Monday, December 25, 2017

ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের পথে ঃ- (প্রথম ভাগ)

আদিবাসীদের এক ঐতিহাসিক আন্দোলন ঝাড়খণ্ড আন্দোলন। ঝাড়খণ্ড আন্দোলন শুধুমাত্র এক পৃথক রাজ্য নির্মাণের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন আদিবাসীদের আত্মপরিচিতির আন্দোলন, অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষায় এই আন্দোলন নিয়ে লেখা পাওয়া যায় না। কিন্তু আদিবাসীদের আত্মসন্মান, আত্মমর্যাদা, অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস জানা খুবেই গুরুত্বপূর্ণ। একটা জিনিস অনুভব করেছি যে সমস্ত আদিবাসী জঙ্গল সংলগ্ন এলাকায় বাস করেন না, তির ধনুক এর সাথে পরিচিত নন, আদিবাসী সামাজিক স্বশাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত নন, ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্ক ওয়াকিবহাল নন, সেই সমস্ত আদিবাসী অনেকাংশেই নিজেদের আদিবাসীত্ব হারিয়ে ফেলেছেন।  
তাই নিজের সাধ্য মত ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ইতিহাস লেখার চেষ্টা করছি। সমস্ত তথ্য বিভিন্ন সুত্র থেকে সংগৃহীত।  

ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের পথে ঃ- (প্রথম ভাগ)
প্রদীপ কুমার হাঁসদা, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিমবঙ্গ।

উনবিংশ শতাব্দীতে ছোটনাগপুর অঞ্চল কিংবদন্তী আদিবাসী মহাপুরুষ বিরসা মুন্ডার আবির্ভাব দেখেছিলেন। বিরসা মুন্ডা ডাক দিয়েছিলেন আবোয়াহ দিশম আবোয়াহ রাজ (আমাদের দেশ, আমাদের রাজ)। পূর্বপুরুষদের জমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন। বিরসা মুন্ডা বলেছিলেন, নিজেদের জমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হলে এই দেশ সোনার দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। বিরসা মুন্ডার বিদ্রোহের ফলাফল হিসেবে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত করেছিল ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯০৮ (Chotonagpur Tenancy Act, 1908)
বিরসা মুন্ডার বিদ্রোহের পরেও আদিবাসীরা তাদের অধিকারের লড়াই জারি রেখেছিলেন। রাঁচি অঞ্চলে আদিবাসীরা গড়ে তুলেছিলেন টানা ভগত আন্দোলন, সাঁওতাল পরগনায় সাফা হড় আন্দোলন, পালামু তে ফেটাল সিং আন্দোলন, সিংভুমে হরি বাবা আন্দোলন, মানভুমে ভুমিজ আন্দোলন, প্রভৃতি।
তৎকালীন সময়ে গান্ধী অনুগামী কংগ্রেসি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ঠক্কর বাপা তার অনুগামীদের নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে চলছিলেন। টানা ভগত আন্দোলনকারীরা ঠক্কর বাপা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধীজীর অনুগামী হন ও গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন।
অপরদিকে আদিবাসীদের হিন্দু ধর্মের প্রভাবমুক্ত করার জন্য খৃষ্টান মিশনারিরা আদিবাসীদের শিক্ষিত ও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। খৃষ্টান মিশনারিদের চেষ্টার সফল রুপায়ন হলেন জয়পাল সিং মুন্ডা ও আদিবাসীদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল ঝাড়খণ্ড পার্টি। আদিবাসীদের অধিকার আদায় ও সংগ্রামে জয়পাল সিং মুন্ডা ও ঝাড়খণ্ড পার্টি চিরকাল আদিবাসীদের মধ্যে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। খৃষ্টান মিশনারিদের চেষ্টার ফলে আদিবাসী সমাজের একটা অংশ আধুনিক ইউরোপিয়ান শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকেন, যদিও এর বেশিরভাগ খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী। শিক্ষিত আদিবাসীরা নিজ সমাজ ও দেশের উন্নয়নের জন্য সংগঠিত হতে থাকেন। উনবিংশ শতাব্দীর বিশ, তিরিশ ও চল্লিশ এর দশকে শিক্ষিত আদিবাসীরা অনেকগুলি আদিবাসী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।
১৯১০ সালে মিশনারি শিক্ষায় শিক্ষিত জে বারথোলমেন (J. Bartholmen) প্রথম একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। জে বারথোলমেন চাইবাসার একজন অনাথ, হাজারীবাগের সেন্ট কলমবাস কলেজ এর ছাত্র ছিলেন। জে বারথোলমেন একজন ভাল ছাত্র ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন। তাঁকে একজন খৃষ্টান মিশনারি মানুষ করেছিলেন, তাই হয়ত জে বারথোলমেনের ভেতর সবসময় এক পরোপকারী আত্মা কাজ করত। যখনেই কাওকে বিপদে পড়তে দেখতেন, সাহায্য করতে ছুটে যেতেন। জে বারথোলমেন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খৃষ্টান আদিবাসী ছাত্রদের সংগঠিত করতেন, সভা, সমিতি আয়োজন করতেন ও খৃষ্টান আদিবাসী ছাত্রদের সম্মেলন ও সমাবেশে বক্তব্য রাখতেন। জে বারথোলমেন খৃষ্টান ছাত্রদের সম্মেলন এ যোগদান করতে শ্রীরামপুর ও ঢাকা শহরে এসেছিলেন। ১৯১২ সালে ঢাকা শহরের এক সম্মেলন থেকে ফিরে গিয়ে জে বারথোলমেন ঢাকা ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলেন। জে বারথোলমেন দুঃস্থ খৃষ্টান আদিবাসী ছাত্রদের সাহায্য করতে একটি তহবিল গড়ে তোলেন। কয়েক জন জার্মান মিশনারি দুঃস্থ খৃষ্টান আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে নিয়মিত চাঁদা দিতে রাজিও হয়ে যান। সেন্ট পল শিক্ষায়াতনে এক নাটক অনুষ্ঠিত হয় এবং ভাল অর্থ সংগৃহীত হয়। এই ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে জে বারথোলমেন রাঁচি তে এঞ্জেলিকান ও লুথেরান ছাত্রদের এক সম্মেলন আয়োজন করেন ও রাঁচিতে ঢাকা ছাত্র ইউনিয়ন এর শাখা স্থাপন করা হয় এবং পিটার হেওয়ার্ড কে দায়িত্ব দেন। ১৯১৫ সালে জে বারথোলমেন স্নাতক সম্পূর্ণ করেন এবং সেন্ট পল হাই স্কুল, রাঁচিতে শিক্ষক পদে যোগদান করেন। জে বারথোলমেন চিরজীবন আদিবাসীদের উন্নতি সাধনের চেষ্টা করে গিয়েছেন কিন্তু বিভিন্ন কারনে আদিবাসীদের শক্তিশালী নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু জে বারথোলমেনের গড়ে দেওয়া ভিতে পরবর্তীকালে আদিবাসীরা আরও সংগঠিত হন এবং ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের ভিত তৈরি হয়।
জে বারথোলমেন এর পরবর্তীকালে ১৯১৩ সালে গড়ে ওঠে ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (Chotonagpur Unnati Samaj)। ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ এর নেতৃত্বে ছিলেন থিওবেল ওঁরাও, রায় সাহেব বন্দি রাম ওঁরাও, রেভারেন্ড জয়েল লাকড়া, পল দয়াল। রেভারেন্ড জয়েল ওঁরাও এর নেতৃত্বে ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের সামনে ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (CUS)  আদিবাসীদের দাবী দাওয়া পেশ করে ও আদিবাসীদের জন্য পৃথক রাজ্যের দাবী করে। পরবর্তীকালে ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (CUS) সংগঠনের ভেতর খৃষ্টান ও অ-খৃষ্টান আদিবাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয় এবং ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (CUS) ভেঙ্গে অ-খৃষ্টান আদিবাসীরা পৃথক সংগঠন ‘কিষান সভা’ তৈরি হয়।
এঞ্জেলিকান ও লুথেরান খৃষ্টান আদিবাসীরা ঢাকা ছাত্র ইউনিয়ন (Dacca Students Union) ও ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (Chotonagpur Unnati Samaj) এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই রোমান ক্যাথলিক আদিবাসীরাও নিজেদের সংগঠন গড়ে তুলতে চাইলেন। রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টান আদিবাসীরা গড়ে তুললেন ছোটনাগপুর ক্যাথলিক সভা (Chotonagpur Catholic Sabha)। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ছোটনাগপুর ক্যাথলিক সভা (Chotonagpur Catholic Sabha) দুই জন প্রার্থী দাড় করায় এবং ‘ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (CUS)’ ও ‘কিষান সভা (KS) কে পরাজিত করে দুই জন আদিবাসী প্রার্থীকে জিতিয়ে আনে। ছোটনাগপুর ক্যাথলিক সভা (CCS)-র নেতা নির্বাচিত হন ইগনেস বেক। পরবর্তীকালে ইগনেস বেক এর নেতৃত্বে ছোটনাগপুর ক্যাথলিক সভা (CCS) রাঁচি পৌরসভা নির্বাচনেও বিপুল জয় লাভ করে।
১৯৩৮ সালে আদিবাসীদের কয়েকটি সংগঠনের মিলিত প্রয়াসে এই সময়ের সব থেকে প্রভাবশালী আদিবাসী সংগঠন ‘আদিবাসী মহাসভা’ গড়ে ওঠে। টানা ভগত অনুগামী ও কংগ্রেসি অনুগামী আদিবাসী ছাড়া প্রায় সমস্ত আদিবাসী নেতা, কর্মী ও সংগঠন আদিবাসী মহাসভায় মিশে যায়। ৩১ শে মে, ১৯৩৮ সালে হিন্দপিরি, রাঁচিতে প্রথম আদিবাসী মহাসম্মেলন এ ছোটনাগপুর ক্যাথলিক সভা (CCS), ছোটনাগপুর উন্নতি সমাজ (CUS), ‘কিষান সভা (KS)’, মুন্ডা সমাজ (MS), প্রমুখ আদিবাসী সংগঠন মিশে গিয়ে উদ্ভব হয় ‘আদিবাসী মহাসভা’-র। প্রায় ৪০০ প্রতিনিধি এই আদিবাসী মহাসম্মেলনে যোগ দেন। সভাপতি নির্বাচিত হন থিওডর সুরিন, সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন রায় সাহেব বন্দি রাম ওঁরাও এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন পল দয়াল। ২১ জন সদস্যকে নিয়ে কার্যকরী সমিতি গঠন করা হয়। প্রধান দাবী হিসেবে ছোটনাগপুর কে পৃথক অঞ্চল করার দাবী করা হয়। ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে রাঁচি শহরের জয়করণ তামলি নামে এক সদস্যের বাড়ীতে আদিবাসী মহাসভার অফিস খোলা হয় এবং ‘আদিবাসী’ নামে হিন্দি ভাষায় এক পাক্ষিক সংবাদপত্র প্রকাশ শুরু হয়।
..................ক্রমশ (পরবর্তী ভাগ আগামী সময়ে)। 

No comments:

Post a Comment