ময়ূরেশ্বর, ২০
ডিসেম্বর, ২০১৭।
কিছু দিন আগেই আদিবাসী
গ্রামে গিয়ে দুস্ত আদিবাসীদের শীতের পোশাক বিতরণ করে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন হোয়াটস
অ্যাপ গ্রুপ “খোলা হাওয়া” এর সদস্যরা। এবার অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কী ভাবে ওঝা,
গুণিনরা ‘লাগে তাক, না লাগে তুক’
খেলা করেন — সেই রহস্য তুলে ধরতে উদ্যোগী হল হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ
‘খোলা হাওয়া’। বিজ্ঞান মঞ্চের সহায়তায় গ্রুপের সদস্যেরা এক
আদিবাসী প্রধান গ্রামে গিয়ে হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন ওঝাদের কেরামতি আর কিছুই নয়,
মানুষ বোকা বানানোর কৌশল মাত্র। দিন কয়েক আগে ওই গ্রুপে আসা একটি মর্মান্তিক
বার্তা নাড়িয়ে দেয় সদস্যদের। বার্তাটি পাঠান ওই গ্রুপের সদস্য তথা লাভপুরের পলসা
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অশোক মণ্ডল। ওই বার্তায় তিনি জানান,
তাঁর অজান্তে সুমন হেমব্রম নামে স্কুলেরই তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রের ওঝার কবলে
পড়ে মৃত্যু হয়েছে। ওই খবর পাওয়ার পরই গ্রুপের সদস্যেরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন,
মৃত ছাত্রের বাড়ি স্থানীয় খয়েরবুনি আদিবাসী পাড়ায়। তার বাবা আনন্দ হেমব্রম
পেশায় দিনমজুর। ২৭ নভেম্বর সুমনের সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হওয়ায় তাকে প্রথমে
স্থানীয় এক হাতুড়ের কাছে নিয়ে যান বাড়ির লোকেরা। ওই হাতুড়ে সুমনকে বোলপুর মহকুমা
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু, বাড়ির লোকেরা সেখানে
নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে স্থানীয় এক ওঝার কাছে নিয়ে যান। সেখানে রাতভোর ঝাড়ফুঁকের পরে
পর দিন সকালে মৃত্যু হয় সুমনের।
আদিবাসী প্রধান ওই
গ্রামে প্রায় ৪০টি পরিবারের বাস। অধিকাংশই দিনমজুর। পাড়ায় প্রায় ১০ জন মাধ্যমিক
এবং তিন জন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়ে রয়েছে। তা সত্বেও ওই গ্রামে ওঝা-গুণিনদের
প্রতি অন্ধ বিশ্বাস অব্যহত। অসুখ, বিসুখ হলে
স্বাস্থ্যকেন্দ্র-হাসপাতাল যাওয়ার পরিবর্তে অধিকাংশ আজও ওঝা-কবিরাজের কাছে ছোটেন।
ওই তথ্য জানার পরেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন গ্রুপের সদস্যরা। ওই গ্রুপে বিজ্ঞান মঞ্চ,
যুক্তিবাদী সংস্থা, শিল্পী, সাহিত্যিক-সহ বিভিন্ন
স্তরের মানুষ রয়েছেন। সকলেই ওই অন্ধবিশ্বাস দূর করার তাগিদ অনুভব করেন। সেই মতো
মঙ্গলবার (১৯/১২/২০১৭) গ্রুপের একটি দল পৌঁছে যায় গ্রামে। গ্রামবাসীকে দলের
সদস্যেরা হাতেকলমে দেখিয়ে দেন ওঝা-গুণিনরা কী ভাবে বোকা বানান। ওই গ্রুপ তথা জেলা
বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্য শুভাশিস গড়াই, সুশীল রায়,
সুকোমল শীলরা জানান, ওঝা বা গুণিনরা আসলে বিজ্ঞানকে নানা ভাবে কাজে
লাগিয়ে মানুষকে বোকা বানান। যজ্ঞের কাঠের ফাঁকে তুলোর মধ্যে পটাসিয়াম
পারম্যাঙ্গানেট লুকিয়ে রেখে উপর থেকে জলের নামে গ্লিসারিন ঢেলে দেন। তাতেই তাপ
উৎপাদক প্রক্রিয়ায় আগুন ধরে যায়। সরল মনের মানুষজন ধরেই নেন জল দিয়ে আগুন ধরাতে
পারে যে, সে নিশ্চয় অলৌকিক গুণের অধিকারী। একই ভাবে বিশেষ
ধরণের থালা পিঠে লাগিয়ে সাপ, কুকুর কিংবা বিড়ালের
বিষ নামোনো নিয়েও ওঝা-গুণিনরা লাগে তাক, না লাগে তুকের খেলা
করেন। কাঁধের সমতল অংশে বিশেষ ধরনের থালাটি টিপে ধরলে ভিতরের বাতাস বেরিয়ে যায়। আর
বাইরের পার্শ্বচাপে থালা পিঠে আটকে যায়। তারপর আস্তে আস্তে বাতাস ঢোকার সঙ্গে
সঙ্গে থালাও নেমে আসে। ওঝা–গুনিনরা তখন বিষ নামল বলে বাহবা কুড়োন। একই ভাবে এ
দিন দেখানো হয় কী করে আগুন মেখেও শরীর অক্ষত রাখা যায়। কী করে বামনহাটি,
আপাং-সহ বিভিন্ন উদ্ভিদের কাণ্ড ‘শিফাস নট’
নামে বিশেষ ধরণের ফাঁস দিয়ে মালা গাঁথা হলে তা আপনিই দিন দিন বেড়ে যায়। অথচ,
ওঝা-গুণিনরা জন্ডিস আক্রান্তের গলায় ‘টাইট’
করে ওই মালা পড়িয়ে দিয়ে যখন ঢিল হয়ে যায় তখন নিরাময় হয়েছে বলে দাবি করেন।
ওই সব সদস্যেরা মনে
করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা
আদিবাসী তথা পিছিয়ে পড়া মানুষজনের নাগালের বাইরে থেকে গিয়েছে। সেই সুযোগে ওঝা–গুণিনরা নানা রকম
ম্যাজিক দেখিয়ে ওই সব মানুষ জনের কাছে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছেন। সেই
সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে চলছে লাগে তাক, না লাগে তুকের খেলা।
কারণ, সাপ সহ অন্য জীবজন্তু কামড়ালে সব ক্ষেত্রে বিষ হয়
না। ওই সব ক্ষেত্রে ওঝার কেরামতি বাড়ে। আবার সুমনের মতো ঘটনাও ঘটে। বক্তব্যের
সত্যতা ধরা পড়েছে সুমনের বাবা আনন্দ হেমব্রম, মামা সলকু হেমব্রম,
মঞ্জুরানী হেমব্রম, গণেশ মুর্মুদের কথায়। তাঁরা জানান,
হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও সব সময় চিকিৎসা মেলে না। হয় রেফার করে দেওয়া হয়,
না হয় তো রোগ না সারতেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। একদিন না খাটলে দিন চলে না। তাই
বাধ্য হয়ে ওঝা-গুণিনের দ্বারস্থ হতে হয়। আনন্দবাবুর কথায়,
‘‘তবে ওরা যে আমাদের নিয়ে বুজরুকি করে তা বুঝতে পারলাম।’’
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা,
২০/১২/২০১৭।
No comments:
Post a Comment