দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডিতে মানসিক ভারসাম্যহীন আদিবাসী মহিলাকে গণ ধর্ষণের পর যৌনাঙ্গে ধারালো অস্ত্রের আঘাত, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন মহিলা, ১ জন গ্রেফতার।
শনিবার সন্ধেয় গণধর্ষণের শিকার হন এক যুবতী। তাঁর যৌনাঙ্গে ভোঁতা অস্ত্র ঢুকিয়ে আঘাত করা হয়। স্থানীয় যে বাসিন্দারা তাঁকে প্রথম দেখতে পান, তাঁরা দেখেন, শরীরের কিছু অংশ বেরিয়ে এসেছিল। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই ভাবেই ইছামতী পড়েছিলেন প্রায় ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা। তারপরে তাঁকে কুশমণ্ডি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তারপরে সেখানে অস্ত্রোপচারের পরে তাঁকে নিয়ে যেতে হয় মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘সুপার স্পেশালিটি’ হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও কুশমণ্ডির নির্যাতিতা যুবতীকে কেন রাতারাতি মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হল। একাধিক আদিবাসী সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই প্রশ্ন তুলেছে।
রবিবার বিকেলে ওই তরুণীকে রায়গঞ্জে ভর্তি করায় পুলিশ। অভিযোগ, ধর্ষণের পরে যৌনাঙ্গে ভারী কিছু ঢুকিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে। ফলে, অন্ত্রের অংশ বেরিয়ে পড়ে। সেই তরুণীর দেহে অস্ত্রোপচারের পরে রাতেই কেন মালদহে পাঠিয়ে দেওয়া হল তাই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে আদিবাসী সংগঠন।
একাধিক আদিবাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে সন্দেহ করা হয়েছে, দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতেই মাঝ রাতে রেফার করে দেওয়া হয়েছে। যদিও রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের সুপার গৌতম মণ্ডল বলেছেন, ‘‘রবিবার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ত্রোপচার শুরু হয়। দেহাংশ ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি একটু জটিল হওয়ায় আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয়েছে।’’
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ সেভ ডেমোক্রেসির রাজ্য সম্পাদক চঞ্চল চক্রবর্তী সহ অনেকেই। তাঁদের অভিযোগ, পরিকাঠামো তৈরি না করেই সুপার স্পেশ্যালিটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে কি না, সেটাও সামনে আসা দরকার। তিনি বলেন, ‘‘কুশমণ্ডির ঘটনায় যুক্তদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। সকলকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।’’ চঞ্চলবাবুর দাবি, ‘‘শুধু ২০১৭ সালেই রাজ্যের নানা এলাকায় ২৩ জন আদিবাসী কিশোরী-তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ২ জন। তাদের মধ্যে ৬ জন খুন হয়েছেন। কাজেই একজনকে ধরলে হবে না, পুলিশকে অতি মাত্রায় তৎপর হয়ে সকলকে ধরে সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’’
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মালদহ মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, নির্যাতিতা ওই তরুণীর গোপানাঙ্গে গভীর ক্ষত হয়েছে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে বলে দাবি চিকিৎসকদের। তবে বাইরে থেকে সেই ক্ষত বোঝা যাচ্ছে না। তাই এ দিন সন্ধেয় ওই যুবতীর অস্ত্রোপচার করেন মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্ষত মেরামতের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
আদিবাসী সমাজ ও লোক কল্যাণ মঞ্চের সদস্যরাও এক হাসপাতাল থেকে অন্যত্র ঠেলাঠেলি নিয়ে সরব হয়েছেন। সংগঠনের সভাপতি বুধন হেমব্রম বলেন, ‘‘মরণাপন্নকে নিয়ে এক হাসপাতাল তেকে আরেক জায়গায় ঠেলাঠেলি যে কবে বন্ধ হবে কে জানে! এটা চলতে পারে না।’’ তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে হবে। প্রত্যেকের যাতে সাজা হয় পুলিশকে সেই পদক্ষেপ করতে হবে। আমরা জেলা জুড়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদাও ওই সংগঠনের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারও ভীষণ উদ্বিগ্ন। পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করবে। আমরা নির্যাতিতা আদিবাসী পরিবারের পাশে আছি।’’
এ দিন রায়গঞ্জের সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, ‘‘রাজ্যে খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাস বাড়ছে! পুলিশ, প্রশাসন ও রাজ্য সরকার নির্বিকার। কুশমণ্ডির ধর্ষণের ঘটনায় নির্ভয়াকাণ্ডের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।’’
বাবা-মা মারা গিয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। একাই থাকতেন একটি কুঁড়েতে। বছর আঠাশের সেই যুবতীকে শনিবার রাতে গণধর্ষণ করা হয়েছে। তারপরে দিল্লির নির্ভয়ার মতো তাঁর যৌনাঙ্গেও ধাতব কিছু ঢুকিয়ে আঘাত করা হয়। সঙ্কটজনক অবস্থায় তিনি এখন মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। অবস্থা এতটা সঙ্কটজনক হত না, যদি আরও তাড়াতাড়ি তিনি চিকিৎসার সুযোগ পেতেন। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক মুখে এই ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে জেলা পুলিশ-প্রশাসনও।
দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির দেহাবন্ধ হাটপাড়ার এই যুবতীর দিন চলে প্রতিবেশীদের সাহায্যে। একা একা ঘুরে বেড়ান। শনিবার গিয়েছিলেন পতিরাজ এলাকায় শিবরাত্রির মেলায়। সন্ধে নাগাদ তাঁকে ইছামতী সেতুর নীচে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। তারপরে রবিবার বিকেল তিনটে পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিলেন। কোনও ভবঘুরে শুয়ে আছে ভেবে প্রথমে কেউ আমল দেননি। পরে কয়েক জন কৃষকের সন্দেহ হয়। কাছে গিয়ে রক্তে ভেসে যাওয়া নগ্ন দেহ দেখে শিউরে ওঠেন তাঁরা।
তাঁকে তখন কুশমণ্ডি গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার প্রায় ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পরে সেখানেই তিনি প্রথম বার চিকিৎসা পান। তবে ওই হাসপাতাল থেকে তাঁকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রেফার করে দেওয়া হয় রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে। সেখানে তিন ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচারও হয়। কিন্তু বিপদ কাটেনি দেখে রবিবার রাত দু’টো নাগাদ তাঁকে পাঠানো হয় মালদহ মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে মেডিক্যাল টিম গড়ে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। সোমবার সন্ধেয় আবার অস্ত্রোপচারও হয়। মেডিক্যালের সুপার অমিতকুমার দাঁ বলেন, ‘‘তরুণীকে ৭২ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না ’’
পুলিশ সোমবার দেহাবন্ধ এলাকারই এক জনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার দু’দিন পরেও কেন সকলকে পাকড়াও করা যায়নি। তা ছাড়া, কুশমণ্ডি থানা খবর পেয়েও প্রথমে যেতে গড়িমসি করে বলে অভিযোগ। পুলিশের কাছে লিখিত ভাবে গ্রামবাসীরা দাবি করেছেন, তাঁরাই অটো করে ওই যুবতীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আদিবাসী সংগঠনের নেতা বুধন হেমব্রমের দাবি, ‘‘পুলিশ তৎপর ছিল না। তাই এই অবস্থা।’’ রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অবশ্য বলেছেন, ‘‘পুলিশ খবর পাওয়ার পরপরই ওই যুবতীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।’’ সেই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘যৌন নিগ্রহের ঘটনা সহ্য করা হবে না। কড়া ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।’’
কুশমণ্ডির গণধর্ষিতা যুবতী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ১৮ ঘণ্টা পড়েছিলেন ইছামতী সেতুর নীচে। স্থানীয় লোকজনেরাই তাঁকে প্রথম দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কুশমণ্ডি থানায় খবর দেন। কিন্তু পুলিশ আসছে না দেখে ওই তরুণীকে তাঁরাই সকলে মিলে কুশমণ্ডির গ্রামীণ হাসপাতালে পাঠান। মামলা রুজু করে তদন্তের কাজেও তাদের গাফিলতি রয়েছে বলে পুলিশের দিকে আঙুল তুলেছেন গ্রামবাসীরা। প্রশ্ন উঠেছে, কেন তারা এত দেরি করল?
অভিযোগ, শনিবার রাতে স্থানীয় একটি মেলা থেকে ওই তরুণীকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। একই সঙ্গে তাঁর উপরে চলে অকথ্য অত্যাচার। তার পরে ওই সেতুর তলায় তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায় তারা। তরুণীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো এবং মামলা রুজু করতে এত সময় কেন লাগল, এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী নেতারা। একই প্রশ্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতাদেরও। প্রকাশ্যে না বললেও ঘরোয়া আলোচনায় শাসকদলের নেতাদের কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আদিবাসী নেতাদের বক্তব্য, দু’দিনের মধ্যে জেলায় আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে যাতে বিষয়টি নিয়ে বেশি শোরগোল না হয়, সে জন্য পুলিশ এই নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে। একই ভাবে সিপিএম জেলা সম্পাদক নারায়ণ বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘প্রথম দিকে ঘটনাটি চেপে যেতে সব রকম চেষ্টা করেছিল পুলিশ। ফলে শনিবার রাতে ঘটনার পর রবিবার বিকেল নাগাদ নির্যাতিতাকে উদ্ধার করা হয়। তার পরেই পুলিশ কেন মামলা করল না ? ’’
সোমবার অবশ্য পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধর্ষণের মামলা দায়ের করে।
বিজেপির জেলা সভাপতি শুভেন্দু সরকারের অভিযোগ, ‘‘ দু’দিন আগে গঙ্গারামপুরে দশম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়। তখনও গঙ্গারামপুর থানার পুলিশ প্রথমে অভিযোগ না নিয়ে নির্যাতিতা কিশোরীর মামাকে থানা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুলিশের এই ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা বর্তমানে বেড়ে গিয়েছে। কুশমণ্ডির ঘটনাতেও সেটাই প্রথমে দেখা গেল।’’
জেলা পুলিশ সুপারকে দিনভর ফোন ও মেসেজ করা হলেও তাঁর কাছ থেকে কোনও জবাব মেলেনি। পরে অবশ্য আইজি (আইনশৃঙ্খলা) এক বার্তায় জানান, ‘‘এই ধরনের যৌন অত্যাচারের ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’’ তিনিই জানিয়েছেন, ঘটনায় এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষোভ পুরোপুরি প্রশমিত করা যায়নি।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০/০২/২০১৮।
No comments:
Post a Comment