সিঙ্গুরের ছায়া মহারাষ্ট্রের পালঘরে। ন্যানোর মতোই
আশা-নিরাশার দোলাচলে নরেন্দ্র মোদীর সাধের বুলেট ট্রেন প্রকল্প। ২০১৮ এর ডিসেম্বরের
মধ্যে বুলেট ট্রেনের গোটা করিডরের জমি অধিগ্রহণ সেরে নির্মাণকাজের দরপত্র ডাকার
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তা না হলে, ২০২২ সালের ১৫ অগস্ট তো ছাড়, ’২৩ সালেও বুলেট ট্রেনের ছোটা মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ওই প্রকল্পের
গলার কাঁটা হল মহারাষ্ট্র-গুজরাতের সীমান্তে জল-জঙ্গলে ঘেরা আদিবাসী অধ্যুষিত
পালঘর।
পালঘরে অধিগ্রহণ-জনিত সমস্যা যে রয়েছে, তা মেনে নিয়ে ন্যাশনাল হাই স্পিড রেল কর্পোরেশন লিমিটেড (NHSRCL)-এর প্রধান আঁচল খারে বলেন, “বাজার দর থেকে চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে জমি কেনা হচ্ছে। বানানো হচ্ছে হাসপাতাল, স্কুল। তাই আমরা আশাবাদী শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের প্যাকেজে রাজি হয়ে যাবেন
স্থানীয়রা।” সবর্শক্তি প্রয়োগ করে পালঘর জেলার চারটি তালুকার
মধ্যে ডহানু, তলাসারিতে গ্রামবাসীদের বোঝাতে পারলেও সাফল্য এখনও
অধরা পালঘরে। সব মিলিয়ে ত্রিশটির বেশি গ্রামে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আলোচনা শুরুই
করতে পারেনি প্রশাসন।
কারণ পাঁচ গুণ বেশি দামেও জমি দিতে নারাজ পালঘরের
বীরথানপুরের কৃষক পরশুরাম গায়েকোয়াড়। সম্পন্ন কৃষক। চাষের আয়েই ঘর চলে। সম্প্রতি
নতুন দর হেঁকে স্বেচ্ছায় জমিদাতাদের চারের বদলে পাঁচ গুণ অর্থ দেওয়ার ঘোষণা করেছে
প্রশাসন। বাড়ি নষ্ট হলে, সেই গ্রামে বা সংলগ্ন এলাকায় বাড়ি করে দেওয়ার
প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তাও রাজি হননি গায়েকোয়াড়। গ্রামসভায় শুনেছিলেন তাঁর জমির উপর
দিয়ে লাইন যাবে, শোনা ইস্তক রাতের ঘুম ছুটেছে বছর পঁয়তাল্লিশের ওই
কৃষকের। তাঁর কথায়, “ক্ষতিপূরণের টাকা আর ক’দিন চলবে ? তার থেকে পরিবারের এক জনকে চাকরি দিক। জমি দিয়ে
দেব।” এ দিকে রেল বলছে, অধিগ্রহণের জন্য সামান্য জমির প্রয়োজন। এলিভেটেড
করিডর (যার উপরে ট্রেন ছুটবে) ও নিচে দু’ ধারে থাকবে চার ফুটের রাস্তা। সব মিলিয়ে ষাট ফুটের
লম্বা একটি ফালি লাগবে যা গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে যাবে। যে জমির ২৫ শতাংশ কাজের
শেষে ফেরতও দেওয়া হবে।
প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি
সম্পর্ক গড়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখালেও স্থানীয়দের চাকরি দেওয়ার প্রশ্নে আশ্বাস
দিতে অপারগ খারে। তাঁর কথায়, “নির্মাণ কাজ শুরু হলে প্রচুর মজুর দরকার হবে। তখন
স্থানীয়রা সুযোগ পাবেন।” কিন্তু স্থানীয়দের স্থায়ী ভাবে নেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটা কার্যত বুঝিয়ে দিয়েছেন রেলকর্তারা। তাঁদের কথায়, এ ধরনের প্রকল্পে দক্ষ লোকেদের নেওয়া হয়। ফলে গ্রামবাসীদের সুযোগ দেওয়া
যাচ্ছে না।
পালঘরের ঘরে-ঘরে শিবসেনার সমর্থক। বীরথানপুরে আঁচল
খারের উপস্থিতিতে NHSRCL চিকিৎসক সমেত প্রাথমিক
স্বাস্থ্য-কেন্দ্র চালু করলেও বিনিময়ে বুলেট ট্রেন চান না গ্রামের সরপঞ্চ রাজশ্রী
কেনি। মুখে হাসি লেগে রয়েছে সব সময়। হলে কী হবে, স্থানীয় এলাকায় শিবসেনার দাপুটে নেত্রী রাজশ্রীর
হাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদ্বোধন হলেও জমি দেওয়ার প্রশ্নে তিনি দুর্যোধনের মতোই
একবগ্গা। বলছেন, “স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা স্কুলের বিনিময়ে জমি কেন দেব
? এ চালু করা তো সরকারের দায়িত্ব।”
মুম্বই-আমদাবাদ ৫০৮ কিলোমিটার লাইনের মধ্যে ১১০
কিলোমিটার লাইন যাবে পালঘর জেলার ৭২টি গ্রামের মধ্যে দিয়ে। প্রকল্পের প্রায় কুড়ি
শতাংশ জমি দেওয়ার প্রশ্নে আন্দোলনে নেমেছেন স্থানীয় কৃষকেরা। রেলের সমস্যা হল, প্রস্তাবিত লাইনের পাশেই পাহাড় থাকায় ওই জমি অধিগ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও
রাস্তা নেই।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৩/০৯/২০১৮।
No comments:
Post a Comment