বন দফতরের ক্যামেরায় একবার দর্শন দিয়েই জঙ্গলে
সেঁধিয়েছে সে। জঙ্গলমহলের সেই নয়া হানাদার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে নিয়ে জল্পনার অন্ত
নেই। চেপে বসছে ভয়ও। কারণ, নিত্যনতুন এলাকায় মিলছে তার পায়ের ছাপ। কিছুদিন আগে পশ্চিম
মেদিনীপুরে বাঘ ধরতে গিয়ে বন দফতরের বিশেষ গাড়িতে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে
দুই বনকর্মীর।
বাঘের ভয়, আসলে প্রাণের ভয়। এমন পরিস্থিতিতে
তাই জঙ্গলের গভীরে ঢোকার আর সাহস পাচ্ছেন না বনবাসীরা। যাঁদের জীবনধারণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে
জড়িয়ে রয়েছে শাল জঙ্গল, তারাই জঙ্গলমুখো হতে না পারায় রুটিরুজিতে টান পড়ছে। প্রাণ
বাঁচাতে জঙ্গল এড়ানোর কথা বলছে বন দফতরও। আর তা মানতে গিয়ে পেটের ভাত জোগাড়ে দিশাহারা
জঙ্গলজীবীরা।
প্রতিদিন জঙ্গলের শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে পেটের
ভাত জোগাড় করেন লালগড়ের মংলি শবর, ঝাড়গ্রামের সবিতা শবররা। জঙ্গলের সেই ‘ঝাঁটি’বেচে দিন গুজরান হয়
জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামের এমন বহু বাসিন্দার। কিন্তু বাঘের ভয়ে জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ হয়ে
যাওয়ায় হাতে টাকা আসছে না। জ্বালানির শুকনো ডাল-পাতারও আকাল শুরু হয়েছে। এর ফলে জঙ্গলমহলের
গাঁ-গঞ্জে গৃহস্থের হেঁশেল থেকে খাবার দোকানে জ্বালানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এক লাফে
বেশ কিছুটা দর বেড়েছে জঙ্গুলে-জ্বালানির। লালগড়ের মেলখেড়িয়ার প্রৌঢ়া কৌশল্যা মাহাতো
বলেন, ‘‘মাসখানেক জঙ্গলে আতঙ্কে যাওয়া যাচ্ছে না। যারা সাহস করে সংগ্রহ করে আনছে,
তারা ১০০-১২০ টাকা দর হাঁকছে।”
লালগড়ের বেলারানি সিংহ, লক্ষ্মী মাল, কাজল
সিংহরা জঙ্গলের ঝাঁটি বেচে দিন গুজরান করেন। তাঁরা বলছেন, ‘‘দলবেঁধে দূরের জঙ্গল থেকে
ঝাঁটি নিয়ে আসছি। পরিশ্রম বেশি হচ্ছে।” লালগড়ের বাসিন্দা প্রৌঢ়া খাঁদি চালক জানালেন,
মাসখানেক আগেও এক বোঝা (মাথায় যতটা চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়) ঝাঁটির দাম ৫০-৬০ টাকার
মধ্যে ছিল। এখন সেটাই ১০০ টাকার কমে মিলছে না। বাঘের ভয়ে ঝাঁটি সংগ্রহকারীরা নিয়মিত
জঙ্গলে যাচ্ছেন না বলেই এমন চড়া দাম। লালগড়ের রথতলার তেলেভাজা ও চা দোকানের মালিক
তপন রায় বলেন, ‘‘কয়েক সপ্তাহ ধরে জ্বালানি শুকনো কাঠ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। যা
মিলছে তার দাম প্রায় দ্বিগুণ।” লালগড়ের জঙ্গলে বাঘের আবির্ভাব নিয়ে এলাকায় নানা
গুজব রটেছিল। গত মাসে জঙ্গলে চরতে গিয়ে কয়েকটি গরু রক্তাক্ত জখম হয়, কিছু গরু নিখোঁজ
হয়ে যায়। এলাকার নরম মাটিতে পায়ের ছাপ দেখে জল্পনা শুরু হয়। জঙ্গলে কয়েকটি বাছুরের
ছিন্ন ভিন্ন মৃতদেহ দেখে সন্দেহ বাড়ে। ছোট পেলিয়া গ্রামের এক বাসিন্দাও গরু চরাতে
গিয়ে বাঘ দেখার দাবি করেন। তারপর থেকে জঙ্গলে গরু-ছাগল চড়ানোও প্রায় বন্ধ।
২ মার্চ লালগড়ের মেলখেরিয়ার জঙ্গলে বন দফতরের
ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল প্রকাণ্ড এক বাঘের ছবি। এরপর সুন্দরবন থেকে বাঘ ধরতে পটু বনকর্মীদের
নিয়ে আসা হয়েছে, আরও ক্যামেরা বসেছে, উড়েছে ড্রোন, বিশেষ খাঁচাও পাতা হয়েছে। কিন্তু
বাঘ ধরা যায়নি। উল্টে ঝাড়গ্রাম জেলা ছাড়িয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ধেড়ুয়া ও গোয়ালতোড়
এলাকায় বাঘের আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়া বনাঞ্চল এলাকাতেও সন্দেহভাজন
প্রাণীর পায়ের ছাপ মেলায় উদ্বেগ বেড়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। সব মিলিয়ে বাঘের আতঙ্কে
জঙ্গলজীবীরা বিপন্ন।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের মরসুমে জঙ্গলের মহুল ফুল,
কচড়া ফল, শালবীজ, শালপাতা, কেন্দুপাতা সংগ্রহ করেন আদিবাসীরা। বাঘ ধরা না পড়লে কীভাবে
জঙ্গলে যাবেন,দুমুঠো খাবার জোটাবেন, সেটাই এখন ভাবনা লালগড়ের কাঁদন সরেন, লক্ষ্মীমণি
মান্ডিদের।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, কিংশুক গুপ্ত,
২০/০৩/২০১৮।
No comments:
Post a Comment