একসময়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, ও বাঁকুড়া জেলা জুড়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল
ছিল ঝাড়খণ্ড পার্টি। কিন্তু ১৯৯৬-৯৭ সাল নাগাদ কেন্দ্রীয় সভাপতি এন ই হোরোর সঙ্গে নরেন হাঁসদার মতবিরোধের জেরে ঝাড়খণ্ড
পার্টি বিভাজিত হয়ে গঠিত হয় ঝাড়খণ্ড পার্টি (হোরো) ও ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)। নরেন
হাঁসদা নিজে পশ্চিমবঙ্গের ভুমিপুত্র হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ নেতা কর্মীরা
ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) এ যোগদান করেছিলেন। নরেন হাঁসদার নেতৃত্বে পশ্চিমবাংলার
জঙ্গলমহল জুড়ে সবথেকে শক্তিশালী ঝাড়খণ্ডী রাজনৈতিক দল হিসেবে উত্থান ঘটে ঝাড়খণ্ড পার্টি
(নরেন) এর। ১৯৯১ সালের পর পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় একমাত্র ঝাড়খণ্ডী রাজনৈতিক দল
হিসেবে বিধায়ক পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)। নরেন হাঁসদা নিজে দুই
দফায় বিনপুর বিধানসভা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে নরেন হাঁসদার অকাস্মত
মারা যাবার পর নরেন হাঁসদা স্ত্রী ও বর্তমানে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) এর সভানেত্রী
শ্রীমতী চুনিবালা হাঁসদাও দুই দফায় বিনপুর বিধানসভা থেকেই বিধায়ক নির্বাচিত
হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুসময় আর নেই। ভুল রাজনৈতিক নেতৃত্বের জেরে বর্তমানে সংগঠন
বিহীন হয়ে পড়েছে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)।
২০০০ সালে নরেন হাঁসদা
মারা যাবার পর ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) আবার বিভাজিত হয়। প্রয়াত নরেন হাঁসদা কয়েকজন
অনুগামী গৃহবধূ চুনিবালা হাঁসদাকে সভানেত্রী হিসেবে তুলে ধরে। ঝাড়খণ্ড পার্টি
(নরেন) এর দীর্ঘদিনের নেতা, কর্মীদের বাদ দিয়ে গৃহবধূ
চুনিবালা হাঁসদাকে সভানেত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে আরেক অংশ নরেন হাঁসদার
দীর্ঘদিনের সহযোগী ও
বিভিন্ন আন্দোলনের
পোড়খাওয়া নেতা আদিত্য কিস্কুকে সভাপতি হিসেবে তুলে ধরে। গঠিত হয় ঝাড়খণ্ড পার্টি
(আদিত্য)। এর পরেও আবার ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) বিভাজিত হয়। ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন)
এর জনপ্রিয়তম যুব নেতা বাবু বোস (রবীন্দ্রনাথ বসু) দীর্ঘদিনের জেল বন্দি অবস্থা
থেকে মুক্তি পেয়ে ঝাড়খণ্ড পার্টি (বাবু বোস) গঠন করে।
চুনিবালা হাঁসদা
নেতৃত্বাধীন ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন), আদিত্য
কিস্কু নেতৃত্বাধীন ঝাড়খণ্ড পার্টি (আদিত্য) ও ঝাড়খণ্ড পার্টি (বাবু বোস), তিনটি গোষ্ঠী স্বীকৃতি পাবার জন্য নির্বাচন
কমিশনে আবেদন জানান। নির্বাচন কমিশন চুনিবালা হাঁসদার নেতৃত্বাধীন ঝাড়খণ্ড পার্টি
(নরেন) গোষ্ঠীকে প্রকৃত ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পর আদিত্য
কিস্কু নিজের গোষ্ঠীকে ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টি হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নথিভুক্ত
করেন। বাবু বোস তার গোষ্ঠীকে ঝাড়খণ্ড জনমুক্তি মোর্চা হিসেবে নির্বাচন কমিশনে
স্বীকৃতি করান।
বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভাজিত
হয়ে যাওয়ায় ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) এর জনসমর্থনে বিপুল ধস নামে। ঝাড়খণ্ড পার্টি
(নরেন) এর কোন গোষ্ঠীই পরবর্তীকালে নির্বাচনী সাফল্য পায়নি।
২০১১ সালের বিধানসভা
নির্বাচনের মুখে চুনিবালা হাঁসদার দীর্ঘদিনের অনুগামী ও জামবনি এলাকার যুব নেতা
অর্জুন হাঁসদা ওরফে লাল নির্দল প্রার্থী হিসেবে বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রেই নির্বাচনী
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করে। অর্জুন হাঁসদা ভোট কেটে নেওয়ায় পরাজয় ঘটে
চুনিবালা হাঁসদার। কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) মনোনীত প্রার্থী
চুনিবালা হাঁসদাকে মাত্র ৭ হাজার ৬১০ টি ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হন সিপিএমের
দিবাকর হাঁসদা। দিবাকরবাবু পান ৬০,৭২৮টি
ভোট (৪১.১৭%)। চুনিবালা পেয়েছিলেন ৫৩,১১৮টি
ভোট (৩৬%)। গোঁজ প্রার্থী অর্জুন হাঁসদা ১৪,৪৫৯টি
ভোট (৯.৮০%) কেটে নেওয়ায় হেরে যান চুনিবালা।
২০১৩ সালের পঞ্চায়েত
নির্বাচনে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) কোন পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ
আসন জিততে পারেনি।
২০১৪-র লোকসভা ভোটে
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) প্রার্থী চুনিবালা হাঁসদা পেয়েছিলেন
মাত্র ৭৬০৮ টি ভোট, অথচ ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা প্রার্থী বুদ্ধদেব মান্ডি পেয়েছিলেন
১৫১১৪ টি ভোট। ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির প্রার্থী মিলন মান্ডি পেয়েছিলেন ৬০১৩ টি ভোট,
ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির প্রার্থী মুরারি মোহন বাস্কে পেয়েছিলেন ৩৮৭৭ টি ভোট।
২০১৬ সালের বিধানসভা
নির্বাচনেও ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) চরম ব্যর্থ হয়। ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) এর
দীর্ঘদিনের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বিনপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রয়াত নরেন হাঁসদার কন্যা ও
ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) মনোনীত প্রার্থী বিরবাহা হাঁসদার জমানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত
হয়। মাত্র ৭০৯৪ টি ভোট (৪.০৮%) পান নরেন হাঁসদার মেয়ে বিরবাহা হাঁসদা। ঝাড়গ্রাম
বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএম সমর্থিত চুনিবালা হাঁসদা অবশ্য ৪৪০০৫ টি ভোট (২৪.৩৭%)
পান যদিও বলাই বাহুল্য সেগুলি সিপিএমের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক।
চুনিবালা হাঁসদার বিরুদ্ধে
অধিকাংশ ঝাড়খণ্ডী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ যে ঝাড়খণ্ডী রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে চুনিবালা
হাঁসদা চরম উদাসীন। বার দুয়েক ঝাড়খণ্ডী রাজনৈতিক দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (JMM),
ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টি (JAP), ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি (JDP), ঝাড়খণ্ড পিপলস পার্টি (JPP) কে নিয়ে ঝাড়খণ্ডী ঐক্য
গঠন করলেও, চুনিবালা হাঁসদার নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেন) দূরে থেকেছে। ঝাড়খণ্ড
পার্টি (নরেন) ও ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টিকে এক করার চেষ্টা হলেও, অভিযোগ যে
চুনিবালা হাঁসদার অনড় মনোভাবের জন্য প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।
No comments:
Post a Comment