পুঁটলিতে রুটি-আচার বেঁধে নিয়ে মিছিলে যোগ
দেওয়া বৃদ্ধটি বলছেন, “যত কষ্টই হোক না কেন, আমাকে যেতেই হবে।’’ মানুষটি মহারাষ্ট্রের
নাসিক থেকে মুম্বই পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার কৃষক অভিযানের এক জন। অভিযানের সংগঠক সিপিআই(এম)-ঘনিষ্ঠ
অখিল ভারতীয় কিসান সভা। যে রাজ্যে বামপন্থীদের সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব প্রায় নেই, সেখানে
তিরিশ-চল্লিশ হাজার কৃষক বামপন্থী পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় নামছেন। দাবি ও সংগঠন এতটাই
প্রবল যে, কৃষকদের অসন্তোষ দূর করার জন্য দ্রুত কিছু কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মহারাষ্ট্রের
বিজেপি সরকারের কপালে দুঃখ আছে। যে আন্দোলন সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয় তা নিয়ে সংগঠক
হিসাবে বামপন্থীদের গর্ব করার কারণ নিশ্চয় আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বোধহয় আছে স্পষ্ট
চিন্তা-ভাবনা করার রসদ। বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক বিক্ষোভ
বেড়েই চলেছে। গেল বছর তামিলনাডু ও মধ্যপ্রদেশে তা বেশ বড় আকার ধারণ করে; মধ্যপ্রদেশের
মান্দাসরে পুলিশের গুলিতে কৃষকদের প্রাণও গিয়েছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশেও
কৃষি সমস্যা নিয়ে মানুষের মন সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। মহারাষ্ট্রের আন্দোলনটা এক দিকে
অন্য রাজ্যের কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতার শরিক, আবার চরিত্রগত ভাবে খানিকটা আলাদাও।
অভিযান শুধু ফসলের ন্যায্য মূল্য বা ঋণ মকুবের দাবিতে নয়, এতে যুক্ত হয়েছে অরণ্যের
অধিকার আইন যথাযথ ভাবে বলবৎ করার দাবি।
আন্দোলনে জোরালো ভাবে যোগ দিয়েছেন নাসিক এলাকার
আদিবাসীরা। তাঁরা এ-জেলায় মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ; আদিবাসী জনসংখ্যার অনুপাতের দিক
দিয়ে নাসিক তৃতীয় বৃহত্তম: নান্দুরবার (৬৯%) ও গডচিরোলি-র (৩৮%) পর। নাসিকের আদিবাসীদের
বড় অংশটা কোলি মহাদেব গোষ্ঠীর — সারা মহারাষ্ট্রের মোট কোলি মহাদেব জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই
নাসিকে। এই অভিযানে যোগ দেওয়া ষাটোর্ধ্ব শংকর ওয়াঘেরা-র গ্রাম নলগাঁওতে ৮০ শতাংশ লোক
আদিবাসী; যে ব্লক বা তালুকে তাঁদের গ্রাম সেখানে ৫৪ শতাংশ আদিবাসী। কোলি মহাদেব আদিবাসীরা
চাষ-বাস (৩০ শতাংশ) ও খেতমজুরি (৪৪ শতাংশ), প্রধানত এই দুই পেশাতেই যুক্ত, তবে এঁদের
সাক্ষরতার উচ্চ (৭৫ শতাংশ) হারের ফলে কিছুটা পেশাগত বৈচিত্র সম্ভব হয়েছে, সাক্ষরতার
সুবাদে তাঁরা গলার জোর কিছুটা বাড়াতে পেরেছেন। যেমন শংকর ওয়াঘেরা বলেছেন, “আমরা অনেক
দিন ধরে যে-সব জমি চাষ করে আসছি সেগুলো কাগজেপত্রে বন বিভাগের; কিন্তু অরণ্যের অধিকার
আইন অনুযায়ী সেগুলো আমাদের নামে রেকর্ড হওয়ার কথা, হচ্ছে না। ফলে বন বিভাগের লোকেরা
আমাদের প্রায়ই হয়রান করে।’’ আইনটা যে হয়েছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ঝাড়খণ্ড,
ওডিশা, এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও বহু আদিবাসীর তা জানা নেই, যদিও আইনের নাম থেকে স্পষ্ট যে,
এটা প্রাথমিক ভাবে আদিবাসীদের অধিকারের ব্যাপার — আইনের পুরো নাম দ্য শিডিউল্ড ট্রাইবস
অ্যান্ড আদার ট্র্যাডিশনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স (রেকগনিশন অব ফরেস্ট রাইটস) অ্যাক্ট।
কিন্তু কোলি মহাদেবের মতো কিছুটা এগিয়ে থাকা
জনজাতির বাইরে আছেন আরও বিপুলসংখ্যক আদিবাসী, যাঁরা দরিদ্রের চেয়ে দরিদ্র, ক্ষমতাবৃত্তের
বহু বাইরে যাঁদের অবস্থান, যাঁরা ভাষা-সংস্কৃতি-সামাজিক গঠনের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ স্বাতন্ত্র্যের
অধিকারী? তাঁদের সঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্কটা কেমন? একদা ভারতের বামপন্থীরা এ-দেশের
সবচেয়ে সুযোগবঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের বিষয়ে নানা রকম চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন, আদিবাসীরা
ছিলেন বামপন্থীদের স্বাভাবিক গোষ্ঠী-মিত্র। ১৯৫৭ সালেই পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীবহুল বিনপুর
বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী জয়ী হন। বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বহু জায়গায় বামপন্থীদের
সবল সংগঠন গড়ে ওঠে। কিন্তু ক্রমে আদিবাসীরা সংসদীয় বামপন্থীদের থেকে দূরে সরে গেলেন।
কেন এমনটা ঘটল, তা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা-ভাবনার বদলে তাঁদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’
বলে শত্রুপক্ষে ঠেলে দেওয়া হল। মহারাষ্ট্রেই একদা ঠাণে জেলার ওয়ারলি আদিবাসীদের মধ্যে
সিপিআইএম-এর সংগঠন ছিল মজবুত। কমিউনিস্ট নেত্রী গোদাবরী পারুলেকরের লেখা বই আদিবাসী
বিদ্রোহ পড়তে গিয়ে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারেন না এমন পাঠক কম। কেন তাঁরা সেই সংযোগ ধরে
রাখতে অপারগ হলেন তা নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না। এই রাজ্যেই সর্ববৃহৎ, কিন্তু ভয়ানক
শোষণ-বঞ্চনার শিকার জনজাতি ভিলদের মধ্যে সংসদীয় বামপন্থীদের তেমন ভিত্তি কেন নেই তা
নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসার খবর পাওয়া যায় না। পরিচিতিগত বঞ্চনার কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল,
শ্রেণিবঞ্চনার কথাটা — যার প্রমাণ, এঁদের মধ্যে আজও ৭৫% লোক খেতমজুর— তা তাঁরা বিস্মৃত
হন কী ভাবে? একই রকম ভাবে ছত্তীসগঢ়, ওডিশা, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীরা কেন সংসদ-বহির্ভূত
রাজনীতির চরম সশস্ত্র রূপ বরণ করে নিলেন তা নিয়ে ‘মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে’-র মতো মানুষের
প্রতি চরম অবমাননাকর বিবৃতি ছাড়া কিছু শোনা যায়নি। কিন্তু, একথা তো অস্বীকার করার উপায়
নেই যে, ছত্তীসগঢ়, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য সুরক্ষার মতো পুনর্বণ্টনমূলক কর্মসূচিতে
বন্দুকের রাজনীতি প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে গিয়েছে, সে রাজনীতির যত ভ্রান্তি বা দুর্বলতা
থাক না কেন। ছত্তীসগঢ়ের উন্নত খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প রমণ সিংহের লোকশুভেচ্ছা থেকে
আসেনি, এসেছে রাজনীতির চাপে। তেমনই অরণ্যের অধিকার আইন অনেকটাই এসেছে মাওবাদী রাজনীতির
চাপ সামলাতে। উগ্র হোক, ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ হোক, শংকর গুহনিয়োগী ধারার সেবা-কেন্দ্রিকতা
হোক, এ কে রায়ের শ্রমিক-ইউনিয়নসর্বস্ব রাজনীতি ভাবনা হোক, ভিন্ন ধারার সংসদীয় নকশালপন্থা
হোক, এই নানা রাজনীতির ধারা মূলত বামপন্থী। তাঁদের যেমন বন্দুক বা অন্যান্য একমুখী
ভাবনা ছেড়ে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ নিয়ে ভাবতে হবে, তেমনই সংসদীয় বামপন্থীদেরও
বোধহয় ভাবতে হবে কেন, কিছু এলাকায়, কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেবল প্রকাশ্য গণ-কর্মসূচির
সাহায্যে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই বোধটা ফিরিয়ে আনতে, ভারতের তামাম বামপন্থীদের
হয়তো ফিরে যেতে হবে বামপন্থার উৎসে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, কুমার রাণা,
১৩/০৩/২০১৮।
No comments:
Post a Comment