ডান হাতে
উল্কি করা জোড়া পাতা দেখিয়ে রাগত স্বরে কিছু একটা বলে উঠলেন প্রৌঢ়। সব কথা বুঝতে
না পারলেও ‘এমজিআর’ শব্দটা কানে আটকে গেল। নাগাপত্তিনাম পুর
এলাকার সৈকত থেকে সাগরের পাড় ধরে প্রায় এক কিলোমিটার গেলেই নাম্বিয়ার নগর। সৈকতের
উপরই সারি দিয়ে রাখা রয়েছে মাছধরা নৌকো। মাথার উপর সূর্য জ্বলছে। তাপ থেকে বাঁচতে
বালিতে চারটে খুঁটি পুতে উপরে নারকেল পাতা দিয়ে ঢেকে মৎস্যজীবীদের অস্থায়ী বসার
জায়গা। সেখানেই দেখা হল ওই প্রৌঢ় এস রবিকুমারের সঙ্গে। গাড়ির চালক রাজার সাহায্য
নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম গত বছরের গাজা সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। রবিকুমার যেখানে
বসেছিলেন, তার পিছনেই তাঁর গ্রাম। তিনি গ্রামের দিকে আঙুল তুলে
বলেন, ‘‘গোটা গ্রামটাই চলে গিয়েছিল জলের তলায়। সমুদ্র সঙ্গে
করে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের সব কিছু।” জানা গেল, ক্ষতিপূরণ তেমন কিছুই পাননি। মাছ ধরা নৌকোর মালিকরা নৌকোর ক্ষয়ক্ষতির জন্য
পেয়েছিলেন ৩০ হাজার টাকা করে।
কথা
প্রসঙ্গেই উঠে আসে ভোটের কথা। এক গাল হেসে রবিকুমার বলেন ‘‘এআইএডিএমকে’’। অর্থাৎ তিনি এআইডিএমকে-কেই ভোট দেবেন। আর সেই কথা শুনেই কিছু বলেন
রবিকুমারের পাশে বসা যুবক সেলভা কুমার। আর তাতেই রীতিমত রেগে গিয়ে নিজের হাতের
উল্কি করা এইআইএডিএমকে-র নির্বাচনী প্রতীক জোড়া পাতা দেখিয়ে প্রতিবাদ করতে থাকেন
সেলভার কথার। একই গ্রামে বাড়ি সেলভার। কয়েক ঘণ্টা আগেই সমুদ্র থেকে ফিরেছেন প্রায়
দু’দিন পর। সেলভার কাছেই জানলাম, প্রায়
আট হাজার মানুষের বাস ওই গ্রামে। কিন্তু গ্রামে কোনও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই।
সেলভার বলেন, ‘‘আমাদের বাইরে থেকে জল কিনে খেতে হয়। সরকারি
কোনও জলের সরবরাহ নেই এখানে। মাটি খুড়লেও নোনা জল। তাই কেনা জলই ভরসা এই
মৎস্যজীবী পরিবারগুলির।”
নাগাপত্তিনম
শহরের স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া সেলভা এবং তাঁর সমবয়সী রাজকুমার মজা করেই
বলেন,
‘‘এখানে নৌকোর বিমা আছে। কিন্তু আমাদের কোনও জীবন বিমা নেই।”
শুধু নাম্বিয়ার নগর নয়, নাগাপত্তিনম জেলাতেই
রয়েছে মৎস্যজীবীদের এ রকম ৬৮টি গ্রাম। সবারই একই অবস্থা বা আরও খারাপ। তামিলনাড়ু
রাজ্যের গোটা পূর্ব দিকটাই সমুদ্র। কয়েক লাখ মৎস্যজীবীর বাস সেই সৈকতে। সেলভার
কাছে জানলাম, বালির উপর সারি দেওয়া নৌকোর মালিক তাঁরা নন।
মালিককে ভাড়া দিয়ে নৌকো নিয়ে তাঁরা মাছ ধরতে যান। সেলভা বলেন, ‘‘এই ফাইবারের মাছধরা নৌকো জলে নামাতে খরচ প্রায় তিন লাখ টাকা। তার মধ্যে
লাইসেন্স বানাতেই চলে যায় এক লাখ। কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে আমরা ঋণ পাই না।”
তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেলভারা অন্যের নৌকো ভাড়ায় নিয়ে নিজেদের
জীবন বাজি রেখে সারা মাসে কোনও মতে বাড়ি নিয়ে আসেন ১২-১৫ হাজার টাকা।
রবিকুমার বা
সেলভাদের আগের প্রজন্মের মানুষ সেই ‘উপেক্ষা’-র জীবন মেনে নিয়েই ভোট দেওয়ার অধিকার পাওয়া ইস্তক দেবতা জ্ঞানে সমর্থন
করছেন এআইডিএমকে-র প্রতিষ্ঠাতা এমজি রামচন্দ্রণ বা এমজিআর-কে। তাঁদের কাছে এমজিআর
এবং জোড়া পাতা প্রতীকই যথেষ্ট। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এর বিরোধী। সেলভার কথাতেই
ফুটে উঠছিল তাঁর ক্ষোভ, ‘‘নো বিজেপি, নো
আম্মা, বিজেপি ব্যাড।”
নাগাপত্তিনামের
সৈকত থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমঘাটের পাদদেশেও ক’দিন
আগেই শুনেছি একই কথা। আনাইমালাই পাহাড়ের কোলে প্রত্যন্ত গ্রাম ঝাওয়াড়ু এবং
পুডুরনাড়ু। ঝাওয়াড়ুর ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৪৫ হাজার ভোটার।
পুদুরনাড়ুর আরও ১৫ হাজার। গত চার দশকে এখানকার আদিবাসী জনজাতির মানুষদের কাছে
এমজিআর নামটাই যথেষ্ট। জোড়া পাতার প্রার্থীকে প্রচারেও আসতে হয় না এখানে। ৬৩
বছরের এ ঠুক্কনের কথায় এমজিআর ভগবানতুল্য। ১৯৭৭ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার
পরই রাজ্যের উত্তর পশ্চিম দিকের পার্বত্য এলাকার আদিবাসী জনজাতি মানুষদের বিনা
পয়সায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছিলেন এমজিআর। সরকারি আবাসিক স্কুল তৈরি করা হয়। সেখানে
বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন আদিবাসী জনজাতির ছাত্রছাত্রীরা। ঠুক্কনও তাঁদের
একজন। তাঁর কথায়, ‘‘এমজিআর যা করেছেন তাঁদের জন্য, সেই ঋণ শোধ করার একমাত্র সুযোগ মেলে ভোটের সময়।”
একই কথা
শুনেছিলাম তিরুভান্নামালাই থেকে আরণি যাওয়ার পথে নারকেল বিক্রেতা কুপ্পুস্বামীর
কাছেও। কিন্তু ঠুক্কন-কুপ্পুস্বামীর পরবর্তী প্রজন্ম এমজিআর নামে আর আটকে থাকতে
নারাজ। তামিলনাড়ু উপজাতি-জনজাতি সংগঠনের সহ-সভাপতি পি সম্মুগম। তিনি বলেন,‘‘ এই
প্রজন্ম বদলেছে। তাঁরা গোটা দেশের খবর রাখছে। তাঁরা বিচার করছে কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ।” তাই ঠুক্কনের নাতি, যে সবে এ বছরই ভোটাধিকার পেয়েছে, পরিবারের বড়দের
বোঝাতে চাইছে জোড়া পাতার সঙ্গী বিজেপির পদ্মফুল... নোটবন্দি থেকে জিএসটি —
সব হয়েছে বিজেপির আমলে... জোড়া পাতায় ভোট দিলে ফের আসবে সেই
পদ্মফুল... ক্ষতি হবে আম-আদমীর। ঠুক্কনের নাতির কথায় নাগাপত্তিনমের সেলভার
প্রতিফলন। তাঁদের আপত্তি বিজেপি নিয়ে। জোড়া পাতার জোটসঙ্গী বিজেপি। তাই এ বার
তাঁরা জোড়া পাতায় ভরসা করতে পারছেন না।
তবে কি
বিন্ধ্য পর্বতের বেড়া ডিঙিয়ে দাক্ষিণাত্যেও পরিবর্তনের হাওয়া? দ্রাবিড়
রাজনীতির স্বাভিমান ভেঙে দিল্লিতে চোখ নতুন প্রজন্মের। আনুগত্য বনাম বাস্তবতার
লড়াই এ বার গোটা তামিল প্রদেশে এনে দিয়েছে রাজনীতির লড়াইয়ে এক নতুন মাত্রা।
সৌজন্য
– আনন্দবাজার পত্রিকা, সিজার মণ্ডল, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯।
No comments:
Post a Comment