১ লা জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে তৎকালীন উড়িষ্যা
রাজ্যের খোরসোয়া অঞ্চলে ৭,০০০ আদিবাসীর হত্যা – স্বাধীন ভারতের জালিয়ালানবাগ।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের মাত্র চার মাসের মধ্যে ঘটে যায় ১ লা জানুয়ারি, ১৯৪৮
সালে তৎকালীন উড়িষ্যা রাজ্যের খোরসোয়া অঞ্চলে ৭,০০০ আদিবাসীর হত্যা। পরাধীন ভারতে
ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের হাতে জালিয়ালানবাগ হত্যাকাণ্ড ঘটে, যেখানে সরকারি মতে ৩৭৯
মৃত ও ১,২০০ মানুষ আহত, বেসরকারি মতে প্রায় ১,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু
খোরসোয়ার হত্যাকাণ্ডে সরকারি মতে ৩৫ জন আদিবাসীর মারা যাবার কথা স্বীকার করা হয়,
বেসরকারি মতে প্রায় ৭,০০০ আদিবাসীর মারা যাবার কথা শোনা যায়। সেই দিন খোরসোয়া
বাজারে প্রায় ৫০,০০০ এর মতন আদিবাসীর জমায়েত হয়েছিল। সেই জমায়েতের ওপর নির্বিচারে
মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়েছিল উড়িষ্যা মিলিটারি পুলিশের ভারতীয় সেপাইরা।
ঘটনা ঘটার প্রায় ৫৫ বছর পরেও বেঁচেছিলেন সেইদিনে
আহত হওয়া দুই আদিবাসী – সাধুচরন বিরুয়া ও দশরথ মাঝি। তাদের মুখ থেকে খোরসোয়া
হত্যাকাণ্ডের অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
তৎকালীন সময়ে খোরসোয়া ও সরাইকেলা দুটি Princely State তথা পৃথক রাজ্য ছিল। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর খোরসোয়া ও সরাইকেলা
রাজ্য দুটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত হবার সিধান্ত নেয়।
কিন্তু এই দুটি রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তথা আদিবাসী জনগণ পার্শ্ববর্তী বিহার
রাজ্যে সামিল হতে চেয়েছিলেন। আদিবাসীদের এই দাবীকে সমর্থন জানিয়েছিল আদিবাসীদের
প্রভাবশালী সংগঠন “আদিবাসী মহাসভা”, আদিবাসী নেতা মারাং গমকে জয়পাল সিং মুন্ডা, খোরসোয়ার
রাজপরিবার, রাজা রামচন্দ্র সিং দেও, রাজকুমার প্রদীপ চন্দ্র সিং দেও ও রাজকুমার
ভুপেন্দ্র নারায়ণ সিং দেও। কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্র সরকার খোরসোয়া ও সরাইকেল
রাজ্য দুটির উড়িষ্যা রাজ্যেই বিলীন হবার জন্য চাপ দিয়েছিল।
১ লা জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে এই বিলীন প্রক্রিয়া
সম্পন্ন হত। এই বিলীন প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে ও খোরসোয়া ও সরাইকেলা রাজ্য দুটির
আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে পার্শ্ববর্তী বিহার রাজ্যে সামিল করার দাবীতে ১ লা
জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে খোরসোয়া বাজারে এক বিরাট জমায়েতের ডাক দিয়েছিল আদিবাসী
মহাসভা। প্রধান বক্তা হিসেবে হাজির থাকার কথা ছিল আদিবাসী মহাসভার সভাপতি মারং
গমকে জয়পাল সিং মুন্ডার। কিন্তু পুলিশ জয়পাল সিং মুন্ডাকে জনসভায় আসতে দেয়নি।
জনসভায় প্রায় ৫০,০০০ আদিবাসী জমায়েত হন এবং খোরসোয়া ও সরাইকেলা রাজ্য দুটির
আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে পার্শ্ববর্তী বিহার রাজ্যে সামিল করার দাবী জানাতে
থাকেন। আদিবাসীরা তাদের চিরাচরিত অস্ত্রশস্ত্র তির-ধনুক নিয়ে সামিল হয়েছিলেন।
আদিবাসীরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চল তথা জামশেদপুর, সিমদেগা, খুঁটি, তামাড়, চাইবাসা সহ
বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জমায়েত হয়েছিলেন। প্রচুর আদিবাসী মহিলা, শিশু ও বয়স্করাও এই
জমায়েতে সামিল হয়েছিলেন। সেই দিন সাপ্তাহিক হাট উপলখ্যে স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও
আদিবাসীরাও উপস্থিত ছিলেন। সব মিলিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে চরম উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল। অনেক
আদিবাসী সেই সময় খোরসোয়া ও সরাইকেলা রাজ্য দুটির উড়িষ্যা রাজ্যে বিলীন ও তার
প্রতিবাদে আদিবাসী মহাসভার আন্দোলনের বিষয়টি জানতেন না। সেই সময় মারাং গমকে জয়পাল
সিং মুন্ডা আদিবাসীদের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁকে শুধু এক ঝলক দেখবার জন্য
অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন।
তৎকালীন উড়িষ্যা সরকার চরম অসহিষ্ণুতার পরিচয়
দিয়েছিল। তাঁরা যে করেই হোক আদিবাসী মহাসভার জমায়েতকে বানচাল করার সিধান্ত
নিয়েছিল। সেই মত খোরসোয়া বাজারকে উড়িষ্যা মিলিটারি পুলিশ দিয়ে ছয়লাপ করে দেওয়া
হয়েছিল।
আদিবাসী মহাসভার জমায়েতে মারাং গমকে জয়পাল সিং
পৌঁছতে পারেননি। তাই আদিবাসী মহাসভার স্থানীয় নেতারাই জমায়েতের হাল ধরেন। জমায়েত
থেকে আদিবাসী মহাসভার এক প্রতিনিধিদল খোরসোয়া রাজবাড়িতে গিয়ে রাজার সামনে দাবিপত্র
পেশ করেন। খোরসোয়া রাজা আদিবাসীদের কথা শোনেন ও জানান যে তিনি অসহায়, তার হাতে
কিছু নেই। বিলীন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর বর্তমানে ক্ষমতা উড়িষ্যা সরকারের কাছে।
আদিবাসী মহাসভার প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে জমায়েতে বিষয়টি জানান। বিষয়টি জেনে আদিবাসী
জনতার মধ্যে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত আদিবাসীদের দেখে ঘাবড়ে গিয়ে উড়িষ্যা
মিলিটারি পুলিশ মেশিনগান থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। অপ্রস্তুত আদিবাসীরা কোনোরকম
প্রতিরোধ করতে পারেননি বা পালাতে পারেননি। অসহায়ের মতন আদিবাসীরা উড়িষ্যা মিলিটারি
পুলিশের মেশিনগানের গুলিতে খুন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকেন। দশরথ মাঝি সেই সময়
জামশেদপুরে শ্রমিকের কাজ করতেন। খোরসোয়া বাজারে জয়পাল সিং মুন্ডার উপস্থিত থাকার
কথা শুনে আদিবাসী মহাসভার জমায়েতে যাবার কথা ঠিক করেন। সেই দিন দশরথ মাঝি গুলি
বিদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু মৃত হবার ভান করে মাটিতে পড়ে থেকে নিজের প্রাণ
বাঁচিয়েছিলেন। ৫৫ বছর পর ২০০৩ সালে দশরথ মাঝির শরীর থেকে উড়িষ্যা পুলিশের গুলি বের
হয়।
উড়িষ্যা মিলিটারি পুলিশের গুলি চালানো বন্ধ হলে
দেখা যায় সারা মাঠ রক্তে লাল হয়ে গেছে, চারিদিকে আদিবাসীদের মৃতদেহের পাহাড়।
খোরসোয়া বাজারের পাশে এক কুয়ো ছিল। উড়িষ্যা মিলিটারি পুলিশ আদিবাসীদের মৃতদেহগুলি
সেই কুয়োয় ফেলতে শুরু করে। সেই সময় অনেক আদিবাসীই আহত হয়েও বেঁচে
ছিলেন। কিন্তু উড়িষ্যা মিলিটারি পুলিশ আহত আদিবাসীদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার বদলে
কুয়োতে ফেলতে শুরু করে। কুয়োটা
যখন আদিবাসীদের মৃতদেহে ভরে গেল, তখন বাকি আহত ও নিহত আদিবাসীদের দেহগুলি উড়িষ্যা
মিলিটারি পুলিশ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে যায়, সেখানে কিছু দেহ মাটিতে পুতে দেওয়া
হয়, কিছু মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাকি আদিবাসীদের দেহ জঙ্গলেই জীবজন্তুদের
খাওয়ার জন্য ফেলে আসা হয়। সেই সময় শীতকাল, অনেক আহত আদিবাসী শীতেই মারা যায়।
তৎকালীন বিহার সরকার ঘটনার খবর পেয়ে মেডিক্যাল
টিম পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উড়িষ্যা সরকার নীরব থেকে সেই প্রস্তাব খারিজ করে।
নিজেদের উদ্যোগে চাইবাসা ও জামশেদপুর থেকে কিছু ডাক্তার খোরসোয়া বাজারে পৌঁছে
আদিবাসীদের চিকিৎসা শুরু করেন।
৩ রা জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত
ইংরেজি স্টেটসম্যান সংবাদপত্রে ঘটনার খবর প্রকাশ হয়, সেখানে উড়িষ্যা সরকার মাত্র
৩৫ জন আদিবাসীর মারা যাবার কথা স্বীকার করেছিল। ঘটনার কথা প্রকাশ হতে খোরসোয়া ও
সরাইকেলা রাজ্য দুটির উড়িষ্যা রাজ্যে বিলীন হওয়া স্তগিত রাখা হয়। ১৮ মে, ১৯৪৮ সালে
খোরসোয়া ও সরাইকেলা রাজ্য দুটি বিহার রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করা হয়। মৃত ও আহত
আদিবাসীদের জন্য জয়পাল সিং একটা রিলিফ ফান্ড গঠন করেছিলেন। এই ঘটনা নিয়ে
পরবর্তীকালে প্রাত্তন সাংসদ ও রাজা পি কে দেব এক বই লিখেছিলেন “Memoir
Of A Bygone Era”
পরবর্তীকালে ২০১০ সালে খোরসোয়া বাজারে এক শহীদ
স্মারক গড়ে তোলা হয়। প্রতি বছর ১ লা জানুয়ারি আদিবাসী মানুষেরা সেখানে জমায়েত হয়ে
খুন হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
তথ্যসুত্র –
1. Unsung Heroes of
Jharkhand Movement by A.K. Sinha.
2. The Telegraph,
30.12.2010.
3. The Telegraph,
02.01.2006.
https://www.telegraphindia.com/1160102/jsp/jharkhand/story_61654.jsp
No comments:
Post a Comment