গোটা ভারতের চোখ আজ মুম্বইয়ের দিকে। চোখ টানছে এক সুদীর্ঘ রক্তাভ
মিছিল। ক্রোশ ক্রোশ পথ পেরিয়ে মহারাষ্ট্রের খরাক্লিষ্ট, ফলনবঞ্চিত প্রান্তগুলো থেকে
শত-সহস্র কৃষক হাঁটছেন মুম্বইয়ের দিকে, ক্রমশ ভরে উঠছে মুম্বই, রাস্তাঘাট-মাঠময়দানে
স্রোতের মতো ঢুকছে কৃষিজীবী-আদিবাসী-ভূমিহারা মানুষের ঢল।
বামপন্থী কৃষক সংগঠনের উদ্যোগেই মূলত এই বিপুল জমায়েত মুম্বইয়ে।
দেশে বাম মতাদর্শের প্রবাহে যখন ভাটার টান, আড়াই দশকের পুরনো দুর্গও যখন ধসে পড়ছে
শোচনীয় ভাবে, তখন মহারাষ্ট্রের বুকে এত বড় লাল মিছিল! আশ্চর্য হতেই হয়। কিন্তু বিষয়টা
আশ্চর্যজনক নয় একেবারেই। এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল বরং।
কৃষকদের মিছিল-জমায়েত বা বিক্ষোভ মহারাষ্ট্রে প্রথম হচ্ছে, এমন
নয়। কখনও রাজস্থান, কখনও মধ্যপ্রদেশ, কখনও হরিয়ানা, কখনও তামিলনাড়ু এই বিক্ষোভ দেখেছে।
এমনকী মহারাষ্ট্র তথা মুম্বইও বিপুল কৃষক জমায়েতের সাক্ষী হয়েছে। সর্বত্র সংগঠকরা যে
একই ছিলেন, তা নয়। বিভিন্ন সংগঠনের পতাকার তলায় সমবেত হয়েছেন কৃষকরা বিভিন্ন এলাকায়।
কিন্তু লক্ষ্যটা সর্বত্র একই।
ক্রমে ক্রমে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে এ দেশের কৃষকের, ক্রমশ আরও প্রান্তিক
হয়ে পড়েছেন তাঁরা। কোথাও ঋণভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন, কোথাও খরার দাপটে হতাশ হয়ে পড়েছেন,
কোথাও ফসলের দাম না পেয়ে মাঠেই ফসল নষ্ট করে দিয়েছেন, কোথাও ব্যর্থ মনোরথে আত্মঘাতী
হয়েছেন। এমন এক পরিস্থিতি যে দিনের পর দিন চলতে পারে না, সে বলাই বাহুল্য। এ রকম পরিস্থিতিতে
দেশ জু়ড়ে কৃষক যে সংগঠিত হবেনই, তা অত্যন্ত প্রত্যাশিত। মুম্বইয়ে বিরাট কৃষক মিছিল
ঢুকতে দেখে কারও মনে হতে পারে, অপ্রত্যাশিত দ্রুততায় সংগঠিত হয়ে গিয়েছেন কৃষকরা। কিন্তু
বাস্তবে এই সংগঠিত কৃষক মিছিল খুব অপ্রত্যাশিত নয়। ভারত জুড়েই কৃষকদের পরিস্থিতি এখন
যে রকম, তাতে এই ছবিটাই প্রত্যাশিত ছিল।
মহারাষ্ট্রে বামেদের সংগঠন যে অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী তা
কিন্তু নয়। রাজ্যে এখন ক্ষমতাসীন বিজেপি-শিবসেনা জোট। প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে অত্যন্ত
সবল উপস্থিতি কংগ্রেসের। রয়েছেন কৃষি তালুকের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা শরদ পওয়ার। মহারাষ্ট্রের
রাজনীতির এই মূল ধারাগুলির বাইরে বেরিয়ে কৃষকরা দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য বিপুল সংখ্যায়
সামিল হলেন বামেদের পতাকার তলায়। এই ছবি চমকে না দিয়ে যায় কোথায়।
কতটা দুর্দশায় রয়েছেন কৃষক, কতটা অবিলম্বে তার পাশে দাঁড়াতে
হবে, কতটা তৎপরতার সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে কৃষকের দুর্দশা ঘোচানোর অভিযান শুরু করতে হবে,
প্রশাসন তা বুঝতে পারছে কি? মুম্বইয়ে আছড়ে প়ড়া এই বিপুল কৃষক বিক্ষোভকে দেখে আজ
চমকে যেতে হচ্ছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে কৃষকরা এত সংগঠিত হয়ে উঠেছেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
কিন্তু এই মুহূর্তে যদি কৃষকের অবস্থার উন্নতির জন্য বিশেষ কোনও নীতি না নেয় সরকার,
তা হলে অদূর ভবিষ্যতেই আরও অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহের জন্য প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।
প্লাবনের মতো মুম্বইতে ঢুকতে থাকা রক্তাভ মিছিলটাকে দেখে শাসকের বোঝা উচিত দিগন্তে
জমে উঠছে রক্তাভ মেঘ। অবিলম্বে উপযুক্ত পদক্ষেপ না করা হলে অর্থাৎ অবিলম্বে কৃষকের
সুরাহার পথ খোঁজা শুরু না হলে এই সিদুঁরে মেঘ আরও গাঢ় হবে। গাঢ় সিদুঁরে মেঘ বিপদেরই
বার্তাবহ। অপ্রত্যাশিত ভাবে কোনও গভীরতর বিপদ সামনে এসে পড়লে, সামলানো খুব সহজ হবে
কি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করে দিক সরকার।
দাবি এক গুচ্ছ। কৃষকদের
সম্পূর্ণ ঋণ মকুব, ফসলের ন্যায্য দাম, লাঙল যার-জমি তার, গরিব কৃষক ও ক্ষেত মজুরদের
জন্য পেনশন থেকে আদিবাসীদের অরণ্যের জমির উপরে অধিকারের মতো দাবি। সেই দাবি নিয়েই অসহ্য
গরম উপেক্ষা করে ছ’দিন ধরে মিছিল করছেন অসংখ্য কৃষক।
সংখ্যাটা ইতিমধ্যেই ছুঁয়েছে ৩৫ হাজারে। উদ্যোক্তাদের অবশ্য দাবি,
সংখ্যাটা ৩৫ হাজার থেকে পেরিয়ে ৫০ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। ১৮০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রবিবার
মাঝরাতেই মুম্বই পৌঁছল কৃষকদের সেই লাল মিছিল। নিজেদের দাবি মেটাতে সোমবার সকাল ৯টা
থেকেই মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভবন ঘেরাও করবেন কৃষকেরা। তবে তার আগে থেকে শুরু হতে পারে
এই মিছিল।
বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রে এই কৃষক আন্দোলনকে ঘিরে চিন্তার ভাঁজ
শাসক শিবিরের অন্দরে। মহারাষ্ট্রের কৃষক সভার উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলনে
সমর্থন জানিয়েছেন শিবসেনা, এনসিপি-র মতো দল। রবিবার সকালেই কৃষকদের সঙ্গে দেখা করেছেন
শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের ছেলে আদিত্য। নাসিকের এক সভায় কেন্দ্র ও রাজ্যের কৃষক-বিরোধী
সরকারকে ছুড়ে ফেলার ডাক দিয়েছেন এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার। আলোচনা শুরু হয়েছে সঙ্ঘ
পরিবারের অন্দরেও। ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারাও মানছেন যে, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান,
মহারাষ্ট্রের মতো একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে কৃষক আন্দোলন শুভ সঙ্কেত নয়।
রবিবার সকালে ঠাণে-মুম্বই সীমানা। তার পরে সিয়নের কে জে সোমাইয়া
ময়দান। ১৮০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ৩৫ হাজার কৃষকের লাল মিছিল পৌঁছে গেল মুম্বই। মহারাষ্ট্রে
সিপিএমের কৃষক সভার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কৃষক-খেতমজুর-আদিবাসীদের আন্দোলনে সামিল হতে
ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। বিষয়টি নিয়ে সঙ্ঘও সরব হওয়ায় কপালে ভাঁজ বেড়েছে
মহারাষ্ট্র ও কেন্দ্রের বিজেপি নেতাদের। আগামিকাল কৃষক নেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী
দেবেন্দ্র ফডণবীস।
রবিবার মুম্বইয়ে বিপুল অভ্যর্থনা পেয়েছেন মিছিলে হাঁটা কৃষকেরা।
খাবার, জল নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ছাত্রেরা। কোথাও কোথাও ফুটব্রিজ থেকে ছোড়া হয়েছে
ফুল। রাতে আজাদ ময়দানে যাওয়ার কথা বিক্ষোভকারীদের। সোমবার মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভবন
ঘেরাও করতে চান আন্দোলনকারীরা। কৃষক সভার সর্বভারতীয় সভাপতি অশোক ধাওলে জানিয়েছেন,
মুম্বইবাসীকে অসুবিধেয় ফেলা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। পরীক্ষার্থীদের অসুবিধে যাতে না হয়,
সে জন্য সকাল এগারোটার পরে তাঁদের সভা শুরু হবে।
কৃষক নেতৃত্বের দাবি, তাঁদের মিছিলে বিপুল সংখ্যক কৃষক-আদিবাসীর
উপস্থিতি সরকারকে নড়ে বসতে বাধ্য করেছে। কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লার
বক্তব্য, বিজেপি সরকার ঋণ মকুব নিয়ে হইচই করেছে। কিন্তু কৃষকেরা কেন ঋণ শোধ করতে পারছেন
না, তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করেনি। কৃষক নেতৃত্বের বক্তব্য, ফসলের ন্যূনতম দাম হিসেবে
চাষের খরচের দেড় গুণ অর্থ দেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। কিন্তু চাষের পুরো খরচ কী,
তা নিয়ে তিন ধরনের মত রয়েছে। প্রথম মত অনুযায়ী, কেবল চাষ করার খরচ। দ্বিতীয় মত হল,
চাষ করা ও কৃষকের পরিবারের অন্যদের শ্রমদানের খরচ। তৃতীয় মত, ওই দুই খরচের সঙ্গে যোগ
করতে হবে ভূমিহীন কৃষকের জমি নেওয়ার খরচ। কৃষক নেতাদের মতে, এই তৃতীয় মত অনুযায়ীই চাষের
খরচের সংজ্ঞা স্থির করা উচিত। সেই খরচের দেড় গুণ অর্থ পেলে তবেই কৃষকের পক্ষে ঋণের
জাল থেকে বেরনো সম্ভব। গত সপ্তাহে চাষের খরচের সংজ্ঞা স্থির করার কাজ শুরু করেছে নীতি
আয়োগ। কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রও যে নড়েচড়ে বসেছে, এটা তারই প্রমাণ বলে মত রাজনীতিকদের।
বিক্ষোভকারী কৃষকদের সুরে সুর মেলাতে দেখা গিয়েছে অনেক নেতাকেই।
ওই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে শিবসেনা, এনসিপি-র মতো দল। আজ সকালে কৃষকদের সঙ্গে দেখা
করেন শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের ছেলে আদিত্য।
অন্য দিকে নাসিকের এক সভায় কেন্দ্র ও রাজ্যের কৃষক-বিরোধী সরকারকে
ছুড়ে ফেলার ডাক দিয়েছেন এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার। আলোচনা শুরু হয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের
অন্দরেও। নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে সঙ্ঘ প্রধান ভাইয়াজি জোশী বলেন, ‘‘কৃষকদের সমস্যা নিয়ে
কোনও সরকার উদাসীন থাকতে পারে না।’’
ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারা মানছেন, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান,
মহারাষ্ট্রের মতো একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে কৃষক আন্দোলন শুভ সঙ্কেত নয়। আর
বামপন্থী নেতাদের একাংশের মতে, কার সঙ্গে জোট হবে, তা নিয়ে বিতর্কে জড়ান সিপিএমের
শীর্ষ নেতারা। কিন্তু সঠিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুললে যে অনেকেই পাশে দাঁড়াতে
বাধ্য হয়, তা প্রমাণ করেছে মহারাষ্ট্রও।
কাঁধে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে কাতারে কাতারে কৃষক
হেঁটে আসছেন মুম্বইয়ের দিকে। সংখ্যাটা ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার ছাপিয়ে গিয়েছে। ঋণ মকুব,
ফসলের ন্যায্য দাম, লাঙল যার, জমি তার থেকে আদিবাসীদের অরণ্যের জমির উপরে অধিকারের
মতো একগুচ্ছ দাবি নিয়ে ৬ মার্চ থেকে পথ হেঁটেছেন ওই কৃষকরা। কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের
দূরত্ব যতটা, প্রায় ততটা দূরত্ব পায়ে হেঁটে এসে সোমবার তাঁরা ঘেরাও করবেন মহারাষ্ট্রের
বিধানসভা ভবন।
ত্রিপুরার ২৫ বছরের দুর্গে ধস নামার পরে এ দেশে বামেরা যখন রীতিমতো
কোণঠাসা, তখন বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রেই সিপিএমের কৃষক সভার ডাকে এ হেন আন্দোলন বিজেপি-র
‘গড়’ মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডণবীসের সরকারকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সোমবার মুম্বইতে
আজাদ ময়দানের কাছেই কৃষকদের পদযাত্রা আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য প্রশাসন।
কিন্তু যে ভাবে চাষিরা কৃষক সভার ঝান্ডা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন,
তাতে উদ্বিগ্ন বিজেপি নেতৃত্ব। কৃষক সভার মহারাষ্ট্র রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক অজিত
নাওয়ালে বলেছেন, ‘‘হেঁটে আসা কৃষকদের সংখ্যাটা ৬০ হাজারও ছাপিয়ে যেতে পারে।’’ কৃষক
নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে মন্ত্রী গিরীশ মহাজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র
ফডণবীশ।
বুলেট-ট্রেন-সুপার হাইওয়ের মতো প্রকল্প করে বিজেপি সরকার চমক
দিতে চাইছিল। সেই প্রকল্পের নামেই জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় চাষিরা পথে নেমেছেন।
মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফডণবীসের সরকার আগেই ৩৬ হাজার কোটি টাকার
ঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিন্তু কৃষক সভার যুগ্ম সম্পাদক বিজু কৃষ্ণনের কথায়,
‘‘সরকার এমন সব শর্ত রেখেছে যে ঋণের খুব সামান্য টাকাই মকুব হবে। প্রধানমন্ত্রী ঘটা
করে ফসল বিমা যোজনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলেও ক্ষতিপূরণ
মিলছে না। বুলেট ট্রেন-সুপার হাইওয়ের নামে আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।’’
কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লার বক্তব্য, তাঁদের উদ্যোগে
রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে আন্দোলনে সাফল্য মিলেছে। এ বার মহারাষ্ট্রে আন্দোলনকে সমর্থন
করতে বাধ্য হয়েছে বিরোধী দলগুলি। কৃষক সভার এই বিক্ষোভ সমাবেশকে সমর্থন করেছে মহারাষ্ট্র
প্রদেশ কংগ্রেস ও শিবসেনা।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা।
No comments:
Post a Comment