Sunday, March 11, 2018

ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার। তাঁর হাত ধরেই আন্নাদুরাই, করুণানিধিদের উত্থান।


সৌজন্য - আনন্দবাজার পত্রিকা, গৌতম চক্রবর্তী, ১১/০৩/২০১৮।

ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার। মূর্তি ভাঙা কাকে বলে, জানতেন তিনিতাঁর হাত ধরেই আন্নাদুরাই, করুণানিধিদের উত্থান।

সাদা দাড়ি তখন বক্তৃতার মাঝে রীতিমত উত্তেজিত, ‘‘এই তো, আমি নিজে ঠাকুরের মূর্তি ভাঙছি। দেখুন, আমার কিছু হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়,’’ — সেই জনসমাবেশেই হাতে তুলে পটপট করে মাটির গণেশটি ভেঙে দিলেন তিনি।
ইরোড বেঙ্কট রামস্বামী নাইকার এই ভাবেই আগুনঝরা বক্তৃতা দেন, ‘‘ধরুন, আপনার হাতে একটা লাঠি। হঠাৎ দেখলেন, সামনে দুটো জিনিস। এক দিকে সাপ, আর এক দিকে এক ব্রাহ্মণ। কাকে আগে মারবেন, বলার দরকার নেই। ব্রাহ্মণ সাপের চেয়েও ধূর্ত, ওকেই আগে নিকেশ করতে হবে।”
তামিলনাড়ুর ইরোড অঞ্চলের সন্তান বেঙ্কট জাতিতে বালিজা বা বৈশ্য। ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। ১৯০৪ সালে কাশীতে বিশ্বনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৫। রাস্তায় অজস্র ভিক্ষুক, বিধবা। দাহসংস্কারের বালাই না রেখে মণিকর্ণিকা ঘাটে চিতা থেকে আধপোড়া দেহগুলি টান মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেঙ্কটের গা রাগে রিরি করে ওঠে। এক দুপুরে বেশ খিদে, বেঙ্কট গেলেন অন্নসত্রে। সেখানে বিনা পয়সায় খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু অভুক্ত বেঙ্কটকে উঠে আসতে হল। অন্নসত্র শুধুই দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জন্য। দোকান থেকে ঝট করে একটা পইতে কিনে ফেললেন বেঙ্কট। তার পর সেই পইতে জড়িয়ে এক মন্দিরে। সেখানেও আছে অন্নসত্র, কিছু দানাপানি অন্তত জুটবে। কিন্তু মন্দিরের প্রহরী তাকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় বের করে দিল। পইতে, উড়ুনি সত্ত্বেও গোঁফই বেঙ্কটকে ধরিয়ে দিয়েছে। তামিল ব্রাহ্মণ আবার গোঁফ রাখে না কি? বেঙ্কট রামস্বামীর এত দিন তাও কিঞ্চিৎ ঈশ্বরবিশ্বাস ছিল, এই ঘটনার পরে তা পুরোদস্তুর চুলোয় গেল।
তামিলনাড়ু বা তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ফেরার পর বেঙ্কটকে একটা প্রস্তাব দিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি। কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব। বেঙ্কটও মনে মনে এমনটাই চাইছিলেন। খাদি, অসহযোগ, মদ্যপান নিবারণ, কংগ্রেসের সব কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। সেটা ১৯১৯ সাল। ইরোড শহরে তাঁর বাগিচায় প্রায় ৫০০ তালগাছ ছিল, তা থেকে তাড়ি তৈরি হত। গাঁধীশিষ্য বেঙ্কট সব কটা গাছই কেটে দিলেন।
বেঙ্কটের খ্যাতি আরও বাড়ল ত্রিবাঙ্কুর কাণ্ডের পর। ওই দেশীয় রাজ্যটি তখন তামিলনাড়ুর থেকেও ঘোর ব্রাহ্মণ্যবাদী। প্রাসাদের মন্দিরে উৎসব, একটা রাস্তা ‘ইজাভাবা অব্রাহ্মণদের জন্য সে দিন পুরোপুরি বন্ধ। কংগ্রেস ঘটনাটা হাতে নিল, বেঙ্কট সেখানে নেতৃত্ব দিতে হাজির। বক্তৃতা, জেল। তাঁকে ত্রিবাঙ্কুর ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হল। সত্যাগ্রহী সেই নির্দেশও মানলেন না। শেষ অবধি রাজপ্রাসাদ নতি স্বীকার করল। অব্রাহ্মণদের জন্য খুলে দেওয়া হল মন্দিরের দরজা।
ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধিতা তাঁর সারা জীবনে। তিরুনালভেলির কাছে গাঁধী-শিষ্যরা এক গুরুকুল আশ্রম চালাতেন। জানা গেল, সেখানে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ ছাত্রদের খাওয়ার বন্দোবস্ত আলাদা। বেঙ্কট ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। ওই গুরুকুলকে তামিলনাড়ু কংগ্রেস ১০ হাজার টাকা দান করবে কথা দিয়েছিল। কং‌গ্রেসের তৎকালীন সম্পাদক হিসেবে বেঙ্কট টাকা আটকে রাখলেন। কিন্তু যুগ্ম সম্পাদক ব্রাহ্মণ, তিনি টাকাটা ছেড়ে দিলেন। গাঁধীর দলের সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন হল বেঙ্কটের। চলে এলেন উলটো দিকে, জাস্টিস পার্টিতে। উত্তর ভারতও কি কম জাতিদ্বেষী? ত্রিবাঙ্কুরে অব্রাহ্মণদের জন্য মন্দিরের দরজা খোলার সাফল্যমণ্ডিত আন্দোলন ‘ইয়ং ইন্ডিয়াকাগজেও ছেপে বেরিয়েছিল, সেখানে বেঙ্কটের উল্লেখ ছিল না।
বেঙ্কটকে এখন অবশ্য সবাই অন্য নামে চেনে। নিজের জাতি-পরিচয় ‘নাইকার আর লেখেন না তিনি। সবাই পেরিয়ার নামেই তাঁকে চেনে। ‘দেখান, ব্রাহ্মণদের প্রতি আপনাদের ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের হোটেলে খেতে যাবেন না। ওদের নির্বাসন দিন।
এত উত্তপ্ত বক্তৃতা, কিন্তু ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে মারধর চলত না। শুধু তুতিকোরিনে কিছু গুন্ডা এক বার কিছু ব্রাহ্মণের টিকি কেটে, পইতে ছিঁড়ে দিয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পেরিয়ারের নাস্তিকতা আসলে জাতিভেদ-প্রথা ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ। মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টাল স্টাডিজ-এর সমাজবিজ্ঞানী এ আর বেঙ্কটচলপতি এক বার বলেছিলেন, ‘‘নাস্তিকতাকে পেরিয়ারের মূল বক্তব্য ভাবলে ভুল করবেন। তামিলনাড়ুর সমাজে তখন নবজাগরণ ঘটেনি। ব্রাহ্মণরা সংখ্যায় অল্প, কিন্তু জাতিভেদের সুযোগ নিয়ে ছড়ি ঘোরাত। চাকরিবাকরি বেশির ভাগ ওঁদেরই হাতে। পেরিয়ার এই সমাজটার গণতন্ত্রীকরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন।”
পেরিয়ার কখনও তাঁর শ্রোতাদের মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহ দুরমুশ করার ডাক দেননি। তাঁদের পরিবার ইরোডে এক মন্দিরের ট্রাস্টি ছিল। সেখানে এক দিনের জন্যও পুজো বন্ধ হয়নি। পরিষ্কার বলেছিলেন, তফসিলি জাতি, জনজাতি ও দলিতরাও অব্রাহ্মণদের সঙ্গে সমান অধিকার পাবে। অম্বেডকরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুত্বের। এমনকী, রাজাগোপালাচারির সঙ্গেও। দুজনে ভিন্ন দলে, কিন্তু শ্রদ্ধা অটুট। রাজাগোপালাচারি তখন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে নালিশ করা হল, পেরিয়ার রাস্তায় বিগ্রহ ভেঙে লোক খেপাচ্ছেন। রাজাগোপালাচারি বলেছিলেন, ‘‘সে তো আলওয়ার সাধুরাও ভাঙতেন।” দক্ষিণ ভারতে একদা বৈষ্ণব আলওয়ার বনাম শৈব লিঙ্গায়েতদের মধ্যে ঝামেলা লেগেই থাকত। রাজাগোপালাচারির ইঙ্গিত সে দিকেই।
নাস্তিকতার পাশাপাশিই তিনি এনেছিলেন তামিল স্বাভিমান। গীতা বা রামায়ণ-মহাভারত নয়, চোল রাজত্বের সেকুলার কবিতা ‘তিরুক্কুরালই দ্রাবিড় গর্বের প্রতীক তাঁর কাছে। এক ভক্ত এক বার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘গীতার বিরুদ্ধে কী বলবেন? বলছে এক গোপালক, শুনছে ক্ষত্রিয়। সেটা ব্যাসদেব নামে যে লিখছে, ধীবর রমণীর সন্তান।” পেরিয়ারের উত্তর, ‘‘আমি তোমার মতো পড়ুয়াদের কথা বলছি না। পুরো সমাজটাকে জাগাতে চাইছি।”
মেয়েদের বলেছিলেন, ‘‘বিয়ের সময় স্বামী আপনাকে যে থালি (মঙ্গলসূত্র) পরিয়ে দেন, সেটিও দাসত্বের প্রতীক।”
একটা সময় রাজনীতি ছেড়ে পুরোদস্তুর সামাজিক কাজে, কিন্তু পেরিয়ারের শিষ্য আন্নাদুরাই, করুণানিধি, এম জি রামচন্দ্রনরাই তামিল রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। স্বাধীন মেয়ের কথা না বললে কন্নড় ব্রাহ্মণ জয়ললিতাই বা কী ভাবে উঠে আসতেন তামিল জনসমাজে?
আজকের কালাপাহাড়দের সীমাবদ্ধতা এখানেই। পেরিয়ারের রাজনৈতিক দর্শন যে আলাদা, তাঁরা খেয়াল করেন না। তাঁদের কাছে পেরিয়ার থেকে লেনিন, সবাই পবিত্র দেবমূর্তি। এক পোঁচ রং চাপিয়ে, যেন-তেন-প্রকারেণ ভেঙে দিলেই হল! এই গর্বান্ধতাই আশু বিপদ।

No comments:

Post a Comment