পুরুলিয়া, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭।
মুকুল রায়ের ছায়াসঙ্গীর ভাইকে গাঁজা
পাচারের অভিযোগে গ্রেফতারের রেশ কিছুতেই কাটছে না। প্রাথমিক স্কুলের ওই শিক্ষক
শুভজিৎ মাহাতোর গ্রেফতারি নিয়ে এলাকার অনেকের ক্ষোভ ছিলই। রবিবার তাঁরা শুভজিতের
সুবিচার চেয়ে পথে নামলেন। মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ
তুলে চাষমোড়ে তাঁরা প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। পুরুলিয়া মফস্সল থানার গাড়াফুসড়
পঞ্চায়েত সংলগ্ন মাঠে ধিক্কার সভাও করেন তাঁরা। সেখানে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের
দাবি ওঠে।
সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন পুরুলিয়া নাগরিক
কমিটির ব্যানারে ওই মিছিল হলেও, সেখানে যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের
নেতৃত্বকে দেখা গিয়েছে, তেমনই পা মিলিয়েছেন কলেজ পড়ুয়া থেকে সাধারণ গৃহবধূও। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে
প্রতিবাদে সামিল হতে দেখা গিয়েছে এলাকার কিছু ব্যবসায়ীকেও। যদিও পুলিশ সুপার জয়
বিশ্বাস আগেই জানিয়েছেন, গাঁজা পাচারের সময় হাতেনাতেই শুভজিৎকে ধরা হয়। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘সভার
কথা জানি না।’’
গত ২৯ নভেম্বর ভোরবেলায় মুকুল রায়ের
ছায়াসঙ্গী সুরজিৎ মাহাতোর ভাই স্থানীয় বাঁধডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভজিৎকে
গ্রেফতার করে পুরুলিয়া মফস্সল থানার পুলিশ। পুলিশের দাবি ছিল, পুরুলিয়া-রাঁচি
রাস্তায় নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে নম্বর প্লেটহীন একটি
মোটরবাইকে শুভজিৎ ও ধানবাদের পাথরডি-র উমেশ মাহাতোকে ২৩ কেজি ৪০০ গ্রাম গাঁজা-সহ
গ্রেফতার করে। যদিও তাঁর পরিবারের দাবি, ভোরে পুলিশ এসে দরজা ঠকঠক করে শুভজিতের
ডাকনাম ধরে জানতে চেয়েছিল, তিনি বাড়িতে রয়েছেন কি না। তাঁর স্কুলে চুরি হয়েছে জানিয়ে বাড়ির লোকজনকে বলা
হয়ে সেই ব্যাপারে থানার বড়বাবু তাঁর সঙ্গে আলাদা কথা বলবেন। তারপরেই শুভজিৎকে
গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায় পুলিশ। শুভজিতের বাবার দাবি, পাচার
তো দূরের কথা, তাঁর ছেলে গাঁজা দেখলে চিনতেও পারবেন না। মুকুল রায়-যোগ থাকার জন্যই মিথ্যা
অভিযোগে শুভজিৎকে ধরা হয়েছে বলে তাঁদের ধারণা। মুকুলও অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে
পুলিশরাজ চলছে। কয়েক হাজার যুবক যুবতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নেই বলে তাঁদের
নারকোটিক কেস দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। পুরুলিয়াতেও তাই হয়েছে। ওই ছেলেটির মোবাইল
টাওয়ার এবং যে পুলিশকর্মীরা তাঁকে গ্রেফতার করেছেন তাঁদেরও মোবাইল টাওয়ারের
অবস্থান খতিয়ে দেখা হোক।’’
তেমনই মনে করছেন এ দিন পথে নামা মানুষজনও।
পুলিশের তথ্য তাঁরা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, শুভজিৎ নোংরা রাজনীতির শিকার। তাই
অবিলম্বে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছেন তাঁরা। প্রতিবাদ চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
রবিবারের ধিক্কার সভার আহ্বায়ক স্থানীয়
গ্রাম পঞ্চায়েতের দীর্ঘ ২৫ বছরের কংগ্রেস প্রধান জন্মেঞ্জয় মাহাতো দাবি করেন, ‘‘ছেলেটিকে
বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। শুভজিৎ যে গাঁজা পাচারে
জড়িত থাকতে পারে, সে কথা এলাকার একজন মানুষও বিশ্বাস করছেন না। পুলিশ অন্যায় করেছে।’’
আদিবাসী কুড়মি সমাজের নেতা অজিত মাহাতো
বলেন, ‘‘এই প্রতিবাদ সভা দেখে যাঁরা এই চক্রান্তের পিছনে, তাঁদের
কাছে নিশ্চয়ই বার্তা পৌঁছে গিয়েছে। শুভজিতের মুক্তির দাবিতে এই আন্দোলন শুরু হল।’’ তিনি
জানান, আগামী শুক্রবার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে প্রথমে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
তারপরে প্রশাসনের অবস্থান দেখে তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ করবেন।
এ দিনের সভায় প্রাক্তন বিজেপি নেতা রাজীব
মাহাতো বলেন, ‘‘পুলিশের পুরো দাবিই গাঁজাখুরি মনে হচ্ছে। শুভজিতের বাড়ির কাছে রেলের লেভেল
ক্রসিংয়ে সিসিক্যামেরা রয়েছে। পুলিশের গাড়ি এসে তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে থাকলে, তা
ওই ক্যামেরার ফুটেজ ধরা পড়ে যাবে। এই তথ্য যথাস্থানে জানানো হয়েছে।’’
একই সুর শোনা গিয়েছে গাড়াফুসড় গ্রাম
পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান কমলাকান্ত মাহাতোর কথাতেও। তিনি আবার মন্ত্রী
শান্তিরাম মাহাতোর সম্পর্কিত ভাই। এ দিনে সভায় তিনি বলেন, ‘‘শুভজিতের
বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ কেউ বিশ্বাস করছেন না। ওঁর মুক্তি চাই। নিরপেক্ষ তদন্ত হোক।’’
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুভজিতের বাবা
সুবোধ মাহাতো কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন ‘‘এত মানুষ আমাদের পাশে রয়েছেন। সকলের প্রতি
কৃতজ্ঞতা। আমি এখনও বলছি আমার ছেলে নির্দোষ। সত্যটা এক দিন প্রমাণিত হবেই।’’
এ দিনের সভায় না থাকলেও পাশে দাঁড়িয়েছেন
জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় এমন নোংরা রাজানীতি ছিল না।
রাজনীতির সুস্থ পরিবেশ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’
স্থানীয় বাসিন্দা ঋষিপদ গোপও থেকে কলেজ
ছাত্রী সাগরিকা মাহাতো বা গৃহবধূ রাধিকা মাহাতো, সুমিত্রা মাহাতো-সহ সকলেরই বক্তব্য, ‘‘আমরা
সুবিচার চাই।’’
সেটাই ভাবাচ্ছে শাসকদলের একাংশকেও। এত দিন
প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন শুভজিতের পরিবার। কিন্তু এ দিন তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন
এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষজন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রেফতার-কাণ্ড নিয়ে এ ভাবে
জলঘোলা হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছেন শাসকদলের জেলা নেতৃত্ব। জেলা তৃণমূল সভাপতি
শান্তিরাম মাহাতোর ঘটনা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করছেন না। এ দিন তৃণমূলের জেলা
সাধারণ সম্পাদক নবেন্দু মাহালি বলেন, ‘‘প্রতিবাদ মিছিল ও সভার কথা শুনেছি। গোটা
ব্যাপারটা নিয়ে এলাকার নেতৃত্বের কাছে খোঁজ নেব।’’
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৪/১২/২০১৭।
No comments:
Post a Comment