জীবিকার জন্য
হাওড়া জেলার জলাভূমি থেকে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি সংগ্রহ করেন আদিম
আদিবাসী শবর মহিলারা।
হাওড়া জেলার
জলাভূমি এই গরমে আদিম আদিবাসী শবর মহিলাদের সামান্য রোজগারের সুযোগ করে দিয়ে
বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রায় প্রতিদিন খড়গপুর থেকে হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনে করে বাগনান,
ফুলেশ্বর, আবাদা, মৌড়িগ্রাম এর জলাভূমি থেকে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি
সংগ্রহ করতে যান আদিম আদিবাসী শবর মহিলারা। সংগ্রহ করা শামুক, গেঁড়ি, গুগলি পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে দিন
গুজরান করেন আদিম আদিবাসী শবর মহিলারা।
প্রতিদিন বাসি
ভাত, মুড়ি, ঘুগনি ইত্যাদি খেয়ে আদিবাসী মহিলারা দল বেঁধে
ভোরের ট্রেন ধরেন। তার পরে কেউ নামেন বাগনান, কেউ ফুলেশ্বর,
আবাদা, কেউ বা মৌড়ীগ্রাম স্টেশনে। নেমে কখনও
কাছাকাছি গ্রামে, কখনও বা বাসে করে আরও ভিতরে অন্য কোনও
গ্রামে। অতঃপর সেখানকার জলায় গেঁড়ি, গুগলি, কটু (ছোট কচ্ছপ) খোঁজা। কোন স্টেশনে দল নামবে, ঠিক
নেই। দু’ দিন বাগনান হলে তার পরের তিন দিন হয়তো মৌড়ীগ্রাম।
গ্রামের
পুকুরে গেঁড়ি,
গুগলি খোঁজার জন্য আগে পয়সা দিতে হত না। এখন কোনও কোনও ঝিল মাস
পাঁচেকের জন্য হাজার চারেক টাকা জমা নেয়। দলের দশ-পনেরো জন চাঁদা তুলে সেই টাকা
জোগাড় করেন। অতঃপর সবাই মিলে দুপুর অবধি তন্নতন্ন করে জলার আগাছা হাতড়ানো। কোনও
কোনও পুকুরমালিক আবার উদার। তাঁরা বলে দেন, গেঁড়ি-গুগলি
খোঁজার আগে পুকুরের ধারের আগাছা, জঙ্গল সাফ করে দিতে হবে।
বিনিময়ে দুপুরে তিনি ভরপেট ভাত দেবেন। পয়সা এবং গতর-খাটানো বিনিময় প্রথা দুটোই এই
পুষ্করিণী-পৃথিবীতে স্বাগত।
দলটা ফেরার
পথে আবার লোকাল ট্রেনে ওঠে। পাঁশকুড়া, হাউরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা
বস্তা কিনে নেয়। ছোট গুগলি সব চেয়ে দামি, ৮ টাকা কেজি। আর
বড় শামুক, ঝিনুক হলে কেজিতে পাঁচ টাকা। নগদ পয়সা নিয়ে বাড়ি
ফিরে রান্না। পর দিন সকালে ফের সেই রুটিন।
সংগ্রহকারীরা
অধিকাংশই জাতিতে শবর। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে সাঁওতাল, মুন্ডা,
শবর প্রায় এক। কিন্তু ফারাক আছে। সাঁওতাল, মুন্ডারা
বহু কাল চাষবাস করেন, নিকোনো ঘরদোর ছবির মতো সুন্দর। ‘দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিমডিম রবে/ সাঁওতাল পল্লিতে উৎসব হবে,’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার ওই সময়েই, ১৯৩১ সালেই
ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার শবরদের ‘ডাকাত ও অপরাধী জাতি’ বলে দেগে দিচ্ছে। অরণ্যচারী এই জনজাতি তখনও কৃষির সংস্পর্শে আসেননি,
শিকারই জীবিকা। উপনিবেশের বাবুরা তাঁদের বাঁকা চোখে দেখবে, বলা বাহুল্য।
কোন কোনদিন ভাগ্যক্রমে
জলায় গোসাপ পেলে হয় সেটি রান্না করে খাওয়া হয় অথবা কেটেকুটে, ছাল
ছাড়িয়ে শবরপাড়ায় পরিচিত আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এক কেজি মাংসের দাম
৬০ টাকা। আগে আরও অনেক কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু এখন এত কেমিক্যাল সার, পোকা মারার ওষুধের পাল্লায় কিছুই থাকে না। মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রামে জলা শুকিয়ে যায়, হাওড়ার খালে তবু
জিনিসপত্র মেলে, বলে জানান সংগ্রহকারীরা।
সংগ্রহকারী
শবররা দু’টাকা কেজি চাল পান। মাঝে মাঝে জঙ্গলে খাম আলু পাওয়া যায়। কিছু সব্জি কিনতে
হয়। পাতে মহার্ঘ ডাল এবং মাছ রোজ জোটে না। প্রোটিন বলতে এই গেঁড়ি-গুগলি-গোসাপই
ভরসা। গোসাপ শুনে শিউরে ওঠার কিছু নেই। ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর কালকেতু ব্যাধ গোসাপ শিকার করেই ঘরে ফিরেছিল। বছরে বড়জোর ৪০ দিন
খেতমজুরের কাজ জোটে।
বালিচক
স্টেশনে নেমে টোটোয় চকসাহাপুর গ্রামে শবরপাড়ায় অধিকাংশ সংগ্রহকারীদের বাড়ি। গ্রামে
চকসাহাপুর লোধা সেবক সংঘের মেয়ে হোস্টেল আছে। মেয়েরা সেখানে ক্লাস ফোর অবধি
পড়াশোনা করে। লোধা সেবক সংঘের কর্মকর্তা প্রহ্লাদকুমার ভক্তা। লোধা সমাজের প্রথম
মহিলা স্নাতক,
আত্মহত্যা করে যিনি জীবন শেষ করে দিয়েছেন সেই চুনি কোটালের মামা এবং
লোধাশবর সমাজে প্রথম স্নাতক এই প্রহ্লাদবাবু। তাঁর সাফ কথা, লোধা
বালিকার জন্য সাইকেলের থেকেও হোস্টেল জরুরি। অন্তত, মাধ্যমিক
অবধি মেয়েদের হোস্টেল জরুরি। বাবা, মা দু’জনে শিকারের খোঁজে, দিনমজুরির কাজে। মেয়েই তখন ঘর
সামলায়, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। ক্লাস ফোরের পর বাড়ি
ফিরে তাই পড়াশোনা আর সে চালাতে পারে না।
সংবাদ
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৯/০৫/২০১৯।
No comments:
Post a Comment