বীরভূম জেলার পাঁচামি এলাকা পাথর খাদানের জন্য বিখ্যাত। এই এলাকার রাস্তায় সবসময়
ভারি গাড়ি পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচল করছে। সবসময় ভারি গাড়ি চলার ফলে রাস্তা আর রাস্তা
নেই, পাথরের ঢিপে পরিণত হয়েছে। উচু-নীচু পাথর আর খানাখন্দ। সেই পথেই অহরহ ট্রাকের যাতায়াত।
খালি গাড়ি নয়, পাথর বোঝাই ভারী ট্রাক।
বীরভূমের পাথর বলয় বলে পরিচিত ওই এলাকায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের অগস্টিন সোরেন, মার্সিন
হেমব্রমরা ‘ফাস্ট জেনারেশন’ স্কুলপড়ুয়া। তেঁতুলবান্দি গ্রামে পাথরের ওই পথে ওরা স্কুলে
যেত প্রাণ হাত করে। কখন গাড়ির ধাক্কা লাগে। ট্রাক, ডাম্পার যে গা ঘেঁষে চলে যায়। কখনও
আবার ট্রাকের চাকায় লেগে পাথর ছিটকে আসার ঝুঁকি থাকে। ভয়ে ওদের স্কুলে পাঠানোই বন্ধ
করে দিয়েছেন অভিভাবকরা। ঢোলকাটা গ্রামের গোপাল টুডু বলেন, ‘ভোর থেকে একনাগারে ট্রাক
চলে। যে কোন সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। ভয়ে তাই আর ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাই না।’ ভাঁড়কাটা
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ৩৪১ জন ছাত্রের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। কিছু আদিবাসীও
আছে। স্কুলে উপস্থিতির হারে মেরেকেটে ৫০ শতাংশ। সাগরবান্দি প্রাইমারি স্কুলে সেই হার
বড়জোড় ৩০-৩৫ শতাংশ।
বেসরকারি তথ্য নয়, শিক্ষা দপ্তর ও সর্বশিক্ষা মিশনের সমীক্ষায় বীরভূমের পাথর খাদান
এলাকায় শিক্ষার বিপর্যস্ত চেহারা সামনে এসেছে। যা সামাল দিতে তড়িঘড়ি প্রকল্প হাতে
নিয়েছেন সর্বশিক্ষা কর্তৃপক্ষ। অথচ ওই এলাকার শিশুদের পড়াশোনা শেখাতে সরকারের উদ্যোগ
যথেষ্টই। প্রায় গ্রামে গ্রামে প্রচুর স্কুল গড়ে উঠেছে, যাতে স্কুলে পড়তে দুরে যেতে
না হয। কিন্তু বাস্তবে যে শিশুরা স্কুল থেকে মুখ ফেরাচ্ছে, সেই তথ্য সামনে আসায় উদ্বিগ্ন
শিক্ষা দপ্তর ও প্রশাসন। সরকারি সমীক্ষা বলছে, অনুপস্থিতির গড় হার ৩০ শতাংশ। কিন্তু
বাস্তব বলছে পরিসংখ্যান কোথাও ৫০, কোথাও ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রে
জানা গিয়েছে, পরিস্থিতির বদল আনতে রিমেডিয়াল টিচিং, হেলথ ক্যাম্প, অভিভাবক-শিক্ষক সভা,
পাঠক্রম বহির্ভূত আনন্দদায়ক শিক্ষা, খেলাধূলা, গান-বাজনার, এমনকি ডিজিটাল লার্নিং-এর
ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এজন্য সেই নির্দিষ্ট স্কুলগুলির শিক্ষকদের স্পেশাল ট্রেনিং কোর্স
চালু করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণ দিতে পাঠানো হবে বিশেষজ্ঞদের।
বীরভূমের জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘আমরা পাথর বলয়ে স্কুলছুট ফেরানোর একাধিক
পরিকল্পনা করেছি। আগামী ৩ অক্টোবর নতুন প্রকল্পের সূচনা করছি।’ সর্বশিক্ষা মিশনের বীরভূম
জেলা প্রকল্প আধিকারিক বাপ্পা গোস্বামী বলেন, ‘আমরা পাঁচামি এলাকার যে প্রাইমারি স্কুলতে
অনূপস্থিতি বেশি, সেগুলিকে চিহ্নিত করেছি। ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষিত করতে যে পরিকল্পনা
নিয়েছি, তাতে তাদের স্কুলে উপস্থিতি নিয়মিত হবে আশা করছি।’
প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত স্কুলগুলি সবই মহম্মদবাজার ব্লকের। কিন্তু শিক্ষা মহলের
দাবি, একই সমস্যা আছে মুরারই-১ ও নলহাটি-১ ব্লকে। শুধু পাথর ভর্তি পথ আর পাথর বোঝাই
ভারী ট্রাক যাতায়াত নয়, শিশুদের আর এক সমস্যা যেখানে সেখানে পাথর ভাঙার ক্র্যাশার ও
খাদান। সাগরবান্দি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ধনা মুর্মু বলেন, ‘দিনভর ক্র্যাশারের কানফাটা
শব্দে কি কেউ পড়াশোনা করতে পারে? বিশেষ করে শিশুদের পক্ষে তো এক জায়গায় বসে থাকাই
অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকেও স্কুলে আনতে পারি না বাচ্চাদের। স্কুলের
খাতায় শুধু নামই থাকে ওদের।’
প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল শালবাদরা সাঁওতাল প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী সুন্দরী হেমব্রম।
পরিণাম সুখকর হয়নি। মাস খানেক আগে ওই প্রতিবাদের পর তাকে শুনতে হয়েছে কটূক্তি। সুন্দরীর
বাবা-মা আর তাকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী নন। এলাকার বাসিন্দা বুধন হেমব্রম বলেন, ‘মেয়েটা
বড় হচ্ছে। ডাম্পার ড্রাইভাররা মেয়েদের বাজে কথা বলে। গায়ে হাত দেয়। এখন আর মেয়েকে
স্কুলে পাঠাই না।’ গ্রামের বাসিন্দারা দাবি করেছিল, স্কুল শুরু ও ছুটির সময় ট্রাক চলাচল
বন্ধ রাখা হোক। কেউ শোনেনি। উল্টে পাথরের কারবারিদের মদতে কিছু লোক গ্রামবাসীদের উপর
চড়াও হয়েছিল বলে অভিযোগ। সমস্যা স্বীকার করে এলাকার শিক্ষক বলেন, ‘অগত্যা ছাত্রছাত্রীদের
স্কুলে যাওয়াতেই কোপ পড়ছে।’ ঝাড়খন্ড লাগোয়া বেড়েপাড়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নলিন
সোরেন বলেন, ‘খাতায়-কলমে আমার স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৬৫। গরহাজিরা ২০-২৫।’
সুত্র –
এই সময়, হেমাভ সেনগুপ্ত, ১৯/০৯/২০১৮।
No comments:
Post a Comment