবাসীদের জমির জন্য আন্দোলনকে
মাওবাদীদের কাজ বলে এক করে দেওয়ার চেষ্টা৷ এক দিকে পুলিশ ও অন্য দিকে মাওবাদীদের
জাঁতাকলে পড়ে, বাঁচার স্বার্থেই তাই পক্ষ
বেছে নিতে হয় আদিবাসীদের৷ গড়ে ওঠে ‘সালওয়া
জুড়ুম’, গড়ে ওঠে ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’৷ উল্টো দিকে, যারা
জমি দিতে অস্বীকার করেন, তাঁরা হয়ে যান মাওবাদী !
অবস্থা এমনই, সেই ‘নিরপেক্ষ’ থাকার
উপায় নেই যে ! এই সব বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্যই সাংবাদিকতায় মানবিক প্রতিবেদন, বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংক্রান্ত নানা
পুরস্কারে ভূষিত সাংবাদিকরা৷ আসলে দু’টি
দিক৷ এক দিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর উল্টো দিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলা৷
দুটোকেই মান্যতা দেওয়া৷ আর সেটাই হয়তো আজকের এই প্রসারিত গণতন্ত্রের লক্ষণ৷ কিন্তু
এই প্রসারিত ডেমোক্রেসির একেবারে তলার দিকে যারা, যাদের
অধিকার-মানবাধিকার নিয়ে এত কথা,
তাঁদের
কথাটাই কিন্তু আসে না সংবাদপত্রে৷ যেমন ছাপা যায় না, প্রতি
দিন গুনতি মেলানোর জন্য ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া আদিবাসীদের কথা৷ ছাপা হয় না, কারণ ছাপা যায়ও না৷ কারণ সেই পুরনো৷ কে বলবে
এই কথা, কার দায়িত্ব ? খবরের কাগজে ছাপা হয়ে যাওয়ার পরে যদি ঘরে ঘরে
পুলিশি হামলা হয় আবার, পাশে থাকবে কে ? যদি এই কথাগুলো নাম না করে ছাপা হয়, তা হলে সাংবাদিকের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় ? তাই হয়তো দরকার পড়ে প্রতিষ্ঠানের৷ যখন জাতীয়
মানবাধিকার কমিশন বলে, হ্যাঁ ধর্ষণ হয়েছে, অভিযোগ এসেছে শারীরিক নির্যাতনের, তখনই অভিযোগে সিলমোহর পড়ে৷ যখন বর্ষা বলেন, তখনও৷ সেটা ভালো৷ কিন্তু এখানে সমস্যা হল, ঠিক যতটুকু তারা জানাবেন, ততটুকুই৷ সেটুকুই কনফার্মেশন৷ সেটুকুই
প্রকাশ করা চলে৷ প্রথিতযশা সাংবাদিক মালিনী সুব্রমনিয়াম বস্তারে এই ‘মিডিয়া ব্ল্যাক আউট’-এর সময়ে বলেছিলেন, ‘দ্য গভর্নমেন্ট ইজ আনডার প্রেশার টু ‘ওয়াইপ আউট দ্য মাওইস্টস’৷ দ্য আউটকাম ইজ হাইটেনড হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনস, ইনক্লিউডিং সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট অন উইমেন বাই
সিকিয়োরিটি পার্সোনেল৷ দ্য ক্র্যাকডাউন অন জার্নালিস্টস ইজ টু এনশিয়োর দ্যাট সাচ
নিউজ ডাজ নট গেট ন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটেনশন অ্যান্ড সালি দ্য নেম
অফ দ্য গভর্নমেন্ট৷’ কিন্তু প্রশ্ন থাকে, আজ তো না হয় এই নির্দিষ্ট ভূখন্ডটিতে
সাংবাদিকদের উপর ‘ক্র্যাকডাউন’--- কিন্তু আগেও কি এসেছে সংবাদমাধ্যমে
ভূমিপুত্রদের কথা ? কারা পড়বে তাদের কথা ? টার্গেট রিডার কারা ? স্থানীয় সংবাদ তো তখনই জাতীয় সংবাদের গুরুত্ব
পায়, যখন প্রতিষ্ঠান সেখানে
হস্তক্ষেপ করে৷ কমিটি, কমিশন, আদালত, থানা
… তা হলে কি প্রতিষ্ঠানের
সিলমোহর ছাড়া যাবতীয় আখ্যানই মিথ্যা ? অ-সত্য
? প্রতিষ্ঠানই একমাত্র সত্য ? ইন্টারনেট দুনিয়ার যে সব খবর ভাইরাল হয়, তার সবই বিশ্বাসযোগ্য নয় এ কথা সত্যি ঠিকই৷
কিন্তু হয়তো অস্বীকার করা যায় না,
খবর
করা আর না করার মধ্যে, খবর হওয়া এবং না হওয়ার
মধ্যেও স্বার্থ থাকে৷ ব্যবসায়িক স্বার্থ৷
বহুজাতিক দরকার না কি
আদিবাসী, দেশপ্রেম দরকার না কি
আদিবাসীদের জমি --- সেটা ঠিক করে নেওয়ার পরেই শুরু হয় মাপজোক৷ কতটা প্রসারিত হবে
গণতন্ত্র, কতটা সাহসী হবে
সংবাদমাধ্যম, কতটা প্রেস ফ্রিডমের
পুরস্কার জুটবে কার কপালে ! জিতবে কোন ভাষা ? ইংরেজি
না কি স্থানীয়দের ভাষা ? কোন সাংবাদিক খবর হবেন, স্থানীয় না আন্তর্জাতিক ? কোন নিগ্রহ ধর্ষণ আর কোনটা কোল্যাটেরাল
ড্যামেজ ? তার পরেও হয়তো এই
গণতন্ত্রই হাতের পাঁচ৷ কারণ তা প্রসারিত হয়৷ কিন্তু যদি কোনও একটা মুহূর্তে
গণতন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণের ফাঁকে তাপের তারতম্য ঘটে কিছু, কে বলতে পারে, জঙ্গল
ছাপিয়ে রেল লাইন পেরিয়ে খবর এসে আছড়ে পড়বে না শহরে ?
http://www.epaper.eisamay.com/Details.aspx?id=31524&boxid=154643762
No comments:
Post a Comment