স্কুল ছাড়ার পর অনেক বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তেমন হয়েছিল শিখা মান্ডির সঙ্গেও। স্কুলের অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না
শিখার। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে প্রকাশিত হয় শিখার অনুষ্ঠানের কথা। সকলেই জানতে
পারেন তাঁদের বন্ধু শিখা এখন ‘আরজে শিখা।’জানতে পারেন, ঝাড়গ্রামের একটি এফএম চ্যানেলে নিজের মাতৃভাষা
সাঁওতালিতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন শিখা। সংবাদমাধ্যমে তাঁর কথা জেনে খুবই খুশি বন্ধুরা,
জানালেন শিখা নিজেই। এই খোঁজে সহায়ক হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াও। শিখা জানালেন, ‘‘ফেসবুকে
অনেকে আমাকে খুঁজে যোগাযোগ করেছে। তার মধ্যে একেবারে প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুরাও রয়েছে।
খুবই ভাল লাগছে।”
একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের দিন ঝাড়গ্রামের
একটি এফএম রেডিও স্টেশনে তাঁর সাঁওতালি ভাষার অনুষ্ঠানের কথা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই
অসংখ্য শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন শিখা। যে ‘আরজে’র কাজ দেখে শিখা অনুপ্রাণিত হতেন সেই মীর নিজে
তার অনুষ্ঠান থেকে ফোন করেছিলেন শিখাকে।
মীরের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যে তাঁকে ফোন করবেন তা অবশ্য শিখা
ভাবতেই পারেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমার নিজের কাজের কথা এতজন জানছেন তাতে তো খুবই
ভাল লাগছে, তার থেকেও আমি বেশি উত্তেজিত মীরের মতো একজনের ফোন পেয়ে। আমি বিশ্বাসই করতে
পারিনি যে মীর নিজে আমাকে ফোন করবেন।”
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের দিনও নিজের অনুষ্ঠানে সেই দিন উপলক্ষে
বিশেষ অনুষ্ঠান করেছেন শিখা। সাঁওতালি ভাষার যে লিপি, সেই অলচিকি লিপির আবিষ্কর্তা
রঘুনাথ মুর্মুর স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠান করেছেন বলে জানিয়েছেন শিখা। তবে কেবল রঘুনাথ
মুর্মুই নন, আরও অনেক ব্যক্তিত্বকেই স্মরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এফএমে সাঁওতালি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার যেমন অভিনব, তেমনই
ছকভাঙা মফসসলের কোনও পড়ুয়ার রেডিও জকি হওয়ার ভাবনাও। রেডিও জকি বা আরজে হয়ে যে কেরিয়ার
গড়া যায় সেই সাহস গ্রামবাংলার অনেক ছাত্রছাত্রীই দেখাতে পারেন না। সেখানে শিখা এমন
একটা পেশার কথা কী ভাবে ভাবলেন? তাঁর উত্তর, ‘‘আমি অবশ্য পরিকল্পনা করে এই পেশায় আসিনি।
তবে রেডিও আমার বরাবর ভাল লাগত। ছোটবেলা থেকেই আমি রেডিও শুনতাম।”
আরজে’ হতে গেলে জরুরি
1. যে ভাষা নিয়ে কাজ তার উপরে দখল হল প্রাথমিক শর্ত।
2. নানা ধরনের শ্রোতার সঙ্গে কথা বলার জন্য নানা বিষয় নিয়ে আগ্রহ
ও ধারণা থাকা জরুরি।
3. শুধু কথা বলাই নয়, অন্যকে বলতে দেওয়া ও অন্যের কথা শোনার অভ্যাস
দরকার।
রেডিওর প্রতি ভালবাসা এই পেশার একটা প্রাথমিক চাহিদা। টিভি-ইন্টারনেটের
যুগে এখনও রেডিওর গুরুত্ব রয়েছে। কারণ দেশের এখনও বিরাট অংশের জনগণের কাছে টিভি বা
ইন্টারনেট পৌঁছয়নি। তাঁদের ভরসা সেই রেডিও। তাই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রেডিওয়
জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। টিভি বা ইন্টারনেটের তুলনায় রেডিও কেনা বা ব্যবহার করার
খরচও খুবই কম। সে কারণেই বহু মানুষের কাছে রেডিও প্রয়োজনীয়। তবে কেবল গ্রামাঞ্চলেই
নয়। শহরেও রেডিওর জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাই দেশের একাধিক মেট্রো সিটিতে একাধিক রেডিও চ্যানেল
রয়েছে। তাই রেডিওয় কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখা জানাচ্ছেন, রেডিওয় কাজ করতে হলে রেডিওকে
ভালবাসা যেমন প্রাথমিক শর্ত, তেমনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল পড়াশোনা বা সিলেবাসের
বাইরে নানা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। সেই আগ্রহ থেকেই নানা বিষয় সম্বন্ধে ধারণা
তৈরি করাটাও খুব দরকার। কারণ লাইভ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন বয়সের শ্রোতা ফোন
করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানা বিষয়ে ধারণা থাকা খুবই কাজে দেয়।
শিখার মতে, আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল ভাল শ্রোতা হওয়া।
নিজে বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের কথা শোনার অভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেডিওয় অনেক শ্রোতা
ফোন করেন, তাঁরা কী মানসিক অবস্থায় আছেন সেটা আন্দাজ করে কথা বললে ‘আরজে’ খুব সহজেই
শ্রোতার সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়তে পারেন। ‘রেডিও’কে ভালবাসা যেমন অপরিহার্য, তেমনই অপরিহার্য
ভাষার প্রতি ভালবাসা। শিখার মতে, যে ভাষাতেই কেউ অনুষ্ঠান করুন না কেন, সেই ভাষা সুন্দর,
নির্ভুলভাবে বলাটা খুবই জরুরি। ভাষার উপর দখল যত বেশি থাকবে, ততই একজন ‘আরজে’ভালভাবে শ্রোতার সঙ্গে
যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
তবে আগের থেকে এখন এই পেশা অনেকটাই পরিচিত। বলিউডি নানা জনপ্রিয়
ছবিতেও অনেক রেডিও জকি চরিত্রের দেখা মিলেছে। ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ছবিতে বিদ্যা বালান
ছিলেন একজন রেডিও জকি। সেই বিদ্যারই সাম্প্রতিক ছবি ‘তুমহারি সুলু’খুবই প্রশংসা পায়। সেখানে
তিনি রেডিও জকি। সেই সুলু, অর্থাৎ সুলোচনা দুবে আদতে ছিলেন একজন গৃহকর্ত্রী। কিন্তু
তাঁর বরাবরই ইচ্ছে ছিল কাজ করার। কীভাবে একজন সাধারণ গৃহকর্ত্রী রেডিও জকি হলেও সেই
কাহিনিই বলা হয়েছে ‘তুমহারি সুলু’-তে। শিখা নিজেও দেখেছেন ‘তুমহারি সুলু’। তাঁর মতে,
এই ছবিতে যেভাবে একজন নারীর স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নকে তাঁর নিজের পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে
বাস্তবে পরিণত করা দেখানো হয়েছে তা খুবই অনুপ্রেরণা দেয়। এমন নানা উপাদান থেকে অনুপ্রেরণা
নিয়েই তাঁর আরজে হিসেবে তাঁর যাত্রা চালিয়ে যেতে চান শিখা। চান, আরও যেন চেনা ছক ভেঙে
নিজের যা ইচ্ছে তা নিয়ে এগিয়ে যায়। আর সবাই যেন গর্ব করে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে।
তিনি যেমন বলেন সাঁওতালিতে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, সুজিষ্ণু মাহাতো, ২৫/০২/২০১৮।
No comments:
Post a Comment