Sunday, April 28, 2019

সার্বিক উন্নয়ন থেকে এখনও বহু দূরে আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা।


সুদিনের অপেক্ষায় বসে আছে আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা। কিছুটা উন্নয়ন হলেও প্রকৃতির আপন দেশে 'নেই'-এর তালিকা দীর্ঘ। ২ টাকা কেজির চাল পান না সবাই, সব জায়গায় নেই পরিস্রুত জল, শৌচাগার। ভোট এলেই ছোটে প্রতিশ্রুতির বান। কিন্তু, আদিবাসী অধ্যুষিত মহল্লা থেকে যায় তিমিরেই।
আউশগ্রাম শহর থেকে ১১ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত জঙ্গল এলাকা। শাল-পিয়ালের জঙ্গলের মধ্যে লাল মোরামের রাস্তা। এই রাস্তার ধারেই রয়েছে আদিবাসীদের গ্রাম। গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এক ফালি রাস্তা গ্রামের ভিতরে চলে গিয়েছে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আউশগ্রাম-১ ব্লকের ৫৮টি মৌজায় ১৫,৫৭৭ জন আদিবাসীর বাস। আউশগ্রাম-২ ব্লকের ১২০টি পাড়ায় থাকেন ২১,৭৫৯ জন আদিবাসী। আউশগ্রাম অঞ্চলের কুঁচিডাঙা, সুখাডাঙা, জরকাডাঙা, হরগরিয়া, ওয়ারিশপুর, দোখলগঞ্জ, অর্জুনপাড়া আদিবাসী অধ্যুষিত। এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা জনমজুরি, শালপাতা তৈরি, বাঁশের কাজ, কুঁচিকাঠির ঝাঁটা তৈরি ইত্যাদি।
সুখাডাঙা গ্রামে অধিকাংশ মানুষ এখনও সরকারি প্রকল্পের ঘর পাননি। গ্রামে অধিকাংশ স্থানে ঢালাই রাস্তা হয়নি। রয়েছে কয়েকটি হাতে গোনা শৌচাগার। শিল্পীর কার্ড পাননি অনেকে। স্থানীয় গ্রামবাসী কালো হাঁসদা বলেন, ‘আদিবাসীরা যেমন ছিল এখনও ঠিক তেমনই আছে। সরকার যতই বলুক এখানে উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তার ছিটেফোঁটা এসেছে আমাদের গ্রামে। অনেক পরিবার ২ টাকা কেজি দরে চাল-গমও পায় না।’
উন্নয়ন একেবারে হয়নি, তা নয়। তবে গতি অত্যন্ত ধীর। এ সব গ্রামে ঢুকলে মদের গন্ধ পাওয়া যেত, এখন আর তেমন পাওয়া যায় না। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়। সুখাডাঙার পাশের গ্রাম কুঁচিডাঙা গ্রামে নেই পরিস্রুত পানীয় জল, রাস্তা ও শৌচাগার। অথচ পানীয় জলের জন্য পঞ্চায়েতের তহবিল থেকে বছরে প্রায় কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করা হয়। গ্রামে একটা সাবমার্সিবল বসেছে, সেখান থেকে কবে জল মিলবে, তার প্রতীক্ষায় এলাকার মানুষ। ৯০টি আদিবাসী পরিবার বসবাস এখানে। বাধ্য হয়েই তাদের ব্যবহার করতে হয় পাতকুয়ো। গাছের পাতা এবং অন্যান্য আবর্জনা কুয়োর জলে মেশে। ফলে জল হয়ে পড়ে দূষিত। সেই জল পান করার পাশাপাশি ওই কুয়োর জলেই স্থানীয় বাসিন্দারা বাসন মাজেন, কাপড় কাচেন, স্নান করেন, এমনকি গবাদি পশুকেও স্নানও করান। সামাজিক সহায়তা প্রকল্পের ভাতা পান না স্থানীয় বাসিন্দারা। সকলের কাছে নেই ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড। বুদি সোরেন ও মোঙ্গলা মারডি বলেন, ‘পঞ্চায়েতের কোনও প্রতিনিধির দেখা মেলে না গ্রামে। অকেজো নলকূপের কথা পঞ্চায়েতে বারবার বলা হলেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে সমস্যার সুরাহা হয়নি।’ ভোট এলেই মেলে নয়া প্রতিশ্রুতি। কিন্তু, ভোট মিটে গেলেও বদলায় না কুঁচিডাঙা।
দিগনগর-২ পঞ্চায়েতের ঝাড়গরিয়া, যাদবগঞ্জ, বনপাড়া, মোলডাঙ্গা, দ্বারিয়াপুরের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার মানুষও খুব ভালো নেই। যাদবগঞ্জে এখনও রয়েছে কাঁচা রাস্তা, গ্রামে সবাই পাননি শিল্পী কার্ড। তবে জলের সমস্যা আর নেই যাদবগঞ্জে। এখানে অনেকে পেয়েছেন সরকারি ভাতা, আবাস যোজনার ঘর। স্থানীয় গ্রামবাসী সুফল সোরেন বলেন, ‘উন্নয়ন বলতে এখন আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, পড়াশোনা করছে। রোগ হলে হাসপাতালে গিয়ে ভালো ভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি। ১০০ দিনের কাজ পাচ্ছি। তবে অনেক কাজই বাকি।’
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে জঙ্গলবাসীদেরও। কাউকে ডাইনি অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা প্রায় নেই। তবে আদিবাসীরা এখনও সার্বিক উন্নয়ন থেকে দূরে। স্বাধীনতার কয়েক দশক পরেও। উৎসবে ধামসা-মাদলে মেতে ওঠে আউশগ্রামের জঙ্গলমহল। শিকারে বেরিয়ে পড়ে তীর-ধনুক হাতে। নিশানায় থাকে খটাস, খরগোশ, বনমোরগ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নির্বাচন আদিবাসীদের নাড়া দেয় না। অনেক কিছু ছাড়া বেঁচে থাকাটাই তাঁদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে!
সৌজন্য – এইসময়, প্রত্যুষ চক্রবর্তী, ১৪/০৪/২০১৯।

No comments:

Post a Comment