ঝাড়গ্রামের কালাঝরিয়াতে কালাহান্ডির ছায়া!
গত বছর দেড় মাসের ব্যাবধানে তিন লোধা-শবরের মৃত্যুর পর এ বার চার মাসের মধ্যে মৃত্যু
হল শিশু সহ ৪ লোধা-শবরের।
কালাহান্ডিতে অনাহার মৃত্যু আর ঝাড়গ্রামের
কালাঝরিয়াতে অপুষ্টিজনিত দুরারোগ্য ব্যধিতে অকালমৃত্যু – ফারাক বলতে এটুকুই। উন্নয়নে
ছয়লাপ জঙ্গলমহলে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে এঁদের মৃত্যু, নাকি লোধা- শবরদের জীবনযাত্রায়
অকালমৃত্যুই ভবিতব্য। আমলাশোলের অনাহার মৃত্যুর পর সেই প্রশ্নই সামনে এসেছে।
২০১৭-তে এক মাস আট দিনের ব্যবধানে এই কালাঝরিয়া
গ্রামে এক মহিলা সহ তিন জন লোধা-শবরের মৃত্যু হয়। শুরু হয় গ্রামের ৪৫ বছরের রঞ্জিত
ভক্তার অকালমৃত্যু দিয়ে। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি কিডনির অসুখে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বাড়ির
সামনেই বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারের পাশে লাগানো আছে সরকারের অনগ্রসর সম্প্রদায় কল্যাণ
বিভাগের সাইনবোর্ড। দোরগোড়ায় রয়েছে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র। বাসিন্দাদের বক্তব্য,
“এই চিকিৎসায় হামদের জটিল রোগ সারে নায়”।
গ্রামের মূল রাস্তা থেকে দক্ষিণে ঝোপঝাড়ের
মাঝে জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা ঝুপড়ি বাড়িটি হল ছিনকু ভক্তার। গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর
স্ত্রী সুকন (টুকু) ভক্তা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারও আগে ৪ মার্চ জন্ডিসে
আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটে ৩৭ বছরের প্রতিবেশী ঝন্টু ভক্তার।
এই গ্রামে লোধা-শবরদের অকালমৃত্যু এখানেই শেষ
নয়। এ বার গ্রামে ঢুকতেই দেখা মিলল যুবক সহদেব মল্লিকের। এক প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে
সাদা থান জড়িয়ে মায়ের অকালমৃত্যুর শ্রাদ্ধশান্তির জন্য মাগনে বেরিয়েছেন। তাঁর কথায়,
১৯ মার্চ রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় স্ট্রোকে মা সরস্বতী মল্লিকের অকাল মৃত্যু হয়েছে। কয়েক
দিন আগে রহিম মল্লিকের এক কন্যসন্তান মারা গিয়েছে। তার ক’দিন আগে এই পরিবারের তারাপদ
মল্লিকের অকালমৃত্যু হয়। তারও আগে গত ডিসেম্বরে লাল (ডাক নাম) ভক্তার মৃত্যু ঘটেছে
বলে দাবি গ্রামবাসীদের।
ঝাড়গ্রাম জেলা শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে কালাঝরিয়া
গ্রামটি মানিকপাড়া ৭ নং পঞ্চায়েতে পড়ে। ১৩২টি পরিবারের মধ্যে সিংহভাগ লোধা-শবর। গ্রামে
ঢোকার মুখেই প্রাথমিক স্কুল, মাঝে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কেন্দ্র, শেষ প্রান্তে অঙ্গনওয়াড়ি
কেন্দ্র। গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা হয় পাশের ভালুকখুলিয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। চিকিৎসার
প্রাণকেন্দ্র বলতে স্থানীয় চুটিয়ামারি (মানিকপাড়া) হাসপাতাল। তবুও বছর বছর অকালমৃত্যুর
প্রহর গুনছে এই গ্রামের লোধা-শবরেরা।
২০০৪ সালের ৯ জুন আমলাশোলের লোধা-শবরদের অনাহার
মৃত্যু রাতারাতি কালাহান্ডির পরিস্থিতিকে মনে করিয়ে দিয়েছিল। সে সময় বিরোধীরা শাসক
বামদের যথেষ্ট চাপের মুখে ফেলে দেয়। আমলাশোলের অনাহার মৃত্যু নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় ‘লাঙ্গল’ কাব্যে কবিতাও লেখেন। এত সবের পরেও অপুষ্টিজনিত জটিল রোগাক্রান্ত
লোধা-শবরদের অকাল মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। কালাঝরিয়ার ঘটনা সেই দৃষ্টান্তকে সামনে এনেছে।
লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির জেলা সম্পাদক বলাই
নায়েকের মতে, লোধা-শবরদের সচেতন করা ছাড়াও তাদের যে সার্বিক পরিষেবা দেওয়ার কথা, তা
তারা পাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো এদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে সরকার সহানুভূতিশীল
থাকতে বাধ্য। এ ব্যাপারে ঝাড়গ্রামের মহকুমা শাসক নকুলচন্দ্র মাহাত জানান, তিনি বিস্তারিত
খোঁজ নিয়ে মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনা করে ওই গ্রামে বিশেষ মেডিক্যাল
টিম পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
সৌজন্য – খবর Online, সমীর মাহাত, ২৬/০৩/২০১৮।
No comments:
Post a Comment