বাঁকুড়া
জেলার বিষ্ণুপুর ও জয়পুরের জঙ্গলে শিকার উৎসব ঘিরে আদিবাসীদের মধ্যে উন্মাদনা।
অন্যান্য
বছরের মতো এবারও শুক্রবার বিষ্ণুপুর ও জয়পুরের জঙ্গলে শিকার উৎসবে মাতলেন আদিবাসী
সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ। এদিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ছাড়াও ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে আদিবাসী
সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা শিকার উৎসবে শামিল হন। স্থানীয় অনেক বাসিন্দাও শিকার উৎসব
দেখতে জঙ্গলে ভিড় জমান। এদিন বিষ্ণুপুরে মন্দির দেখতে এসে ইংল্যাণ্ডের এক
পরিবেশপ্রেমী পর্যটক ওই উৎসবে যোগ দিতে বাসুদেবপুরে আসেন। বন দপ্তর সূত্রে জানা
গিয়েছে, এদিন বিষ্ণুপুরের বাসুদেবপুর এবং জয়পুরের কুচিয়াকোল
ও তাঁতিপুকুরের জঙ্গলে হাজার হাজার বাসিন্দা তির, ধনুক ও
বল্লম নিয়ে তিন এলাকার শাল জঙ্গল চষে বেড়ান। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার জঙ্গল
ঘন থাকায় ঝুলিতে শিকার ভালোই হয়েছে। তিন এলাকায় অন্তত ৩০টিরও বেশি বন্য শুয়োর
শিকার মিলেছে বলে জানা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে শিকারিরা অবশ্য বলেন, আমাদের কাছে পশু শিকার বড় নয়। শিকার উপলক্ষে উৎসবে আনন্দ উপভোগ করাই
মুখ্য।
বিষ্ণুপুর
পাঞ্চেতের ডিএফও নীলরতন পাণ্ডা বলেন, শিকার উৎসবে বন্যপ্রাণীর
ক্ষতি রুখতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকর্তাদের নিয়ে ইতিমধ্যে বৈঠক
করা হয়েছে। এদিন সকালেও শিকারিদের সতর্ক করে জঙ্গলে মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়া
জঙ্গলে সচেতনতামূলক ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও বেশ কিছু বন্য শুয়োর মারা
হয়েছে বলে খবর পেয়েছি। এবিষয়ে আরও সচেতনতা বাড়ানো হবে।
স্থানীয়
সূত্রে জানা গিয়েছে,
বিষ্ণুপুরের বাসুদেবপুর এবং জয়পুরের কুচিয়াকোল ও তাঁতিপুকুরে
বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ঘন শাল জঙ্গল রয়েছে। ওই জঙ্গলে বন্য শুয়ার, চিতল হরিণ, খরগোশ সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর অবাধ
বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাই ওই তিন জঙ্গলে আদিবাসীরা প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ৫ তারিখ
দল বেঁধে শিকারে আসেন। জঙ্গলে বন্যপ্রাণী শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও
আদিবাসীদের ভাবাবেগের কথা চিন্তা করে এই দিনে বন দপ্তর কড়া অবস্থান থেকে কিছুটা
সরে আসে। একইসঙ্গে আইনের বিষয়টি নিয়ে শিকারিদের সচেতন করার জন্য জঙ্গলে মাইকিং করা
হয়।
সিমলাপালের
কালাবতী গ্রামের বাসিন্দা মঙ্গল হাঁসদা বলেন, আমরা প্রায় ৬০ জন বাসিন্দা
গাড়িতে করে আগের দিন রাতে জঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ভোরের আলো ফুটতেই বনদেবীর
পুজো করে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করি। আগেরমতো প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়নি। প্রাচীনকাল
থেকেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিকার উৎসবের প্রচলন। আজও একইভাবে এই রীতি চলছে।
তবে আগের চেয়ে পুজোর রীতি অনেক বদলে গিয়েছে। প্রথা অনুযায়ী শিকারের পর জঙ্গলেই
রাত কাটাতে হয়। কিন্তু, এখন অধিকাংশই শিকারের পর বাড়ি ফিরে
যান। তবে শিকারের পর জঙ্গলে বনদেবীর সামনে মৃত জন্তু রেখে পুজো করা হয়। যে শিকারি
আগে জন্তুটিকে দেখেন, তাঁকে তার পা দেওয়া হয়। শিকারকে
কেন্দ্র করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের গ্রামও উৎসবের মেজাজে থাকে। অপেক্ষায় থাকেন
গ্রামের মহিলারা। সন্ধ্যার পর পুরুষ শিকারিরা গ্রামে ফিরলে মহিলারা তাঁদের পা
ধুইয়ে তেল মাখিয়ে বরণ করেন। তারপর শিকার করে আনা জন্তু এক জায়গায় রান্না করে
গ্রামের বাসিন্দারা সকলে একসঙ্গে খান। এরপর সারারাত ধরে নাচগান চলে। প্রাচীনকালের
শিকার উৎসবের এই রীতি আজও একইভাবে চলে আসছে।
বন দপ্তর
সূত্রে জানা গিয়েছে,
শিকার উৎসবে বন্যজন্তু নিধন রোধে কয়েকদিন আগে মহকুমা প্রশাসন ও বন
দপ্তর যৌথভাবে আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে। উৎসবে
শিকারের পরিবর্তে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু, আদিবাসীরা তাতে রাজি হননি। বহু বছরের পরম্পরা মেনে এবারও শিকার উৎসবে
হাজার হাজার বাসিন্দা শামিল হন। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শিকারিরা জঙ্গলে
প্রবেশ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেশ কিছু বন্য শুয়োর শিকার করা হয়। তাই বন দপ্তর
সচেতনতার উপরেই ভরসা করছে। বন্যপ্রাণ হত্যা হাইকোর্টের নির্দেশকে কার্যত বুড়ো
আঙুল দেখিয়ে শুক্রবার মহা ধুমধামে শিকার উৎসব পালন করলেন বাঁকুড়ার স্থানীয়
আদিবাসীরা। বিষ্ণুপুর ও জয়পুরের জঙ্গলে ঢুকে মারা হল বেশ কয়েকটি বুনো শুয়োর।
পাশাপাশি বন্যপ্রাণী হত্যা করে আইন লঙ্ঘন না করার আবেদন জানিয়ে মাইকে প্রচার চালাল
বন দপ্তর।
বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিভি নায়ার রাধাকৃষ্ণণ ও বিচারপতি
বিশ্বনাথ সমাদ্দারের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্য বনপালকে নির্দেশ দেয়, উৎসবের
নামে প্রাণী হত্যা বন্ধ করতেই হবে। তবু এদিন শিকার উৎসব ঘিরে দিনভর সরগরম রইল
বিষ্ণুপুরের বাসুদেবপুর জঙ্গল, জয়পুর এবং কুচিয়াকোলের জঙ্গল।
শিকার উৎসবকে ঘিরে এদিন রীতিমতো মেলার চেহারা নিয়েছিল বাসুদেবপুর চাতাল। বিভিন্ন
খাবার-সহ হরেক দোকানও পসরা সাজিয়ে বসেছিল সেখানে।
সৌজন্য –
বর্তমান ও এইসময়, ২০/০৪/২০১৯।
No comments:
Post a Comment