খাতড়া, ২৩শে এপ্রিল— ঠ্যাঙারে বাহিনীর হামলায় রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন
পর্ব। সোমবারও রাজ্যজুড়ে বিরোধী প্রার্থীদের রক্তের স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু প্রায়
৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেই এদিন জঙ্গলমহলের খাতড়ায় আদিবাসীরা জমায়েত হয়ে
রাজ্যের শাসক দলের উদ্দেশে মানুষের রক্ত নিয়ে বিজয়োল্লাস বন্ধ করার হুঙ্কার দিলেন।
এই জমায়েত জানিয়ে দিল, পরিণাম ভাল হবে না। মানুষ এই মস্তানি সহ্য করবেন না। এক অনিবার্য
সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাজ্য।
এদিন তীর, ধনুক, টাঙ্গি হাতে মিছিল করে খাতড়া এ টিম মাঠে আসেন আদিবাসীরা। মিছিল
বা সমাবেশের কোনও অংশেই পুলিশের দেখা মেলেনি। এদিন প্রতি পদে প্রশাসনের দায়িত্ব স্মরণ
করিয়ে দেন আদিবাসী মানুষজন। বক্তব্যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে আদিবাসীদের অধিকার
খর্ব করে চলেছে, তার ফিরিস্তি তাঁরা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, আদিবাসীদের উপর যে অত্যাচার
চলছে, তা দেশের মানুষ জানেন না। সংবাদমাধ্যমেও তাঁদের কথা লেখে না। প্রচার করা হচ্ছে,
জঙ্গলমহল হাসছে। যদি সত্যিই জঙ্গলমহল হাসত, তাহলে বৈশাখের ভরদুপুরে এত মানুষ কেন ইনসাফ
চাইতে আসবেন!
দলমত নির্বিশেষে তৈরি আদিবাসী একতা মঞ্চের উদ্যোগে এদিন এই জনসভা হয়। বাঁকুড়া ছাড়াও
পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বীরভূম, বর্ধমান প্রভৃতি জেলা থেকে সাঁওতাল,
কড়া, মাহালী, ভূমিজ, শবর, লোধা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা এই সমাবেশে আসেন।
এঁদের হাতে ছিল পাতা সমেত শাল গাছের ডাল, তীর-ধনুক সহ চিরায়ত অস্ত্র। যে সংখ্যক মানুষ
এসেছিলেন, তার অর্ধেকও মাঠে ঢুকতে পারেননি।
কেন এই সমাবেশ? এদিন বীরভুম থেকে সমাবেশে আসা রাজ্য আদিবাসী কড়া সমাজ কল্যাণ সংগঠনের
রাজ্য সম্পাদক বিশ্বনাথ কড়া জানান, দিনের পর দিন আদিবাসী সমাজের মানুষদের ঠকানো হচ্ছে।
সংরক্ষণের কথা বললেও আদিবাসী ছেলেমেয়েদের চাকরি কোথায়? মানুষ এসব জানেন না। এদিন রানিবাঁধের
আদিবাসী কৃষক রমেন হাঁসদা, রবি হাঁসদারা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন জঙ্গলমহল হাসছে।
কী রকম হাসছে? কেন্দুপাতার কাজ বন্ধ। বাইরের ব্যবসায়ীদের হাতে তাঁরা পুতুল হয়ে গিয়েছেন।
কাজ নেই। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তাঁদের সবাইকে দুটাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছেন তিনি। কিছুদিন
আগে পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে এই চাল সরবরাহ করেছে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের
মেয়ের বোলবোম রাইস মিল এবং বালুরঘাটের এক তৃণমূল নেতার এজেন্সি। পোকা ধরা, দুর্গন্ধযুক্ত
সেই চাল জঙ্গলমহলের মানুষকে খেতে হয়েছে। এখানে আজ পর্যন্ত ডিজিটাল রেশন কার্ড দেওয়া
হলো না। এর পেছনে রহস্য কী?
পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থেকে আসা গৃহবধূ সরস্বতী হেমব্রম, অনুরাধা মাণ্ডিরা জানালেন,
সব জায়গায় আদিবাসী হস্টেল বন্ধ। তাঁদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
জঙ্গলমহলের অলচিকি হরফে পঠনপাঠনের একটি স্কুলেও আজ পর্যন্ত কোনও শিক্ষক দিল না রাজ্য
সরকার। এঁদের সব চেয়ে বড় অভিযোগ, আদিবাসী মানুষজনের আত্মসম্মানে আঘাত করা হচ্ছে।
একাধিক ব্যক্তি জানালেন, শিল্পীভাতার প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসীদের শিল্পীসত্তাকে
শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে সেখানে রাজ্যের শাসকদলের লোকজন তাঁদের নিয়ে গিয়ে নাচগান
করাচ্ছে। মুখে শিল্পীভাতার কথা বললেও বহু শিল্পী এই ভাতা পাচ্ছেন না। অরণ্যের পাট্টা
দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিগত শংসাপত্র দেওয়া নিয়ে টালবাহানা চলছে। দিনের পর দিন রাজ্য
ও দেশের নানা স্থানে আদিবাসী রমণীরা ধর্ষিতা হচ্ছেন। ধর্ষণকারীর অপরাধকে লঘু করে দেখা
হচ্ছে। এই চক্রান্তে জড়িত প্রশাসন, শাসক দল।
এদিন আদিবাসী সমাবেশ থেকে আওয়াজ ওঠে, কয়েকদিন আগে রানিবাঁধে অজিত মুর্মু নামে এক
ব্যক্তিকে শাসক দলের লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করে। ভয় দেখিয়ে তাঁর পরিবারকে দিয়ে
মিথ্যা কথা বলানো হলো। কতদিন এই অত্যাচার সহ্য করবেন তাঁরা!
সৌজন্য - গণশক্তি, ২৪/০৪/২০১৮।
No comments:
Post a Comment