Monday, February 26, 2018

কুশমণ্ডির ধর্ষণ-কাণ্ডে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব আদিবাসীরা।


এ বার কুশমণ্ডিতে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ সামাজিক সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল’। এ ব্যাপারে সাংগঠনিকস্তরে সিদ্ধান্ত নিয়ে আদিবাসী সংগঠনটি সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং এলাকায় পোস্টার দিয়ে জানিয়েছে, আদিবাসী বিধায়ক ও সাংসদেরা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বিধানসভায় ঘটনার প্রতিবাদ না জানালে আদিবাসী এলাকায় তাঁদের যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়। ভোট চাইতে গেলে জাতীয় অস্ত্র (তির ধনুক) নিয়ে ওই জনপ্রতিনিধিদের তাড়া করার নিদান দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে ওই সব আদিবাসী জনপ্রতিনিধিদের আদিবাসী সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
আদিবাসী এই সংগঠনের মুখপাত্র রবিন টুডু জানান, ফেসবুকের মাধ্যমে এবং এলাকায় পোস্টার দিয়ে আদিবাসী জনগণের প্রতি এই আবেদন জানানো হচ্ছে। রবিনবাবু বলেন, “আমাদের ভোটে জিতে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কোনও ভাবেই বরদাস্ত করব না। বিধায়ক, সাংসদরা তো আমাদের কথা ভাবেনই না। এলাকার সাংসদ তো গত পাঁচ বছরে আদিবাসী মানুষের জন্য একটা শব্দও খরচ করেননি।”
ঘটনা হল, বছর খানেক ধরে সাঁওতালি শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল পরিকাঠামো নিয়ে ক্ষুব্ধ জঙ্গলমহলের আদিবাসী সমাজ। আদিবাসী সংগঠনটির পক্ষ থেকে বার কয়েক পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার প্রশাসনিক মহলে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। গত বছর সরকারি ‘হুল দিবস’ বয়কট করেন আদিবাসীরা। মাতৃভাষায় পড়াশোনার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ার দাবিতে গত দশ মাসে জঙ্গলমহলে বিক্ষোভ-অবরোধ কর্মসূচি, স্কুলে তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো নানা আন্দোলন করেছেন আদিবাসীরা।
আদিবাসীদের ক্ষোভে প্রলেপ দিতে দু’বার তাঁদের সামাজিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু সাঁওতালি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে স্থায়ী শিক্ষক ও পরিকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে সরকারিস্তরে গড়িমসি হচ্ছে বলে অভিযোগ আদিবাসীদের। কুশমণ্ডির ঘটনায় ফের ক্ষোভ ছড়িয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে। দু’দিন আগেই অরণ্যশহরে মিছিল করেছেন আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা। এবার আদিবাসী সংগঠনটির পক্ষে রবিনবাবু সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাতে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে শাসক দল। ঝাড়গ্রামের বিধায়ক তথা ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি সুকুমার হাঁসদা বলেন, “পোস্টারের বিষয়ে কিছু জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব। মুখ্যমন্ত্রী ও আমাদের দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুশমণ্ডি নিয়ে যা বলার বলেছেন।”
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬/০২/২০১৮।

Sunday, February 25, 2018

‘ভাত চুরি করায়’ আদিবাসী যুবককে পিটিয়ে খুন! উঠল সেল্‌ফিও।


যে দেশে নীরব মোদীরা সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি করেও আইনের নাগাল এড়িয়ে যেতে পারেন, সেই দেশেই ভাত চুরির অভিযোগ উঠলে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে পিটিয়ে মারা হয় যুবককে!
ভাত চুরির অভিযোগে এক আদিবাসী যুবককে গাছে বেঁধে গণপিটুনি দিতে দিতে মেরে ফেলা হল। গণপ্রহারের সেল্‌ফিও তুললেন অনেকে। কেরলের আত্তাপাড়ি জেলার ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম মধু (৩০)। মানসিক ভারসাম্য হীন। বনে-বাদাড়েই তিনি ঘুরে বেড়াতেন। কোনও দিন খাবার জুটলে খেতেন, না পেলে ভুখা পেটেই দিন গুজরান হত। নমাস তিনি ঘরছাড়া।
বৃহস্পতিবার আত্তাপাড়ি এলাকার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। এক আদিবাসী যুবককে গাছে বেঁধে মারা হচ্ছে, এমনটাই দেখা গিয়েছে সেই ভিডিওয়। মারের চোটে যত কাতর হচ্ছেন আদিবাসী যুবক, উত্তেজনা-উল্লাস ততই বাড়ছে তাঁকে ঘিরে জড়ো হওয়া ভিড়টার মধ্যে। ভিডিওয় তেমনও দেখা গিয়েছে। যারা মারধর করছিল, তাদের কেউ কেউ ভিডিও করছিল। আবার কেউ ওই যুবকের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বিকারে সেল্‌ফি তুলছিলেন! পরে জানা যায়, বেধড়ক মারধরের পর মধুকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। গুরুতর জখম মধুকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ, তখন তাঁর রক্তবমি শুরু হয়। তার পরেই মৃত্যু হয়।
ছেলের মৃত্যুর খবরটা মা মল্লির কাছে যখন পৌঁছয়, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতেই বলে চলেন, ছেলেটা বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেশ তো জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল। যা পেত, তাই খেত। মনকে অন্তত এটা বলে আশ্বস্ত করতে পারতাম যে ছেলেটা তো বেঁচে আছে। কিন্তু ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল!
কেরল পুলিশের ডিজি লোকনাথ বেহরা অপরাধীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “চুরির ঘটনা ঘটলেও অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত জনগণের। আইনকে হাতে নেওয়া কখনওই উচিত নয়।পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, “পিটিয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা কেরলের সমাজের সঙ্গে খাপ খায় না। যদিও দেশের অন্যান্য প্রান্তে এমন ঘটনা আকছার ঘটছে! এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক একটা ঘটনা। সংযত হওয়া উচিত মানুষের।
কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চান্ডি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, “এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটার পরেও কেন পুলিশ দেরি করছে? তারা কি কাউকে ভয় পাচ্ছে? যত দ্রুত সম্ভব কড়া ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কেরল বিধানসভার বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিথালা আবার বলেছেন, “রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা গোটা কেরল সমাজের অপমান।পালাক্কড়ের বাম সাংসদ এম বি রাজেশ ফেসবুকে লিখেছেন, “আত্তাপাড়ির এই গণপিটুনি সত্যিই বেদনাদায়ক। কেরলকে উত্তর ভারত বানাবেন না। এটা কেরলের গণতান্ত্রিক এবং বিচারবোধের উপর আক্রমণ।
প্রখ্যাত লেখক ও সমাজকর্মী সারা জোসেফ ফেসবুকে জানিয়েছেন, “এটা মালয়ালি সমাজের একটা নিষ্ঠুর মুখ। বুভুক্ষু এবং গরিবদের প্রতি এমন আচরণে সত্যিই ভীত, সন্ত্রস্ত। ছেলেটি শুধু ভাত চুরি করেছিল, তা-ও নিজের খিদে মেটাতে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩/০২/২০১৮।  

Saturday, February 24, 2018

মাতৃভাষায় কথা বললে তো এখন হেয় করা হয় : মীর (আরজে ও অভিনেতা)।


ভাবতেই পারেননি শিখা মান্ডি, সাঁওতালি ভাষার রেডিয়ও জকি। যাঁর কাজ তাঁকে অনুপ্রাণিত করত, সেই মীর নিজের অনুষ্ঠানে তাঁকে ফোন করবেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের সকালে নিজের অনুষ্ঠানে শিখার কথা, তাঁর কাজের কথা বলেছেন মীর। ঝাড়গ্রামে শিখাকে ফোন করে কথাও বলেছেন স্টুডিও থেকে। সেই কথোপকথন সম্প্রচারিতও হয়েছে রেডিওয়। মীরের মতে, শিখা যে কাজ করে চলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে অনেককে হেয় করা হয়। মীরের মতে, নিজের ভাষায় কথা বললে তা নিয়ে অন্য লোক মজা করছে, এটা অত্যন্ত আপত্তিজনক। এরকম হেয় করাটা সহ্য করা যায় না। তা বন্ধ করতে অনুষ্ঠান থেকে বার্তাও দিয়েছেন তিনি। মীরের কথায়, ‘‘সবার অধিকার আছে মাতৃভাষায় গর্ব করে কথা বলার।’’
শিখার সাঁওতালি ভাষায় অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গে মীর স্মৃতিচারণে মশগুল হয়ে পড়েছিলেন। রেডিওয় সাঁওতালিতে অনুষ্ঠান শোনার কথা মনে করেন তিনি। মীর জানিয়েছেন, ছোটবেলায় রেডিওয় নাটক শোনার নেশা ছিল তাঁর। তখনও এফএম চ্যানেল আসতে অনেক দেরি। আকাশবাণীতে সেই সময়ে বাংলা নাটক হতো। সেই সঙ্গে সম্প্রচারিত হতো সাঁওতালি নাটকও। তিনি সব ধরনের নাটকই শুনতেন। ভাষা বুঝতেন না। কিন্তু কোথায় যেন একটা শিকড়ের গন্ধ মিশে থাকত সেই নাটকে। মীরের কথায়, ‘‘ভাষা বুঝতাম না। কিন্তু নাটকের মধ্যে মধ্যে যে গানের সুর, মিউজিক, সেটা অদ্ভুত ভাল লাগত। সুরের মধ্যে যে অদ্ভুত মাটির টান রয়েছে, সেটা বোঝা যেত।’’
এই মাটির ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখাই এখন খুব দরকার বলে মনে করেন মীর। তিনি বলেন, ‘‘এখন সব জায়গাতেই জাতীয় ভাষা কী তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এমনকী, গানের ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক ভাষার গান যেন দ্বিতীয় সারিতে। তাই প্রাদেশিক ভাষায় যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
এই গুরুত্ব ভারতে সব সময় দেওয়া না হলেও বিদেশে কিন্তু তা দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন মীর। তিনি বললেন, ‘‘ইউরোপে ঘোরার সময় দেখেছি সেখানে কোনও দেশের মানুষ সেই দেশের ভাষাতেই কথা বলেন। মাতৃভাষায় কথা বলতে তাঁরা অসম্ভব গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু ভারতে তা হয় না। এখানে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললে, ইংরেজি-হিন্দি না জানলে হেয় করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’
দেশে এমন সমস্যা অবশ্য দীর্ঘদিনের। খবরের কাগজে মাঝে মাঝেই এই ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। ভাষাগত সমস্যায় উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো থেকে পড়তে যাওয়া পড়ুয়াদের দিল্লি-সহ বেশ কিছু রাজ্যে নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। বারবার এই অভিযোগ উঠেছে।
এমন নানা সমস্যায় অনেকে প্রকাশ্যে মাতৃভাষা বলতে কুণ্ঠিত হন বলে শিখা নিজেও বুঝেছেন। তাই নিজের অনুষ্ঠানে তিনি সকলকে বলেন সাঁওতালি জানলে সাঁওতালিতেই কথা বলতে।
পড়াশোনা বা কাজের জন্য অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে কথা মেনেও মীর মনে করেন, মাতৃভাষার চর্চা করা অবশ্যই উচিত। মাতৃভাষার এই গুরুত্ব বুঝে দীর্ঘদিন ধরেই আঞ্চলিক এবং প্রাদেশিক ভাষায় বিজ্ঞাপন করে বহুজাতিক অনেক সংস্থাই। হলিউডি ছবিও ডাবিং করা হয় তামিল, তেলুগুর মতো প্রাদেশিক ভাষায়। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন ওয়েবসাইটও নানা আঞ্চলিক ভাষায় কনটেন্টপৌঁছে দিচ্ছে ইদানীং। তাই আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব কমেছে, এই ধারণা ঠিক নয়।
মীর তাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘কেউ ইংরাজি না জানলে তাঁর জীবন বৃথা এই ধারণা একেবারেই ভুল।’’ মীরের বক্তব্য পরিষ্কার, কেউ যদি মাতৃভাষা গর্ব করে বলেন তার চেয়ে ভাল কিছু হয় না।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫/০২/২০১৮।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবার সাঁওতালি ভাষায়।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬৫টি অমূল্য কবিতার সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি হরফে অনূদিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাষাদিবসে রবিগাঁথার ওই ৬৫টি কবিতার সংকলন (বই)‌ প্রকাশিত হয়। সাঁওতালি ভাষায় বইটির নাম রাখা হয়েছে ‘‌রবিগালাং টুগেমঁড়’। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পুরুলিয়ার সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঁওতালি বিভাগ দ্বারা প্রকাশিত এই বইয়ের উদ্ধোধন করেন পুরুলিয়ার সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপকরঞ্জন মণ্ডল। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার নচিকেতা ব্যানার্জি, বইটির সম্পাদক শ্রীপতি টুডু ও সোনালি মুখার্জিসহ বাংলা ও সাঁওতালি বিভাগের অধ্যাপকরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৬৫টি কবিতা সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্য আকাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ সাঁওতালি আকাডেমি থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই কবিসহ সাতজন বিশিষ্ট সাঁওতালি কবি ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামচরণ হেমব্রম, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অঞ্জন কর্মকার ও পুরুলিয়ার সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীপতি টুডু। অধ্যাপক শ্রীপতি টুডু বলেন, ‘‌বিশ্বকবির বিখ্যাত কবিতা মরীচিকা, বর্ষার দিনে, অনন্ত প্রেম, জীবনদেবতা, ১৪০০ সাল, পরিচয়, দিদি, পরশমণি, লুকোচুরিসহ বিখ্যাত ৬৫টি কবিতা সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি হরফে অনুবাদ করা হয়েছে। বিশ্বকবির কবিতার এই সাঁওতালি অনুবাদে সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে’। তিনি এদিন আরও বলেন, ‘বর্তমানে ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালির ভাষাদিবস নয়। এই দিনটি আন্তর্জাতিক ভাষাদিবস। তাই ‌আমাদের এই বই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত। সাঁওতালি ভাষায় অনুবাদ করা এই বই প্রকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্টারসহ বাংলা ও সাঁওতালি বিভাগের অধ্যাপকদের সহযোগিতা রয়েছে’।
সৌজন্য – আজকাল পত্রিকা, দীপেন গুপ্ত, ২৫/০২/২০১৮।

ভয়, প্রলোভন দেখিয়ে আদিবাসীদের জমি কেনার অভিযোগ বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে।


ভয় ও প্রলোভন দেখিয়ে জমি কিনে নেওয়ার অভিযোগ উঠল খড়গপুর একনম্বর ব্লকের বড়কোলা ও কলাইকুন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কয়েকটি মৌজায়৷ অভিযোগের তির রশ্মি মেটালিক্স কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরু‌দ্ধে। অভিযোগ, বড়কোলা ও কলাইকুন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের সামরাইপুর, নন্দারচক, খান্ডারচক বহরাপাট-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জমি ভুল বুঝিয়ে নেওয়া হচ্ছে৷ আর যাঁরা জমি দিতে রাজি হচ্ছেন না, তাঁদের কাছে বেসরকারি সংস্থাটি দালাল পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ তার সঙ্গে নানারকম প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে ব্যাপক চাপ তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ৷ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
জমি দখলের বিরোধিতা করার জন্য অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের জেলা সভাপতি তারক বাগকে ইতিমধ্যে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি-চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ৷ তবে এই চিঠি তাঁকে গত বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেই সময়ে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপারকে অভিযোগ জানানোর পরেও কোনও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ৷ তাই ফের বৃহস্পতিবার তিনি জেলা পুলিশ সুপারকে ওই চিঠিগুলির বিষয়ে নতুন করে অভিযোগ জানিয়েছেন৷ তিনি সাফ জানিয়েছেন, এইরকমভাবে রশ্মি মেটালিক্স কারখানা কর্তৃপক্ষ জুলুমবাজি করলে বাধ্য হয়ে তাঁরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন৷ সামরাইপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজিত কারকের অভিযোগ, তাঁদের জমিতে বছরে দুবার ধান চাষ করা হয়৷ এই বিরাট জমি নেওয়ার জন্য এখন কারখানা কর্তৃপক্ষ দালালদের ভিড়িয়ে দিয়েছে৷ তারাই এখন চাপ সৃষ্টি করছে জমিটা বিক্রি করে দিতে৷ জমি দিতে রাজি না হওয়ায় এখন কারখানা কর্তৃপক্ষ পাশের কেনা জমির উপরে কারখানার অন্য একটা ইউনিট থেকে ছাই নিয়ে এসে ঢেলে রাখছে৷ আর এর ফলে তাঁর জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি৷
ধুলিয়াচকের বাসিন্দা দিলীপ কোটাল জানিয়েছেন, খাঞ্জারচকে তাঁদেরও জমি রয়েছে৷ উপযুক্ত দাম না পেলে জমি বেচবেন না৷ সামরাইপুরের বাসিন্দা গৃহশিক্ষক রাজীব মণ্ডল জানিয়েছেন, তাঁরা জমি দিতে রাজি নন৷ কিন্তু দালালরা তাঁদের পরিবারের উপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করছেন জমি বিক্রি করে দিতে৷ রশ্মি মেটালিক্সের এক পদস্থ কর্তা মুকুটমণি ঘোষ বলেন, “এইসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷ যাঁরা জমি দিয়ছেন তাঁরা স্বেচ্ছায় দিয়েছেন৷ কোনও ভয় দেখানো কিংবা প্রলোভন দেওয়া হয়নি৷ খড়গপুরের মহকুমা শাসক সুদীপ সরকার বলেন, “এই ধরনের জমি দখলের অভিযোগের চিঠি এসেছে কি না, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে৷জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “প্রাণনাশের হুমকির কোনও অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে৷ তবে খড়গপুর গ্রামীণ থানায় জমি জবরদখল নিয়ে কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
সৌজন্য – সংবাদ প্রতিদিন, ২৪/০২/২০১৮।

কুশমণ্ডি গণধর্ষণ কাণ্ডে তির-ধনুক নিয়ে আন্দোলনে পথে আদিবাসীরা।


কুশমণ্ডির ধর্ষণ ও নির্যাতন কাণ্ডে ধৃতদের বাড়িঘর পোড়ানোর পর এবার রাস্তায় নেমে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করল আদিবাসীরা। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে দিনভর বিক্ষোভ, মিছিল, রাস্তা অবরোধ এবং পথসভায় শনিবার কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাপন। যদিও আগেভাগে পুলিশ কড়া নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করে রাখায় বড়সড় কোনও অঘটন ঘটেনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, শনিবার সকাল থেকেই গঙ্গারামপুর এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী মানুষজন। হাতে তির-ধনুক নিয়ে ৫১২ নম্বর জাতীয় সড়কে অবরোধ শুরু করেন তাঁরা। এরপর গঙ্গারামপুর বাসস্ট্যান্ড চৌমাথা এলাকা অবরোধ করে বিক্ষোভ সভা করা হয়। সেই সভায় অবশ্য শামিল হন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদা। তিনি সকলকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের আরজি জানান। আদিবাসীদের এই আন্দোলনের জেরে দীর্ঘক্ষণ বন্ধ হয়ে পড়ে জাতীয় সড়ক। দীর্ঘক্ষণ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে বহু যানবাহন। ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন আদিবাসী মহিলা ধর্ষণের প্রতিবাদ এবং দোষীদের ফাঁসির দাবি তোলা হয়।
আন্দোলনকারী আদিবাসী সংগঠন আসেকার সভাপতি নৃপ্রেন্দ্রনাথ হেমব্রম বলেন, “গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কুশমণ্ডিতে আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গঙ্গারামপুরে ধিক্কার মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করা হয়েছে। রুখে না দাড়ালে দিন দিন আমাদের সম্প্রদায়ভূক্ত মহিলাদের বারবার ধর্ষণ ও নির্যাতন আটকানো যাবে না। এর আগে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, কুশমণ্ডির লোহাগঞ্জ এবং তারপর ফের দেহাবন্দ এলাকা তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ। দোষীদের ফাঁসি দিলে পরবর্তীতে আর কেউ এই ধরনের কাজ করার সাহস পাবে না।
মন্ত্রী বাচ্চু হাঁসদা বলেন, কুশমণ্ডির ঘটনা নিন্দনীয়। ঘটনায় জড়িত দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হিংসা নয়, শান্তিতে আন্দোলন চলুক সেই আবেদন তিনি। দোষীদের শাস্তি হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্যদিকে, শুক্রবার ধৃতদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার সময় থেকেই কুশমণ্ডির দেহাবন্ধ এলাকায় বিরাট পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শনিবারও গোটা এলাকা থমথমে ছিল। স্থানীয় থানার অফিসারদের পাশাপাশি বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে এলাকায় টহল দিচ্ছেন মহকুমা পুলিশ আধিকারিক বিপুল বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে এদিন মালদহ মেডিক্যালে কুশমণ্ডির নির্যাতিতাকে দেখতে যান রায়গঞ্জের সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। সঙ্গে ছিলেন বিধায়ক খগেন মুর্মু এবং দলের মালদহ জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু পুলিশ তাঁদের ওই নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। ফলে হাসপাতালেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাংসদ। কিছুক্ষণ হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসেন তাঁরা।
সৌজন্য – সংবাদ প্রতিদিন, রাজা দাস, ২৫/০২/২০১৮।

সাঁওতালি ভাষার ‘রেডিও জকি’ শিখা মান্ডি।


স্কুল ছাড়ার পর অনেক বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তেমন হয়েছিল শিখা মান্ডির সঙ্গেও। স্কুলের অনেক পুরনো বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না শিখার। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে প্রকাশিত হয় শিখার অনুষ্ঠানের কথা। সকলেই জানতে পারেন তাঁদের বন্ধু শিখা এখন ‘আরজে শিখা।জানতে পারেন, ঝাড়গ্রামের একটি এফএম চ্যানেলে নিজের মাতৃভাষা সাঁওতালিতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন শিখা। সংবাদমাধ্যমে তাঁর কথা জেনে খুবই খুশি বন্ধুরা, জানালেন শিখা নিজেই। এই খোঁজে সহায়ক হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াও। শিখা জানালেন, ‘‘ফেসবুকে অনেকে আমাকে খুঁজে যোগাযোগ করেছে। তার মধ্যে একেবারে প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুরাও রয়েছে। খুবই ভাল লাগছে।”
একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের দিন ঝাড়গ্রামের একটি এফএম রেডিও স্টেশনে তাঁর সাঁওতালি ভাষার অনুষ্ঠানের কথা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই অসংখ্য শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন শিখা। যে ‘আরজের কাজ দেখে শিখা অনুপ্রাণিত হতেন সেই মীর নিজে তার অনুষ্ঠান থেকে ফোন করেছিলেন শিখাকে।
মীরের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যে তাঁকে ফোন করবেন তা অবশ্য শিখা ভাবতেই পারেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমার নিজের কাজের কথা এতজন জানছেন তাতে তো খুবই ভাল লাগছে, তার থেকেও আমি বেশি উত্তেজিত মীরের মতো একজনের ফোন পেয়ে। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি যে মীর নিজে আমাকে ফোন করবেন।”
আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের দিনও নিজের অনুষ্ঠানে সেই দিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান করেছেন শিখা। সাঁওতালি ভাষার যে লিপি, সেই অলচিকি লিপির আবিষ্কর্তা রঘুনাথ মুর্মুর স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠান করেছেন বলে জানিয়েছেন শিখা। তবে কেবল রঘুনাথ মুর্মুই নন, আরও অনেক ব্যক্তিত্বকেই স্মরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এফএমে সাঁওতালি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার যেমন অভিনব, তেমনই ছকভাঙা মফসসলের কোনও পড়ুয়ার রেডিও জকি হওয়ার ভাবনাও। রেডিও জকি বা আরজে হয়ে যে কেরিয়ার গড়া যায় সেই সাহস গ্রামবাংলার অনেক ছাত্রছাত্রীই দেখাতে পারেন না। সেখানে শিখা এমন একটা পেশার কথা কী ভাবে ভাবলেন? তাঁর উত্তর, ‘‘আমি অবশ্য পরিকল্পনা করে এই পেশায় আসিনি। তবে রেডিও আমার বরাবর ভাল লাগত। ছোটবেলা থেকেই আমি রেডিও শুনতাম।”

আরজে হতে গেলে জরুরি
1.  যে ভাষা নিয়ে কাজ তার উপরে দখল হল প্রাথমিক শর্ত।
2.  নানা ধরনের শ্রোতার সঙ্গে কথা বলার জন্য নানা বিষয় নিয়ে আগ্রহ ও ধারণা থাকা জরুরি।
3.  শুধু কথা বলাই নয়, অন্যকে বলতে দেওয়া ও অন্যের কথা শোনার অভ্যাস দরকার।

রেডিওর প্রতি ভালবাসা এই পেশার একটা প্রাথমিক চাহিদা। টিভি-ইন্টারনেটের যুগে এখনও রেডিওর গুরুত্ব রয়েছে। কারণ দেশের এখনও বিরাট অংশের জনগণের কাছে টিভি বা ইন্টারনেট পৌঁছয়নি। তাঁদের ভরসা সেই রেডিও। তাই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রেডিওয় জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। টিভি বা ইন্টারনেটের তুলনায় রেডিও কেনা বা ব্যবহার করার খরচও খুবই কম। সে কারণেই বহু মানুষের কাছে রেডিও প্রয়োজনীয়। তবে কেবল গ্রামাঞ্চলেই নয়। শহরেও রেডিওর জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাই দেশের একাধিক মেট্রো সিটিতে একাধিক রেডিও চ্যানেল রয়েছে। তাই রেডিওয় কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিখা জানাচ্ছেন, রেডিওয় কাজ করতে হলে রেডিওকে ভালবাসা যেমন প্রাথমিক শর্ত, তেমনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল পড়াশোনা বা সিলেবাসের বাইরে নানা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। সেই আগ্রহ থেকেই নানা বিষয় সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করাটাও খুব দরকার। কারণ লাইভ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন বয়সের শ্রোতা ফোন করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানা বিষয়ে ধারণা থাকা খুবই কাজে দেয়।
শিখার মতে, আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল ভাল শ্রোতা হওয়া। নিজে বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের কথা শোনার অভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেডিওয় অনেক শ্রোতা ফোন করেন, তাঁরা কী মানসিক অবস্থায় আছেন সেটা আন্দাজ করে কথা বললে ‘আরজে’ খুব সহজেই শ্রোতার সঙ্গে মানসিক সংযোগ গড়তে পারেন। ‘রেডিওকে ভালবাসা যেমন অপরিহার্য, তেমনই অপরিহার্য ভাষার প্রতি ভালবাসা। শিখার মতে, যে ভাষাতেই কেউ অনুষ্ঠান করুন না কেন, সেই ভাষা সুন্দর, নির্ভুলভাবে বলাটা খুবই জরুরি। ভাষার উপর দখল যত বেশি থাকবে, ততই একজন ‘আরজেভালভাবে শ্রোতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
তবে আগের থেকে এখন এই পেশা অনেকটাই পরিচিত। বলিউডি নানা জনপ্রিয় ছবিতেও অনেক রেডিও জকি চরিত্রের দেখা মিলেছে। ‘লগে রহো মুন্নাভাইছবিতে বিদ্যা বালান ছিলেন একজন রেডিও জকি। সেই বিদ্যারই সাম্প্রতিক ছবি ‘তুমহারি সুলুখুবই প্রশংসা পায়। সেখানে তিনি রেডিও জকি। সেই সুলু, অর্থাৎ সুলোচনা দুবে আদতে ছিলেন একজন গৃহকর্ত্রী। কিন্তু তাঁর বরাবরই ইচ্ছে ছিল কাজ করার। কীভাবে একজন সাধারণ গৃহকর্ত্রী রেডিও জকি হলেও সেই কাহিনিই বলা হয়েছে ‘তুমহারি সুলু’-তে। শিখা নিজেও দেখেছেন ‘তুমহারি সুলু’। তাঁর মতে, এই ছবিতে যেভাবে একজন নারীর স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নকে তাঁর নিজের পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাস্তবে পরিণত করা দেখানো হয়েছে তা খুবই অনুপ্রেরণা দেয়। এমন নানা উপাদান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই তাঁর আরজে হিসেবে তাঁর যাত্রা চালিয়ে যেতে চান শিখা। চান, আরও যেন চেনা ছক ভেঙে নিজের যা ইচ্ছে তা নিয়ে এগিয়ে যায়। আর সবাই যেন গর্ব করে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে। তিনি যেমন বলেন সাঁওতালিতে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, সুজিষ্ণু মাহাতো, ২৫/০২/২০১৮।

আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত গোপিনাথ মান্ডির নামে আবাস যোজনায় অর্থ বরাদ্দ হলেও তিনি টাকা পাননি।


পুরুলিয়ার কাশীপুরে আবাস যোজনায় ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ সামনে আনলেন বিজেপি নেতা। দুই বছর আগে আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত গোপিনাথ মান্ডির নামে আবাস যোজনায় অর্থ বরাদ্দ হলেও তিনি টাকা পাননি।

টালি ও মাটির আধভাঙা ঘরে কোনওরকমে ছেলে-বৌ নিয়ে তিনি বাস করেন। অথচ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, ইন্দিরা আবাস যোজনায় তাঁর নামে তিন কিস্তিতে বরাদ্দ হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এমনকী সেই নতুন ঘরের ছবিও রয়েছে ওয়েবসাইটে। তাহলে সেই ঘর গেল কোথায়? টাকাই বা কে পেল? এই প্রশ্ন তুলে কাশীপুরের কালীদহ পঞ্চায়েতের লহাট গ্রামের দিনমজুর গোপীনাথ মান্ডি জেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। তদন্ত চেয়ে আর্জি জানিয়েছেন পুরুলিয়া আদালতেও।
তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে গোপীনাথ ও ফুলমণির সংসার। এলাকায় কাজের সুবিধা না থাকায় স্বামী-স্ত্রীতে আসানসোলে দিনমজুরের কাজে যান। দিনভর কাজ করে দেড়শো টাকার মতো রোজগার করেন। তাই কিছু দিন আগে যখন তিনি জানতে পারেন, বছর দুয়েক আগে তিনি ইন্দিরা আবাসে ঘর পেয়েছেন বলে সরকারি খাতায় উল্লেখ রয়েছে, তখন কার্যত আকাশ থেকে পড়েন।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) অরিন্দম দত্ত বলেন, ‘‘ঘটনাটি আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগের। তবে অভিযোগ হাতে এলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে এবং গাফিলতি প্রমাণিত হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এলাকার বাসিন্দা তথা বিজেপি-র কাশীপুর ব্লকের নেতা হরেন্দ্রনাথ মাহাতোই প্রথম গোপীনাথের নজরে ওই বেনিয়মের ঘটনাটি নিয়ে আসেন। তিনি এর আগে ওই ওয়েবসাইট ঘেঁটে কালীদহ পঞ্চায়েতেরই কেলাহি গ্রামের এক বাসিন্দার নামে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে একই রকমের দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। হরেন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘ওয়েবসাইটে গোপীনাথবাবুর নামে ইন্দিরা আবাসের ঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ ওই ঘর তৈরিই হয়নি। পরে গোপীনাথের কাছে জানতে পারি, ওই প্রকল্পে যে তাঁর নাম উঠেছিল, সে খবরই তিনি জানেন না। টাকা পাওয়া তো দূরের কথা!’
জেলাশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে গোপীনাথবাবু জানিয়েছেন, ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩-’১৪ আর্থিক বর্ষে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর নামে বাড়ি বরাদ্দ হয়। দাবি করা হয়েছে, তিনটি কিস্তিতে ৭৫ হাজার টাকাও দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৫ জুন তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে শেষ কিস্তির ১১,২৫০ টাকা দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘‘ইন্দিরা আবাস যোজনা প্রকল্পে আমার নামে বাড়ি তৈরি হয়েছে, অথচ আমি নিজেই জানি না! আমার কোনও বাড়িও নির্মাণ হয়নি। পুরো ঘটনার তদন্ত দাবি করেছি।”
হরেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘এই ঘটনায় কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েবসাইটে এই অসত্য তথ্য কে আপলোড করলেন? ওই টাকাই বা কোথায় গেল? ওয়েবসাইটে একটি নবনির্মিত বাড়ির ছবিও দেওয়া রয়েছে। সেই বাড়ি কোথায়? ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে যে শঙ্কর বাউরি নামে এক ব্যক্তি নির্মাণের তিন পর্যায়ে সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছেন। এটাই বা কী করে সম্ভব? যদি বাড়িটাই নির্মাণ না হয়ে থাকে তাহলে কী ভাবে তিনটি পর্যায়ের সরেজমিন তদন্ত হল?’’
সমস্ত প্রশ্নেই দায় এড়িয়েছেন তৃণমূল পরিচালিত কালীদহ পঞ্চায়েতের প্রধান ও আধিকারিকেরা। কালীদহ পঞ্চায়েতের প্রধান উত্তম মণ্ডলের দাবি, ‘‘এই কাজগুলি পঞ্চায়েতের আধিকারিকেরা করেন। কী ভাবে এমনটা ঘটল বলতে পারব না।” ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের সচিব শঙ্কর বাউরি দাবি করেন, ‘‘কী ভাবে এমনটা ঘটল বলতে পারব না।” তবে ব্লকের এক আধিকারিক দাবি করেছেন, ‘‘ওই ব্যক্তির বাড়িটি হয়তো নির্মাণ হয়নি। তবে তাঁর নামে বরাদ্দ করা টাকা ব্যাঙ্কে জমা রয়েছে। ওই ব্যক্তিকে অ্যাকাউন্ট নম্বর জমা দিতে বলা হয়েছে।”
হরেন্দ্রনাথবাবুর প্রশ্ন, ‘‘অভিযোগ তোলার পরে এখন প্রশাসন গোপীনাথবাবুর কাছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর জানতে চাইছে! তাজ্জব ব্যাপার। কার গাফিলতিতে এমনটা হল, তা তদন্ত করতেই হবে।”
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, প্রশান্ত পাল, ২৪/০২/২০১৮।

Friday, February 23, 2018

দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির দেহাবন্দে আদিবাসী যুবতীকে গণধর্ষণকাণ্ডে ধৃতের বাড়ি জ্বালিয়ে দিল জনতা।




দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির দেহাবন্দে আদিবাসী যুবতীকে ধর্ষণে অভিযুক্তদের শাস্তি এবং নির্যাতিতার সুচিকিৎসার দাবিতে শুক্রবার এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। এদিন উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কয়েকশো আদিবাসী এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। উত্তেজিত জনতা ধর্ষণের ঘটনায় ধৃত রামপ্রসাদ শর্মা সহ তার তিন আত্মীয়ের বাড়ি ও দু’টি কাঠের দোকান ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়ে এদিন একাংশ বাসিন্দা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। আদিবাসীদের অভিযোগ, ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজন জড়িত রয়েছে। পুলিস ঠিকভাবে তদন্ত না করায় এখনও তারা গ্রেপ্তার হয়নি। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে বিকেলের পর থেকে গ্রামে বহিরাগত কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এমনকী সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও এদিন ঘটনার সময়ে গ্রামে ঢুকতে পুলিস বাধা দেয়। ক্যামেরার ছবিও পুলিস জোর করে মুছে দেয় বলে অভিযোগ। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় রাতে সেখানে পুলিস পিকেট বসেছে। সমগ্র ঘটনা নিয়ে জেলা পুলিস মুখে কুলুপ এঁটেছে। ঘটনার খবর নিতে এদিন জেলার একাধিক পুলিস অফিসারকে ফোন করা হলে তাঁরা কেউ ফোন রিসিভ করেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এদিন সকলে বংশীহারির ধুমসা দিঘিতে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় হাজার তিনেক আদিবাসী সমাজের মানুষ জমায়েত হন। তাদের প্রত্যেকের হাতেই তির ধনুক, ধারালো অস্ত্র ছিল। গণ্ডগোলের আগাম আঁচ পেয়ে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিস সুপার, ডেপুটি পুলিস সুপার, গঙ্গারামপুরের এসডিপিও সহ কুশমণ্ডি, হরিরামপুর থানার পুলিস কর্মীরা উপস্থিত হন। দুপুর ১টা নাগাদ আদিবাসীদের বিক্ষোভ মিছিল ঘাটপাড়ায় যায়। মিছিল থেকেই কিছু লোক ধর্ষণ কাণ্ডে ধৃত রামপ্রসাদ সহ তার তিন প্রতিবেশীর বাড়িতে চড়াও হয়। তালাবন্ধ বাড়িতে তারা ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাশাপাশি কয়েকটি দোকানেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এলাকা নিমেষের মধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে পুলিস থাকলেও তারা তির ধনুক নিয়ে আসা বিক্ষোভকারীদের আটকানোর সাহস দেখাতে পারেনি। আতঙ্কিত হয়ে একাংশ গ্রামবাসী ঘরে তালা মেরে পালিয়ে যান। কুশমণ্ডি থেকে ইটাহারগামী সড়কে পুলিস যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এদিকে, এলাকায় মিছিল ও বিক্ষোভ থাকায় ঠিক সময়ে দমকলের ইঞ্জিনও পৌঁছতে পারেনি। বেশ কয়েকটি বাড়ি ও দোকান ভস্মীভূত হয়ে যায়।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, নির্যাতিতা যুবতীকে মালদহ মেডিকেলে ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার দাবিও তারা করে। পাশবিক ওই ঘটনায় জড়িত সকলকে খুঁজে বের করার দাবি জানানোর পাশাপাশি ধৃতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়। প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া না হলে জেলাজুড়ে বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকিও দেন বিক্ষোভকারীরা। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী আদিবাসী যুবতীকে ধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। মালদহ মেডিকেল কলেজে গিয়ে তিনি নির্যাতিতাকে দেখে আসেন। চিকিৎসা এবং ওই মহিলা যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন সেজন্য সরকারের তরফে তাঁকে চার লক্ষেরও বেশি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
সৌজন্য – বর্তমান পত্রিকা, ২৪/০২/২০১৮। (ছবি - ইন্টারনেট)

আদিবাসী মহিলার ওপর গণ ধর্ষণ ও নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধের ASSA ও SYA এর ধিক্কার মিছিল।




গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দক্ষিন দিনাজপুরের  কুশুমণ্ডির দেহবন্দ এ ঘাটপাড়া গ্রামে অসহায় এক আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষন ও নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে দিকে দিকে আদিবাসীরা আন্দোলনে নেমেছেন। ঝাড়গ্রাম শহরে ২৩/০২/২০১৮ এ বিরাট ধিক্কার মিছিলের আয়োজন করেছিলেন All Santal Students Association (ASSA) Santal Youth Associacionজোহার।

Thursday, February 22, 2018

বহু বাধা সত্ত্বেও পড়া চালাচ্ছেন রুগরুঘুটুর নতুন প্রজন্ম, বইখাতা-পেন্সিল-গ্লোব কিনে দিয়েছেন শুভাকাঙ্খীরা।



মাটির এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে ঝোলানো চার্টগুলোর সামনে দাঁড়িয়েছিল সরস্বতী মুর্মু৷ রং জ্বলে যাওয়া ফিকে গোলাপি মোটা সুতির শাড়ি পরা ছিপছিপে তরুণীর কোলে এক বছরের ছেলে৷ আঁচলের একটু আড়াল দিয়ে শিশুকে বুকের দুধ দিতে দিতেই চার্টে লেখা অক্ষরগুলো চিনিয়ে দিচ্ছিল সরস্বতী৷ সামনে বসা মনসারাম মান্ডি, সুকুরমণি হেমব্রমদের জীবনে সেই প্রথমবার অক্ষরের সঙ্গে পরিচয়৷ ছোট্টখাট্টো চেহারার বালিকা মুর্মুর বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে৷ কোলে দেড় বছরের ছেলে রমেশকে নিয়ে সপ্রতিভ তরুণী বলে উঠল, ‘দিদি, এ বার ওই ন্যাপকিন এনেছ তো ? আমি সবাইকে বলে রেখেছি কিন্তু!গ্রামের তিরিশ জন মেয়ের জন্য শহর থেকে বয়ে আনা স্যানিটারি ন্যাপকিনের বস্তাটা টেনে নিয়ে দুই সন্তানের জননী বাকিদের বুঝিয়ে দিল ন্যাপকিনের উপযোগিতা, কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে সব কিছু৷
পুরুলিয়া শহরের থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট জনপদ পারার বাসিন্দা, ভূগোলের তরুণ মাস্টারমশাই পান্থদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সোনারাম মুর্মুর হাতে একটা গ্লোব তুলে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কোনটা উত্তর মেরু, কোনটাই বা আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি৷ সোনারামই গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে৷ গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যাক পেয়েছে, এ বছর ফের পরীক্ষায় বসবে৷ কিন্তু সোনারামের ঠিকানা ওই গ্লোবের কোনখানে ? অযোধ্যা পাহাড়ের একেবারে মাথায় ছোট্ট গ্রাম রুগরুঘুটু৷ শহুরে পর্যটকেরা অযোধ্যা হিলটপবলে যে জায়গা পর্যন্ত উঠে আসেন, সেই মোড় ছাড়িয়ে আরও প্রায় ১৮ কিলোমিটার উঠলে পাহাড়ের চুড়োয় একেবারে শেষ জনবসতি এই রুগরুঘুটুতেই বাস সোনারাম, বালিকা, সরস্বতীদের৷ মাত্র ১৬ ঘর সাঁওতাল পরিবারের বাস গ্রামটায়৷
উসুলডুংরি, জামঘুটু, জিলিংগোড়া, তালাকধর, তেলিয়াভাসার মতো ছোটো ছোটো গ্রামগুলো রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে আছে ক্যালেন্ডারের ছবির মতো৷ কয়েক দিন আগেই গিয়েছে বাঁদনা পরব৷ মাটির দেওয়ালে নিপুণ আঁকা গিরিমাটি আর আলকাতরার আলপনা৷ খোলার চালের ঘরের সামনে তুরতুর করে হেঁটে বেড়াচ্ছে মুরগির ছানা, চালে লতিয়ে উঠেছে চালকুমড়ো, লাউয়ের লতা৷ রুগরুঘুটুর ঘরগুলো অবশ্য এত সম্পন্ন, সুশ্রী নয়৷ বেশির ভাগ বাড়ির খোলার চাল ধসে পড়ছে, শিশুগুলোর রুক্ষ তেলবিহীন চুলে লালচে ছোপ৷ গ্রামের পিছন দিকে উঁচুনিচু চাষের জমির শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে অযোধ্যা পাহাড়ের রেঞ্জটা ফুটে ওঠে তেলরঙে আঁকা ক্যানভাসের মতো৷ গ্রামে ঢোকার একেবারে মুখে একটা টালির চালের ঘর৷ অযোধ্যা পাহাড়ের পাথর দিয়ে তৈরি দেওয়াল, তার উপর লাল কাঁকুরে মাটির প্রলেপ৷ সেই ঘরে বসে শখানেক রোগী দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন মেডিক্যাল ক্যাম্পের ডাক্তারবাবু রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল৷ নামটা ভারি হলেও মোটে তিন বছর আগে ডাক্তারি পাশ করেছেন পুরুলিয়ার মানবাজারের ঝকঝকে তরুণ৷ অযোধ্যা থেকে অনেক দূরের একটা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারি করার সুবাদে যে ধরনের রোগভোগের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তার কিছুই মিলছে না রুগরুঘুটুতে এসে৷ বুড়োবুড়ি যারা এসেছেন, তাঁদের অধিকাংশের চোখে ছানি বা হাঁটুতে বয়সজনিত ব্যথা৷ বিবাহিত মেয়েগুলির অধিকাংশেরই প্রসব হয়েছে বাড়িতে বা বড়জোর পাঁচ কিলোমিটার দূরের তেলিয়াভাসার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে৷ তবু হাইপারটেনশন, সুগার, ব্লাড প্রেশার, এমনকী গ্রামগঞ্জে পরিচিত চর্মরোগের চেনা অসুখেরও খোঁজ মিলছে না এই গ্রামে৷ সাঁওতাল তরুণ-তরুণীদের ভরপুর স্বাস্থ্য, এমনকী বুড়োবুড়িরাও দিনে দুবার পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠ কুড়িয়ে আনে, ছোটখাটো খরগোশ, ইঁদুর মেরে নিয়ে আসেন৷ সুতরাং সাধারণ সর্দিকাশি আর বাচ্চাদের কৃমির ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত দিতে হল ডাক্তারবাবুকে৷
প্রায় দিকশূন্যপুরের এই গ্রামের সবটাই অবশ্য এমন রঙিন নয়৷ গোটা গ্রামে কোনও পুকুর নেই৷ পানীয় জলের উৎস বলতে মাঠের মধ্যে একটা বাঁধানো কুয়ো৷ ১৯৭৭ সালে সেই কুয়ো তৈরি হলেও, বছরে বেশ কয়েকমাস তাতে জল থাকে না৷ গরমের সময় খাবার জলের খোঁজে ওদের যেতে হয় প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের মাছকান্দা ঝরনায়৷ পাহাড়ি খাদ বেয়ে অন্তত আধ কিলোমিটার নামতে হয় সেই ঝরনা পর্যন্ত পৌঁছতে হলে৷ দূষণবিহীন গ্রামে ওই কুয়োর জলেই চলে স্নান, খাওয়া, কাপড় কাচা, এমনকি ছোটখাটো সেচের কাজ৷ পড়াতে আসার আগে ছেলেকে কোলে নিয়ে ওই কুয়োর পাড়ে ছাগল চরাচ্ছিল সরস্বতী৷ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়া সপ্রতিভ তরুণী হাসতে হাসতে বলল, ‘মোর বাপের বয়স হয়েছিল খুব৷ তা বুড়া মরার আগে কুটুম ঘরে বিয়া দিল৷ ইস্কুল যাওয়া আর হল না আমার৷সরস্বতীর বর এই গ্রামেই চাষবাসের কাজ করে৷ যদিও সুখা জমিতে সে সুযোগ খুব বেশি থাকে না৷ সম্বত্সরের খাওয়ার মতো ধান কিছুটা হয়, বাকি সরকারের দেওয়া দুটাকা কিলো চালেই ভরসা৷ গ্রামে পুকুর না থাকায় মাছের স্বাদ ওরা জানে না৷ ঘরের পোষা মুরগি আর জঙ্গলের ছোটখাটো পশু মেরেই প্রোটিনের জোগান হয়ে যায় রুগরুঘুটুর৷ সব্জিও খুব সীমিত৷ তেল, নুনের মতো নিত্য প্রয়োজনের জিনিস কিনতেও হাঁটা দিতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরের তেলিয়াভাসা বা তালাকধরের মতো গ্রামে৷ ওদের কাছে বড়ো শহরের সংজ্ঞা হল অযোধ্যা হিলটপ৷ কিন্তু তা নিয়ে বড়ো একটা খেদ নেই এ গ্রামের বাসিন্দাদের৷ গ্রামের প্রায় সব বাসিন্দাই নিরক্ষর৷ কেবল প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হিসেবে উঠে এসেছে সোনারাম আর বলরাম মুর্মু৷ দুজনই এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে৷ আর অন্য গ্রাম থেকে বিয়ে হয়ে আসা দুই বধূ সরস্বতী ও বালিকা কিছুটা স্কুলের শিক্ষা পেয়েছে৷ গত বছর নভেম্বরে ট্রেক করত গিয়ে রুগরুঘুটুর খোঁজ পেয়েছিলেন একদল তরুণ৷ তাঁদেরই চোখে পড়ে কনকনে শীতের রাতে গায়ে দেওয়ার জন্য ছেঁড়া চট ছাড়া কিছু নেই ওই গ্রামের লোকেদের৷ শীতের মুখে এক ফেরিওয়ালা কম্বল বেচতে গিয়েছিল গ্রামে৷ কিন্তু ৫০০ টাকা খরচ করে কম্বল কেনার রেস্ত জোগাড় হয়নি আদিবাসী পরিবারগুলোয়৷ দিনকতক পর ফের ওই দলটি পৌঁছয় রুগরুঘুটুতে৷ এ বার সঙ্গে নিয়ে যায় শীতের জামাকাপড়, কম্বল, বাচ্চাদের টুকটাক ওষুধপত্র, শুকনো খাবার৷ সে সময়ই পান্থদীপদের চমকে দিয়ে সোনারাম আর সরস্বতী এগিয়ে এসে বলে ওরা পড়াশোনা করতে চায়৷ ব্যাক পেলেও ফের উচ্চ মাধ্যমিক দিতে চায় সোনারাম, আর সরস্বতী সংসার সামলেও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে চায়৷ ওদের উৎসাহেই আরও একদল মানুষ একজোট হয়ে শহর থেকে স্লেট, পেন্সিল, বইখাতা, চক, ব্ল্যাকবোর্ড, গ্লোব, চার্টের বস্তা নিয়ে পৌঁছে যায় গ্রামে৷ সোনারাম আর সরস্বতীর দায়িত্বে এ মাসের গোড়ায় শুরু হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র৷ যাতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছনোর ভিতটুকু তৈরি হয় গ্রামের জনা কুড়ি শিশুর৷ গ্রামের মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন বোঝানোর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে বালিকা মুর্মু৷ কিন্তু একমাসের জোগান ফুরিয়ে গেলে পরের মাসে কোথা থেকে সেটা আসবে তা জানা নেই তার৷ গ্রামে একটা গভীর নলকূপ বসানোর জন্য উদ্যোগী হয়েছেন জেলার পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের তরুণ আধিকারিক হাসানুর মণ্ডল৷ কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ জোগাড় করতে কাঠখড় পোড়াতে হবে অনেক৷ মাত্র ষাট হাজার টাকা হলেই রুগরুঘুটুতে বসতে পারে একটা গভীর নলকূপ৷ বদলে যেতে পারে গ্রামের চালচিত্র৷ কিন্তু তার জন্য সরকারি লাল ফিতের ফাঁস খুলতে হবে হাসানুরের মতো তরুণ, উদ্যমী সরকারি কর্মীদের৷ পুরুলিয়া শহর থেকে অযোধ্যা পাহাড় পর্যন্ত রাস্তা এখন কংক্রিটে বাঁধানো৷ রাস্তার দুপাশ আরও চওড়া করতে কোপ পড়েছে দুদিকের গাছে৷ শান বাঁধানো রাস্তার পাশেই ঢালাই নিকাশি নালা৷ শহর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত দুপাশে পলাশের বন৷ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি কুঁড়ি এসেছে পলাশবনে৷ আর কদিন পরেই দোল, পাহাড়ে আগুন লাগবে শিমুল-পলাশের৷ বসন্তের টানে শহর থেকে পর্যটকেরা ভিড় করবে এই সব পাহাড়তলিতে৷ সাঁ সাঁ করে গাড়ি রাঙা ধুলো উড়িয়ে চলে যাবে ময়ূর পাহাড়, মুরুগুমা, খয়রাবেড়া বাঁধের দিকে৷ কিন্তু পলাশ ফুটলে মন ভার হয়ে যায় রুগরুঘুটু, উসুলডুংরির মতো গ্রামগুলোর৷ পলাশ শেষ হতেই কুয়োর জল শুকোবে ওদের৷ মাথায় হাঁড়ি কলসি নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হবে মাইল মাইল জলের খোঁজে৷ খিদে চেপে, তৃষ্ণা বুকে নিয়ে তার মধ্যেও সোনারাম, সরস্বতীরা পড়াশোনা করার লড়াই চালিয়ে যাবে৷ পুরুলিয়ার গ্রামটিতে এখনও গরমে পানীয় জল মেলে না, দুটাকার চালে অন্ন-সংস্থান হয়, তেল-নুনের জন্য হাঁটতে হয় কয়েক কিলোমিটার৷ এরই মধ্যে চলছে পড়ানো আর পড়াশোনা৷ সোনারাম আর সরস্বতীর দায়িত্বে এ মাসের গোড়ায় শুরু হয়েছে একটি শিক্ষাকেন্দ্র৷ যাতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে প্রাথমিক স্কুলে পৌঁছনোর ভিতটুকু তৈরি হয় গ্রামের জনা কুড়ি শিশুর৷ গ্রামের মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রয়োজন বোঝানোর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে বালিকা মুর্মু৷
সৌজন্য – এই সময়, শর্মিষ্ঠা রায়, ১৯/০২/২০১৮।