মাটির এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে ঝোলানো চার্টগুলোর সামনে
দাঁড়িয়েছিল সরস্বতী মুর্মু৷ রং জ্বলে যাওয়া ফিকে গোলাপি মোটা সুতির শাড়ি পরা
ছিপছিপে তরুণীর কোলে এক বছরের ছেলে৷ আঁচলের একটু আড়াল দিয়ে শিশুকে বুকের দুধ দিতে
দিতেই চার্টে লেখা অক্ষরগুলো চিনিয়ে দিচ্ছিল সরস্বতী৷ সামনে বসা মনসারাম মান্ডি, সুকুরমণি হেমব্রমদের জীবনে সেই প্রথমবার অক্ষরের
সঙ্গে পরিচয়৷ ছোট্টখাট্টো চেহারার বালিকা মুর্মুর বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে৷
কোলে দেড় বছরের ছেলে রমেশকে নিয়ে সপ্রতিভ তরুণী বলে উঠল, ‘দিদি, এ বার ওই ন্যাপকিন এনেছ তো ? আমি সবাইকে বলে রেখেছি কিন্তু!’ গ্রামের তিরিশ জন মেয়ের জন্য শহর থেকে বয়ে আনা
স্যানিটারি ন্যাপকিনের বস্তাটা টেনে নিয়ে দুই সন্তানের জননী বাকিদের বুঝিয়ে দিল
ন্যাপকিনের উপযোগিতা, কী ভাবে ব্যবহার
করতে হবে, সে সব কিছু৷
পুরুলিয়া শহরের থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরের
ছোট্ট জনপদ পারার বাসিন্দা, ভূগোলের তরুণ
মাস্টারমশাই পান্থদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সোনারাম মুর্মুর হাতে একটা গ্লোব তুলে দিয়ে
বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কোনটা উত্তর মেরু, কোনটাই বা আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি৷ সোনারামই
গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে৷ গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যাক পেয়েছে, এ বছর ফের পরীক্ষায় বসবে৷ কিন্তু সোনারামের ঠিকানা ওই
গ্লোবের কোনখানে ? অযোধ্যা পাহাড়ের
একেবারে মাথায় ছোট্ট গ্রাম রুগরুঘুটু৷ শহুরে পর্যটকেরা অযোধ্যা ‘হিলটপ’ বলে যে জায়গা পর্যন্ত উঠে আসেন, সেই মোড় ছাড়িয়ে আরও প্রায় ১৮ কিলোমিটার উঠলে পাহাড়ের
চুড়োয় একেবারে শেষ জনবসতি এই রুগরুঘুটুতেই বাস সোনারাম, বালিকা, সরস্বতীদের৷ মাত্র ১৬ ঘর সাঁওতাল পরিবারের বাস গ্রামটায়৷
উসুলডুংরি, জামঘুটু, জিলিংগোড়া, তালাকধর, তেলিয়াভাসার মতো ছোটো ছোটো গ্রামগুলো রাস্তার দু’পাশে ছড়িয়ে আছে ক্যালেন্ডারের ছবির মতো৷ কয়েক দিন
আগেই গিয়েছে বাঁদনা পরব৷ মাটির দেওয়ালে নিপুণ আঁকা গিরিমাটি আর আলকাতরার আলপনা৷
খোলার চালের ঘরের সামনে তুরতুর করে হেঁটে বেড়াচ্ছে মুরগির ছানা, চালে লতিয়ে উঠেছে চালকুমড়ো, লাউয়ের লতা৷ রুগরুঘুটুর ঘরগুলো অবশ্য এত সম্পন্ন, সুশ্রী নয়৷ বেশির ভাগ বাড়ির খোলার চাল ধসে পড়ছে, শিশুগুলোর রুক্ষ তেলবিহীন চুলে লালচে ছোপ৷ গ্রামের
পিছন দিকে উঁচুনিচু চাষের জমির শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে অযোধ্যা পাহাড়ের রেঞ্জটা ফুটে
ওঠে তেলরঙে আঁকা ক্যানভাসের মতো৷ গ্রামে ঢোকার একেবারে মুখে একটা টালির চালের ঘর৷
অযোধ্যা পাহাড়ের পাথর দিয়ে তৈরি দেওয়াল, তার উপর লাল কাঁকুরে মাটির প্রলেপ৷ সেই ঘরে বসে শ’খানেক রোগী দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন মেডিক্যাল
ক্যাম্পের ডাক্তারবাবু রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল৷ নামটা ভারি হলেও মোটে তিন বছর আগে
ডাক্তারি পাশ করেছেন পুরুলিয়ার মানবাজারের ঝকঝকে তরুণ৷ অযোধ্যা থেকে অনেক দূরের
একটা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারি করার সুবাদে যে ধরনের রোগভোগের
সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তার কিছুই মিলছে না
রুগরুঘুটুতে এসে৷ বুড়োবুড়ি যারা এসেছেন, তাঁদের অধিকাংশের চোখে ছানি বা হাঁটুতে বয়সজনিত ব্যথা৷
বিবাহিত মেয়েগুলির অধিকাংশেরই প্রসব হয়েছে বাড়িতে বা বড়জোর পাঁচ কিলোমিটার দূরের
তেলিয়াভাসার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে৷ তবু হাইপারটেনশন, সুগার, ব্লাড প্রেশার, এমনকী গ্রামগঞ্জে পরিচিত চর্মরোগের চেনা অসুখেরও খোঁজ মিলছে
না এই গ্রামে৷ সাঁওতাল তরুণ-তরুণীদের ভরপুর স্বাস্থ্য, এমনকী বুড়োবুড়িরাও দিনে দু’বার পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠ কুড়িয়ে আনে, ছোটখাটো খরগোশ, ইঁদুর মেরে নিয়ে আসেন৷ সুতরাং সাধারণ সর্দিকাশি আর
বাচ্চাদের কৃমির ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত দিতে হল ডাক্তারবাবুকে৷
প্রায় দিকশূন্যপুরের এই গ্রামের সবটাই অবশ্য এমন রঙিন
নয়৷ গোটা গ্রামে কোনও পুকুর নেই৷ পানীয় জলের উৎস বলতে মাঠের মধ্যে একটা বাঁধানো
কুয়ো৷ ১৯৭৭ সালে সেই কুয়ো তৈরি হলেও, বছরে বেশ কয়েকমাস তাতে জল থাকে না৷ গরমের সময় খাবার জলের
খোঁজে ওদের যেতে হয় প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের মাছকান্দা ঝরনায়৷ পাহাড়ি খাদ বেয়ে
অন্তত আধ কিলোমিটার নামতে হয় সেই ঝরনা পর্যন্ত পৌঁছতে হলে৷ দূষণবিহীন গ্রামে ওই
কুয়োর জলেই চলে স্নান, খাওয়া, কাপড় কাচা, এমনকি ছোটখাটো সেচের কাজ৷ পড়াতে আসার আগে ছেলেকে কোলে নিয়ে
ওই কুয়োর পাড়ে ছাগল চরাচ্ছিল সরস্বতী৷ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়া সপ্রতিভ তরুণী
হাসতে হাসতে বলল, ‘মোর বাপের বয়স
হয়েছিল খুব৷ তা বুড়া মরার আগে কুটুম ঘরে বিয়া দিল৷ ইস্কুল যাওয়া আর হল না আমার৷’ সরস্বতীর বর এই গ্রামেই চাষবাসের কাজ করে৷ যদিও সুখা
জমিতে সে সুযোগ খুব বেশি থাকে না৷ সম্বত্সরের খাওয়ার মতো ধান কিছুটা হয়, বাকি সরকারের দেওয়া দু’টাকা কিলো চালেই ভরসা৷ গ্রামে পুকুর না থাকায় মাছের
স্বাদ ওরা জানে না৷ ঘরের পোষা মুরগি আর জঙ্গলের ছোটখাটো পশু মেরেই প্রোটিনের জোগান
হয়ে যায় রুগরুঘুটুর৷ সব্জিও খুব সীমিত৷ তেল, নুনের মতো নিত্য প্রয়োজনের জিনিস কিনতেও হাঁটা দিতে হয় কয়েক
কিলোমিটার দূরের তেলিয়াভাসা বা তালাকধরের মতো গ্রামে৷ ওদের কাছে বড়ো শহরের সংজ্ঞা
হল অযোধ্যা হিলটপ৷ কিন্তু তা নিয়ে বড়ো একটা খেদ নেই এ গ্রামের বাসিন্দাদের৷
গ্রামের প্রায় সব বাসিন্দাই নিরক্ষর৷ কেবল প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হিসেবে উঠে
এসেছে সোনারাম আর বলরাম মুর্মু৷ দু’জনই এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে৷ আর অন্য গ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে
আসা দুই বধূ সরস্বতী ও বালিকা কিছুটা স্কুলের শিক্ষা পেয়েছে৷ গত বছর নভেম্বরে
ট্রেক করত গিয়ে রুগরুঘুটুর খোঁজ পেয়েছিলেন একদল তরুণ৷ তাঁদেরই চোখে পড়ে কনকনে
শীতের রাতে গায়ে দেওয়ার জন্য ছেঁড়া চট ছাড়া কিছু নেই ওই গ্রামের লোকেদের৷ শীতের
মুখে এক ফেরিওয়ালা কম্বল বেচতে গিয়েছিল গ্রামে৷ কিন্তু ৫০০ টাকা খরচ করে কম্বল কেনার
রেস্ত জোগাড় হয়নি আদিবাসী পরিবারগুলোয়৷ দিনকতক পর ফের ওই দলটি পৌঁছয় রুগরুঘুটুতে৷
এ বার সঙ্গে নিয়ে যায় শীতের জামাকাপড়, কম্বল, বাচ্চাদের টুকটাক ওষুধপত্র, শুকনো খাবার৷ সে সময়ই পান্থদীপদের চমকে দিয়ে সোনারাম
আর সরস্বতী এগিয়ে এসে বলে ওরা পড়াশোনা করতে চায়৷ ব্যাক পেলেও ফের উচ্চ মাধ্যমিক
দিতে চায় সোনারাম, আর সরস্বতী সংসার
সামলেও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে চায়৷ ওদের উৎসাহেই আরও একদল মানুষ একজোট হয়ে শহর
থেকে স্লেট, পেন্সিল, বইখাতা, চক, ব্ল্যাকবোর্ড, গ্লোব, চার্টের বস্তা নিয়ে পৌঁছে যায় গ্রামে৷ সোনারাম আর সরস্বতীর
দায়িত্বে এ মাসের গোড়ায় শুরু হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র৷ যাতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার
দূরে, পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে
প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছনোর ভিতটুকু তৈরি হয় গ্রামের জনা কুড়ি শিশুর৷ গ্রামের মেয়েদের
স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন বোঝানোর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে বালিকা
মুর্মু৷ কিন্তু একমাসের জোগান ফুরিয়ে গেলে পরের মাসে কোথা থেকে সেটা আসবে তা জানা
নেই তার৷ গ্রামে একটা গভীর নলকূপ বসানোর জন্য উদ্যোগী হয়েছেন জেলার পঞ্চায়েত ও
গ্রামোন্নয়ন দফতরের তরুণ আধিকারিক হাসানুর মণ্ডল৷ কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ জোগাড়
করতে কাঠখড় পোড়াতে হবে অনেক৷ মাত্র ষাট হাজার টাকা হলেই রুগরুঘুটুতে বসতে পারে
একটা গভীর নলকূপ৷ বদলে যেতে পারে গ্রামের চালচিত্র৷ কিন্তু তার জন্য সরকারি লাল
ফিতের ফাঁস খুলতে হবে হাসানুরের মতো তরুণ, উদ্যমী সরকারি কর্মীদের৷ পুরুলিয়া শহর থেকে অযোধ্যা পাহাড়
পর্যন্ত রাস্তা এখন কংক্রিটে বাঁধানো৷ রাস্তার দু’পাশ আরও চওড়া করতে কোপ পড়েছে দু’দিকের গাছে৷ শান বাঁধানো রাস্তার পাশেই ঢালাই নিকাশি
নালা৷ শহর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত দু’পাশে পলাশের বন৷ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কুঁড়ি এসেছে
পলাশবনে৷ আর ক’দিন পরেই দোল, পাহাড়ে আগুন লাগবে শিমুল-পলাশের৷ বসন্তের টানে শহর
থেকে পর্যটকেরা ভিড় করবে এই সব পাহাড়তলিতে৷ সাঁ সাঁ করে গাড়ি রাঙা ধুলো উড়িয়ে চলে
যাবে ময়ূর পাহাড়, মুরুগুমা, খয়রাবেড়া বাঁধের দিকে৷ কিন্তু পলাশ ফুটলে মন ভার হয়ে
যায় রুগরুঘুটু, উসুলডুংরির মতো
গ্রামগুলোর৷ পলাশ শেষ হতেই কুয়োর জল শুকোবে ওদের৷ মাথায় হাঁড়ি কলসি নিয়ে খালি পায়ে
হাঁটতে হবে মাইল মাইল জলের খোঁজে৷ খিদে চেপে, তৃষ্ণা বুকে নিয়ে তার মধ্যেও সোনারাম, সরস্বতীরা পড়াশোনা করার লড়াই চালিয়ে যাবে৷ পুরুলিয়ার
গ্রামটিতে এখনও গরমে পানীয় জল মেলে না, দু’টাকার চালে অন্ন-সংস্থান
হয়, তেল-নুনের জন্য
হাঁটতে হয় কয়েক কিলোমিটার৷ এরই মধ্যে চলছে পড়ানো আর পড়াশোনা৷ সোনারাম আর সরস্বতীর
দায়িত্বে এ মাসের গোড়ায় শুরু হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র৷ যাতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার
দূরে, পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে
প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছনোর ভিতটুকু তৈরি হয় গ্রামের জনা কুড়ি শিশুর৷ গ্রামের মেয়েদের
স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন বোঝানোর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে বালিকা
মুর্মু৷
সৌজন্য – এই সময়, শর্মিষ্ঠা রায়, ১৯/০২/২০১৮।
No comments:
Post a Comment