মোটেও ভালো
নেই দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ। দু’টাকা কিলো চালে রোজ
খাবার জোটে বটে, তবে দারিদ্র্য দূর হয় না। কালচিনির
আটিয়াবাড়ি চা-বাগানের শ্রমিক অমরজিত বাসফোরের কথায়, ‘শুধু
সস্তার চাল খেয়ে কি জীবন চলে? কাজই তো নেই আমাদের। চা-বাগানে
শ্রমিকের সংখ্যা যা ছিল, তাই আছে। কিন্তু গত ২০ বছরে আমাদের
মতো শ্রমিক পরিবারে প্রজন্ম তো অনেক বেড়েছে। তাঁদের কাজ কোথায়? কেউ জবাব দিতে পারে না।’
শ্রমিক
লাইনের আর এক বাসিন্দা সীতা রাই বললেন, ‘সমস্যা তো আমাদের
ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে। সরকার ওদের বিনে পয়সায় লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সাইকেল
দিয়েছে। কিন্তু লেখাপড়া শিখে ওরা তো চাকরি পাচ্ছে না। ওরা তো এখন আর পাঁচ জনের
মতো ভিনরাজ্যে গিয়ে শ্রমিকের কাজও করতে পারবে না।’
কালচিনির
রায়মাটাং হোক অথবা কুমারগ্রামের নিউ ল্যান্ডস চা বাগান, ভোটের
কথা বলতে গেলেই কাজ চান বাসিন্দারা। আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে এমন চা-বাগানের
সংখ্যা ৮১টি। যাতে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দুই লক্ষের বেশি। এর বাইরেও প্রচুর
অ-শ্রমিক রয়েছে চা-বাগানগুলিতে।
আলিপুরদুয়ার
লোকসভা নির্বাচনে এঁরা অন্যতম নীতি নির্ধারক। বাম আমলে তাদের দুর্জয় গড় ছিল
চা-বাগান। তৃণমূল জমানায় চা-বাগানে ট্রেড ইউনিয়নটাই প্রায় বিলুপ্ত। এখন লাল ঝান্ডা
হাতে আন্দোলনের বদলে কেউ মাথা ঠোকেন চা-বাগানের ভেতরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা হনুমান
মন্দিরে। আবার কোনও কোনও পরিবারের লেখাপড়া জানা আদিবাসী তরুণী সন্ধ্যায় সেজেগুজে
জাতীয় সড়কের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। একটু ভালো থাকার আকাঙ্খা, ভালো
প্রসাধন সামগ্রী কেনার খরচ জোগাড় করতে ওঁরা নাম লিখিয়েছেন ‘সেক্স
ট্রেড’-এ।
পাহাড়-জঙ্গলের
মাঝে সবুজ দেখতে যত সুন্দরই হোক না কেন, আদতে শ্রমিক মহল্লাগুলি যেন
এক-একটি ধূসর পৃথিবী। চা-বাগান পঞ্চায়েতের আওতায় আসার পর থেকে শ্রমিক মহল্লার
রাস্তা ঢালাই হয়েছে। কিন্তু বড়ই জীর্ণ শ্রমিক আবাসগুলি। বেশিরভাগ চা-বাগান মালিকরা
শ্রমিকদের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের দিকে ফিরেও তাকান না। চিকিৎসার কোনও পরিকাঠামো নেই।
সব চা-বাগানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎও নেই। পানীয় জলের হাহাকার রয়েছে বহু চা-বাগানে।
সংখ্যায় কম
হলেও ভোটের মুখে উদ্বেগ বাসা বেঁধেছে বনবস্তির ঘরে ঘরে। ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর
উৎসাহ ম্লান হয়ে যাচ্ছে ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হওয়ার আশঙ্কায়। আলিপুরদুয়ার লোকসভা
কেন্দ্রের আওতায় রয়েছেন ৫৫টি বনবস্তির প্রায় ৫৪ হাজার ভোটার। আপাতত স্থগিতাদেশ
দিলেও গোটা ভারতেই জঙ্গল এলাকায় বসবাসকারীদের উৎখাতের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম
কোর্ট। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পাম্পু বস্তির বাসিন্দা সরস্বতী লোহার বলেন, ‘আমরা
যাব কোথায়? আমাদের জন্ম-কর্ম-জীবিকা সবই তো এখানে। কোথায়
নিয়ে ফেলবে আমাদের?’ রাষ্ট্রীয় বনজীবী শ্রমজীবী মঞ্চের
আহ্বায়ক লাল সিং ভুজেল বলেন, ‘আমাদের নিয়ে অনেক তামাশা
হয়েছে। দরকারে গুলি খেয়ে মরব। কিন্তু জমি দেব না।’
পেট ভুখা নেই
কারও। কিন্তু জীবিকা,
অস্তিত্ব ইত্যাদি এ বারের বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই লোকসভা
কেন্দ্রে। এর সমাধানে স্পষ্ট কোনও জবাব নেই রাজনৈতিক দল অথবা নেতাদের কাছে। ভোট
বাজারে সবাই আশ্বাসের ঝুলি নিয়ে হাজির। তবে ওই প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে কতটা চিঁড়ে
ভিজবে, সেটাই এখন দেখার।
সৌজন্য
– এই সময়, পিনাকী চক্রবর্তী, ০৫/০৪/২০১৯।
No comments:
Post a Comment