কানপুরে কাজে গিয়ে কোমর ভাঙল আদিবাসী কিশোরীর, ছাদ থেকে নিচে ছুড়ে ফেলল মালিক ও তার লোকেরা।
মোটা মাস মাইনে। তা শুনেই ভিন রাজ্যে কাজে
যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিল নকশালবাড়ির চা বাগানের গরীব আদিবাসী কিশোরী। কিন্তু অর্ধেক মাসও
কাজ করতে পারেনি সে। অভিযোগ, দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি এবং দিনের শেষে নামমাত্র খাবার
জুটত সেই বাড়িতে। প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। শেষে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় সেই কিশোরী।
অভিযোগ, তখন তাকে মারধর করে তিন তলা থেকে নীচে আবর্জনার উপরে ছুড়ে ফেলা হয়। প্রাণে
বাঁচলেও এখন সে কোমর ভেঙে মাটিগাড়ার একটি নার্সিংহোমে শয্যাশায়ী।
ঘটনার সূত্রপাত জানুয়ারি, ২০১৮। কাজের খোঁজ
নিয়ে নকশালবাড়িতে অর্ড চা বাগানে আদিবাসী কিশোরীদের বাড়িতে আসে এক এজেন্ট। আদিবাসী
কিশোরীর মা জানান, তিনি মেয়েকে ছাড়তে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মাসে দশ হাজার টাকা মাইনের
কথা শুনে আদিবাসী কিশোরীটি যেতে চায়। সেই মতো ৫ জানুয়ারি কানপুরে ওই ব্যবসায়ীর বাড়িতে
কাজে যোগ দেয় সে।
বর্তমানে নার্সিংহোমে শুয়ে শুয়ে আদিবাসী কিশোরী
জানায়, প্রথম থেকেই বাড়িতে ছিল হাড়ভাঙা খাটুনি। ভোর পাঁচটায় তাকে ঘুম থেকে উঠতে হত।
তার পর সারা দিন ধরে চলত ঘর ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, কাপড় কাচা। আদিবাসী কিশোরীটির অভিযোগ,
‘‘সারাদিন কাজ করে প্রচণ্ড খিয়ে পেত। রাতে এক হাতা ভাত আর দুচামচ ডাল খেতে দিত। দিনে
তাও পেতাম না।”
এই অবস্থায় এক দিন বাড়ি ফিরতে চায় আদিবাসী
কিশোরীটি। তার অভিযোগ, সে কথা শুনে মালিক এবং মালিকের বউ মিলে চটিপেটা করেন। এর পরে
১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাড়িতে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা
থাকায় সে পালাতে পারেনি। তার অভিযোগ, ‘‘তখন সকলে আমাকে খুব মারে। তার পর মালিকের নির্দেশে
অফিসের দু’জন কর্মী আমাকে বেঁধে তিন তলা থেকে পাশের নর্দমায় ছুড়ে ফেলে। ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে
ফেলি। পরে শুনেছি এলাকার কয়েক জন আমাকে উদ্ধার করে পুলিশে খবর দেয়।”
আদিবাসী কিশোরীটির পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে,
কানপুর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে সেখানকার একটি হাসপাতালে রাখে। তার পর খবর দেয় বাড়িতে।
তাকে ২৯ তারিখ শিলিগুড়ির কাছে মাটিগাড়ার এক নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। মেয়েটির
পরিবারকে দিয়ে এ দিন ওই এজেন্ট এবং বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করায়
শিলিগুড়ির লিগ্যাল এড ফোরাম। নার্সিংহোমের যে চিকিৎসক আদিবাসী কিশোরীটিকে, তিনি জানান,
এক জায়গায় লিগামেন্ট ছিড়ে গিয়েছে। কোমর আর মেরুদণ্ডের সংযোগ স্থলে হাড় ভেঙেছে। অস্ত্রোপচার
করতে হবে। না হলে আদিবাসী কিশোরীটির সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।
জানুয়ারি মাসে কানপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই
আদিবাসী কিশোরীটিকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তিনতলা একটা বাড়িতে। সারা দিন কাজের পরে
রাতে খেতে চাইলে জুটেছিল গালিগালাজ।
পরদিন সকাল থেকে ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, কাপড়
কাচা। কিন্তু, খাবার চাইলে শুধু জল! বর্তমানে কলকাতার একটি হাসপাতালে শুয়ে ১৭ বছরের
আদিবাসী কিশোরী বলে, ‘‘১০ হাজার টাকা মাইনে
দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল। বিশাল বাড়ি। মালিক-মালকিন, ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি আর
পাঁচ জন পরিচারক-পরিচারিকা। সকলেই কমবেশি মারধর করত।”
চা বাগানে বেড়ে ওঠা আদিবাসী কিশোরী জানায়,
পর পর দু’দিন খেতে দেওয়া হয়নি তাকে। তাই গভীর রাতে রান্নাঘরে গিয়ে রুটি বানিয়ে খেয়েছিল সে।
ধরা পড়ার পরে জুটেছিল মার। এ ভাবে ৯ দিন কেটে যায়। আদিবাসী কিশোরীটির কথায়, ‘‘খিদের
জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আবার রুটি বানিয়ে খাই। এ বার ওরা মারতে এলে চলে যাই ছাদে।
পিছনের সিঁড়ি দিয়ে পালাব ভেবেছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে হাত-পা-মুখ বেঁধে ছাদ থেকে ছুড়ে
দেয়।” পথচলতি এক যুবক তাকে তুলে ভর্তি করেন হাসপাতালে। মেরুদণ্ডে, পায়ে ‘মালটিপল ফ্র্যাকচার’হয়েছে আদিবাসী কিশোরীটির।
আদিবাসী কিশোরীটি জানায়, চা বাগানের কাজ থেকে
বাবা অবসর নেওয়ার পরে, টানাটানি শুরু হয় ৬ ভাই-বোনের সংসারে। সুযোগ বুঝে কাগজপত্র নিয়ে
হাজির হয়ে যায় এক দম্পতি বিকাশ ও মিলন থাপা। ১০ হাজার টাকার বেতনের চাকরির কথা বলে।
তার পর তাদের সঙ্গে গত কানপুরে পৌঁছয় সুন্দরী। কিশোরী বলে, ‘‘এক রাত ওই দালালদের বাড়িতে
ছিলাম। তখনই সন্দেহ হয়। কানপুরে যাব না বলায় আমাকে শাসায়। বলে অনেক টাকা ওদের দিতে
হবে।”
ওই দম্পতিকে পুলিশ ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে।
কানপুরের হাসপাতাল থেকে তারাই সুন্দরীকে নিয়ে এসেছিল শিলিগুড়িতে। নার্সিংহোমে (পরে
আনা হয় কলকাতায়) ভর্তি করিয়ে, পরিবারকে খবর দিয়ে গা ঢাকা দেয়। কানপুরের ওই বাড়ির মালিক
কোমল ভাসানের নামেও মাটিগাড়া থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে তিনি অধরা।
আদিবাসী কিশোরীটির ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। দার্জিলিং
ডিস্ট্রিক্ট লিগাল এড ফোরামের সম্পাদক অমিত সরকারের বক্তব্য, তাঁরা জানতে পেরেছেন,
চা-বাগানের কুলিলাইন থেকে অনেক শিশু চলে গিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। অমিতবাবুর কথায়, ‘‘কয়েক
জন পাচার হয়েছে, কয়েক জন হয়তো বিক্রিও হয়ে গিয়েছে বলে আমাদের সন্দেহ।”
দিল্লি ও রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশনে চিঠি
লেখেন অমিতবাবুরা। দিল্লি থেকে নির্দেশ আসে রাজ্যের কাছে। রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা
কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘দার্জিলিঙের জেলাশাসকের কাছে এই মেয়েটির
বিষয়ে জানতে চেয়েছি। এমন ঘটনা আর হয়েছে কি না, তা-ও দেখতে বলা হয়েছে।”
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২/০৩/২০১৮।
No comments:
Post a Comment