এই
সময় : বাজারে গবাদি পশু কেনাবেচার উপরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নয়া ফরমান নিয়ে
কেরালায় সিপিএম তেড়েফুঁড়ে নামলেও হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায় সতর্ক আলিমুদ্দিন
স্ট্রিট৷ মুখে বিরোধিতা করলেও বামেদের মতোই জল মেপে মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্ত
নিয়ে পা ফেলতে চাইছে তৃণমূল৷ রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্বও সংবেদনশীল এই বিষয়ে
প্রতিবাদের কোনও রোডম্যাপ তৈরি করতে পারেনি৷
বাংলায়
রাজনৈতিক দলগুলির এই জল মাপার কৌশলে বিস্মিত নাগরিক সমাজের অনেক মুখ৷ বিদ্বজ্জনদের
অনেকে মোদী সরকারের এই ফরমান নিয়ে সরব হলেও, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়
প্রতিবাদ কলকাতায় এখনও সংগঠিত হয়নি৷ নাগরিক সমাজের এই ‘ঔদাসীন্য’ নিয়ে উদ্বিগ্ন
বিদ্বজ্জনদের একাংশ৷ আবার নাগরিক সমাজের একাংশ মনে করছেন, কেরালায় যে আঙ্গিকে
প্রতিবাদ হয়েছে, এই রাজ্যে সেই আঙ্গিকে প্রতিবাদ হবে এমন কোনও কথা নেই৷
তবে
নাগরিক সমাজের ঔদাসীন্যর থেকেও চোখে পড়ছে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলির অতি-সতর্ক
মনোভাব৷ হাত ধুয়ে এই ইস্যু নিয়ে রাস্তায় নামতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে এই
আশঙ্কা রয়েছে শাসক ও বিরোধী দুই পক্ষেরই৷ বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রক
নতুন বিধি ঘোষণা করতেই কেরালায় বামেরা তেড়েফুঁড়ে তার বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছে৷ সে
দিনই কড়া প্রতিক্রিয়া দেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী৷ মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও এই
বিধির বিরোধিতা করে মোদীকে চিঠি দিয়েছেন৷ সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন মোদীর ফরমানের
বিরোধিতায় গো-মাংস রান্না করে খেয়েছে৷ সিপিএম পলিটব্যুরো বিবৃতি দিয়ে মোদী সরকারের
এই বিধির বিরোধিতা করেছে৷ বৃন্দা কারাট, হান্নান মোল্লা প্রমুখ পলিটব্যুরোর নেতারা
তীব্র সমালোচনা করেছেন মোদী সরকারের৷ কিন্ত্ত বাংলার সিপিএম নেতারা স্বতঃপ্রণোদিত
ভাবে এই বিষয়ে একটা কথাও বলেননি৷ তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্রের
সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হলেও তৃণমূল নেতৃত্ব কিন্ত্ত এখনও এই ইস্যু নিয়ে রাস্তায়
নামার কোনও পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি৷ কেন্দ্র সরকারের বিধি হাতে আসার পর এ বিষয়ে
নবান্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে৷ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘আগে দেখি, কী
বিধি ওরা তৈরি করেছে৷ বিধি বিশদে না-দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব নয়৷ বিধিতে
কেন্দ্র সরকার কী বলতে চাইছে, তা দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করবেন৷’ ঘটনা হল, মমতা আগেও ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাসের উপর নিয়মের কড়াকড়ি নিয়ে
সরব হয়েছেন৷ গত বছর ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেও বিজেপির ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ নিয়ে
সরব হয়েছিলেন মমতা৷
তৃণমূলের
থেকেও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সতর্ক মনোভাব রাজনৈতিক মহলের চোখে পড়ছে৷ যে দ্রুততায় ও
ব্যাপকতায় কেরালায় সিপিএম রাস্তায় নেমেছে, তার ধারেকাছেও যেতে রাজি নয় বঙ্গ
ব্রিগেড৷ সেলিমের কথায়, ‘দুই রাজ্যের পরিস্থিতি এক নয়৷ গোমাংস জাতীয় খাদ্যের উপর
ওই রাজ্যের আমজনতার বড় অংশ নির্ভর করে৷ মোদী সরকারের সিদ্ধান্তর ফলে কেরালায়
মুসলিম, খ্রিস্টান ও দলিতদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের উপর আঘাত আসবে৷ তাই কেরালায়
প্রতিবাদের মাত্রা অনেক বেশি৷’ সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছে, কেরালায় যে কায়দায়
প্রতিবাদ হচ্ছে, সেই কায়দায় প্রতিবাদ করলে রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবার সুযোগটা নিয়ে নতুন
উদ্যমে মেরুকরণ করতে চাইবে৷ দলের প্রথম সারির এক নেতার কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে ওই ভাবে
প্রতিবাদ করলে বিজেপি মানুষের মধ্যে আরও বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইবে৷ রাজ্যে মেরুকরণের
প্রচেষ্টা চলছে, তাতে বাড়তি সুযোগ পাবে সঙ্ঘ পরিবার৷’ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের
সমালোচনা করে রবিবারই সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদক এস সুধাকর রেড্ডি বলেছেন, ‘সঙ্ঘ
পরিবার নিরামিষাশী অভ্যাস চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ এটা ওদের হিন্দু রাষ্ট্র
ষড়যন্ত্রের অন্তর্গত৷ যে মুসলিম এবং দলিতদের সঙ্ঘ পরিবার ঘৃণা করে, তাদের আঘাতের
জন্যই এটা করা হয়েছে৷’ কিন্ত্ত নাগরিক সমাজ কেন এতটা উদাসীন ? এতেই বিস্মিত
সাহিত্যিক আবুল বাশার৷ তাঁর কথায়, ‘অদ্ভুত গা-ছাড়া মনোভাব নিয়ে চলছে নাগরিক সমাজ,
একটা ম্রিয়মাণ ভাব দেখা যাচ্ছে৷ আমার প্রশ্ন, গবাদি পশুর পর মোদী সরকার কি মাছ
খাওয়ার উপর বিধি আরোপ করবে ? নিরামিষ সমাজ তৈরি করা কোনও রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা
হতে পারে৷ কিন্ত সরকার কী ভাবে এই অসাংবিধানিক নির্দেশ জারি করতে পারে ?’ মোদী
সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীও৷ তাঁর
বক্তব্য, ‘বৈদিক সমাজে যাগযজ্ঞে গোমাংস ভক্ষণের রেওয়াজ ছিল৷ মোদী সরকারের এই
সিদ্ধান্ত অবাঞ্ছিত৷ মন কি বাত-এ মোদী বলছেন, দেশের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে৷ এই
মন কি বাত কিন্ত্ত কাম কি বাত-এ পরিণত হচ্ছে না৷’ যদিও প্রতিবাদ মানেই রাস্তায়
নেমে প্রতিবাদ, এই তত্ত্ব মানেন না নৃসিংহপ্রসাদ৷ তাঁর কথায়, ‘দক্ষিণের রাজ্যে যে
আঙ্গিকে প্রতিবাদ হচ্ছে, তা এই রাজ্যে করতে হবে এমন কোনও কথা নেই৷’ ৷
No comments:
Post a Comment