মেঘ সিঁদুরে
হলেই কন্ধমালের খ্রিস্টানদের আতঙ্ক। ১১ বছর আগের অগস্টে তিন দিন ধরে দাপিয়ে
বেড়িয়েছিল গেরুয়া বাহিনী। নুয়া শাহি সড়কের পাশে একটু উঁচু মাঠটায় সামিয়ানা
খাটিয়ে যজ্ঞ চলছে। রাতে হবে ‘দণ্ড নাচ’। চৈত্র
শেষের একুশ দিন কন্ধমাল জেলার এই ছোট্ট জনপদ পুরোদস্তুর শাকাহারী। হাটেবাজারে
মাছ-মাংস বিক্রি একদম নিষিদ্ধ। রাস্তাঘাটে গেরুয়ার আস্ফালন।
“এই
রকম এক-একটা যজ্ঞ হয়, আর আমরা আতঙ্কে থাকি,” বলছিলেন ফাদার মনোজ, যজ্ঞস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরে
সেন্ট পলস চার্চে বসে। “কখনও কখনও একটানা সাত দিন, আট দিন যজ্ঞ চলে। ২০০৮-এর পরেও এমনটা ছিল না। গত পাঁচ বছর ক্রমে ক্রমে
বেড়েছে।”
১১ বছর আগের অগস্টে
তিন দিন ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল গেরুয়া বাহিনী। দু’শোর বেশি গির্জা
ভেঙেছিল গোটা জেলায়। ৬০০ গ্রামে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাড়ি লুঠ করে পুড়িয়ে
দেওয়া হয়েছিল। প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৩৯ জনের। ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয়
নিয়েছিলেন ৫৪ হাজার মানুষ।
২০০৮-এর ২৩
আগস্ট তুমড়িবন্ধের আশ্রমে খুন হন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক ৮২ বছর বয়সী
স্বামী লক্ষ্মণানন্দ সরস্বতী। অভিযোগের তির ছিল মাওবাদীদের দিকে। কয়েক মাস পরে
তারা দায় স্বীকারও করেছিল। কিন্তু হিন্দু সংগঠনগুলি কাঠগড়ায় তুলল মিশনারিদের।
তাদের অভিযোগ,
ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণেই খুন হতে হয়েছে তাঁকে।
পরের দিন লক্ষ্মণানন্দের শেষকৃত্যে এলেন বিশ্বহিন্দু পরিষদের তৎকালীন প্রধান
প্রবীণ তোগাড়িয়া। দেহ নিয়ে প্রায় ১৫০ কিমি মিছিল হল কন্ধমালে। ১৯৬৮-এ কন্ধমালে আসার
পরের বছর প্রথম যেখানে আশ্রম খুলেছিলেন লক্ষ্মণানন্দ, সেই
চকাপাদে শেষকৃত্য হল তাঁর। আর ২৫ তারিখ সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল তাণ্ডব।
সে দিন সকালে
বাড়ির কাছেই দোকানে গিয়েছিলেন যমজ পরিছা। আধচেনা-অচেনা কতকগুলো মুখ আচমকা ঘিরে
ধরল তাঁকে। প্রথমে চড়থাপ্পড়। তার পর মাথায় পড়ল লোহার রডের বাড়ি। রক্তাক্ত
অবস্থাতেই কে যেন উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল তাঁকে। সেন্ট পলস চার্চে বসে এত
বছর পরেও যেন গলা কাঁপছিল পরিছার। “আমি খ্রিস্টান, কিন্তু আমার স্ত্রী হিন্দু। ভালবেসে নয়, দেখাশোনা
করেই বিয়ে আমাদের। আমার দুই ছেলে হিন্দু ধর্মই পালন করে। তার পরেও...।”
মাথায় বাড়ি
খেয়েই দুর্গতির অবসান হয়নি পরিছার। ঘণ্টাখানেক বাদে বাড়িতে চড়াও হল উন্মত্ত
জনতা। লোহার গ্রিল ভাঙা হল,
কাঠের দরজাও। মোটরবাইকটা পুড়িয়ে দেওয়া হল রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়ে।
বসার ঘর থেকে টেলিভিশনটা নিয়ে কে যেন পালাল। থানায় ফোন করে কোনও লাভ হয়নি। তাদের
সাফ কথা, আপন প্রাণ আপনি বাঁচা। পরিছা পরিবার তখন শোবার ঘরে
দরজা এঁটে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেই দরজাও যখন ভেঙে পড়ার মুখে, এমন সময় আচমকা পুলিশের উদয়। কাছেই এক হিন্দু বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এক
পাদ্রি। সেখানে হামলা হওয়ার পরে গৃহকর্তা প্রভাব খাটিয়ে পুলিশ আনান, বললেন পরিছা। তার পর টানা দু’বছর অবশ্য বালিগুড়া
মুখো হতে পারেননি পরিছারা। পালিয়ে ছিলেন ৩০০ কিলোমিটার দূরে ভুবনেশ্বরে। আর দশ বছর
পরেও শুরু করতে পারেননি বন্ধ হয়ে যাওয়া এনজিওটা।
যমজ পরিছা
তবু ভাগ্যবান। অস্মিতা দিগল তো স্বামীর মুখই আর দেখতে পাননি। ২৮ বছরের খ্রিস্টান
ধর্মপ্রচারক রাজেশ গিয়েছিলেন হায়দরাবাদে। চার বছরের মেয়ে আর দেড় বছরের ছেলেকে
নিয়ে বাট্টাগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন অস্মিতা। দাঙ্গা শুরু হতে আশ্রয় নেন
জঙ্গলে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরছিলেন রাজেশ। পথে পড়লেন দাঙ্গাকারীদের কবলে।
তাঁর ব্যাগ থেকে মিলল বাইবেল। সঙ্গী এক হিন্দু কিশোরের বয়ান অনুসারে নদীর ধারের
জমিতে গলা অবধি পুঁতে পিটিয়ে মারা হয়েছিল রাজেশকে। তার পর দেহটা সম্ভবত ভাসিয়ে
দেওয়া হয়।
বালিগুড়ার
এক কোণে সেলাই মেশিন সম্বল করে এখন দিনগুজরান করেন অস্মিতা। স্বামীর করুণ পরিণতির
কথা বলতে সাহস করেন না প্রতিবেশীদেরও। কন্ধমালের বাতাস জুড়ে অবিশ্বাসের গন্ধটা
বড়ই তীব্র।
ওড়িশার
রাজনীতিতে জোটভঙ্গও কন্ধমাল সূত্রেই। ২০০০ সালে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে
রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল তিন বছর আগে তৈরি হওয়া বিজু জনতা দল (বিজেডি)। দাঙ্গার
প্রায় এক বছর পরে,
ভোটের ঠিক মুখে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী নবীন
পট্টনায়ক। অনেকে বলেন, এনডিএ ছাড়ার ইচ্ছে বিশেষ ছিল না
নবীনের। কিন্তু যখন দেখলেন কন্ধমাল কাণ্ডের জেরে রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী হাওয়া,
তখনই মনস্থির করে ফেলেন।
এমনটা
বিশ্বাস করেন কন্ধমালের খ্রিস্টানদের বড় অংশও। তাঁদের প্রশ্ন, নইলে
তিন দিন ধরে কেন কার্যত হাত গুটিয়েছিল নবীনের পুলিশ? কেন
তথ্যপ্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক মামলা? বেকসুর
খালাস পেয়ে গিয়েছে একের পর এক অভিযুক্ত! শুধু কি তাই? জোরালো
ভাবে এ অভিযোগও রয়েছে যে দাঙ্গাকারীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, পুলিশ তিন দিন চোখ বুজে থাকবে, তার মধ্যে যা করার করে নাও। এই মডেলের
পরীক্ষা তো ৬ বছর আগেই দেখেছে দেশ, পশ্চিমপ্রান্তে।
বালিগুড়া
থেকে ১২ কিমি দূরে নুয়াগায় খ্রিস্টান সংগঠন জনবিকাশের দফতর। সামাজিক নানা প্রকল্প
নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনটিকে সন্দেহের চোখেই দেখেন হিন্দুত্ববাদীরা। দাঙ্গার প্রথম
দিনেই সেখানে চড়াও হয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ঘরে ঘরে আগুন জ্বালানো হয়েছিল। কাছের
দিব্যজ্যোতি প্যাস্টোরাল সেন্টার থেকে পালিয়ে আদিবাসী বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক
সন্ন্যাসিনী। সেখান থেকে তাঁকে টেনে নিয়ে আসা হয় জনবিকাশের পোড়া বাড়িতে। “এখানেই
ধর্ষণ করা হয়েছিল ওঁকে,” সিঁড়ির নীচের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন
ফাদার মনোজ। “অনেক লোকের সামনে। সেই ভিড়ে কিন্তু পুলিশও
ছিল!”
সৌজন্য –
আনন্দবাজার পত্রিকা, সৈকত বসু, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯।
No comments:
Post a Comment