মুম্বইয়ের বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক
তথা স্ত্রীরোগ বিভাগের স্নাতকোত্তরের আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের ছাত্রী পায়েল তাদভির
আত্মহত্যা ও আত্মসমিক্ষা।
জাতপাত নিয়ে ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন ও অপমানের কারণে মুম্বইয়ের
বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক তথা স্ত্রীরোগ বিভাগের
স্নাতকোত্তরের আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের ছাত্রী পায়েল তাদভি আত্মঘাতী হলেন
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই। দিনের পর দিন সিনিয়র তথা সহকর্মীদের দ্বারা
হেনস্থা হতে হচ্ছিল ওই চিকিৎসক তথা স্নাতকোত্তরের ছাত্রীকে, জাত
তুলে কটূকাটব্য করা হচ্ছিল, অপমানিত-অপদস্থ করা হচ্ছিল
একনাগাড়ে বলে অভিযোগ পায়েল তাদভির পরিবারের। সুরাহা চেয়েছিলেন পায়েল ও তাঁর পরিবার
মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার, কিন্তু কোনও ফল
হয়নি বলে অভিযোগ। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত পায়েল শেষ পর্যন্ত শেষ করে দিলেন নিজেকেই।
জাতপাতের ঘৃণার শিকড় কতটা গভীরে থাকলে সমাজের আলোকিততম
অংশেও এ ভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে বৈষম্য তথা সামাজিক বিভাজন ভাবলে স্তম্ভিত হতে
হয়। জাতপাতের নামে মানসিক নির্যাতন কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এই রকম চরম সিদ্ধান্ত নিতে
হয় কাউকে ভাবলেই শিউরে উঠতে হচ্ছে। সমাজের যে স্তরে এই সাংঘাতিক বিদ্বেষের
উপস্থিতির কথা সামনে আসছে,
তা জেনে আরও বিস্মিত হতে হচ্ছে। অনালোকিত, অনগ্রসর
কোনও অংশ নয়, সমাজের সবচেয়ে আলোকপ্রাপ্ত এবং এগিয়ে থাকাদের
সমাহার যেখানে, সেখানেও জাতপাতের নামে এত বিদ্বেষের রমরমা!
এত ঘৃণা! সে ঘৃণা বা বিদ্বেষকে আবার নিতান্তই সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা
হয়, যেন এমনটা তো হতেই পারে। না হলে রেসিডেন্ট চিকিৎসক এবং
তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বার বার অভিযোগ পেয়েও গুরুত্বই দেবেন না কেন মেডিক্যাল
কলেজ কর্তৃপক্ষ?
বিপর্যয়টা ঘটে যাওয়ার পরে হইচই শুরু হল। অভিযুক্তদের
বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। পুলিশেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। একজনকে গ্রেফতার করা
হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের যে কর্তারা সব জেনেও এত দিন
নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ, সেই কর্তাদের জবাব তলব করা হয়েছে। কিন্তু
চোর পালানোর পরে বুদ্ধি খুললে কাজের কাজ যে খুব একটা হয় না, সে
তো বলাই বাহুল্য।
সমাজ কতটা অসুস্থ হলে সমাজের শীর্ষ স্তরেও এমন ভয়ঙ্কর
বিদ্বেষ ঘাঁটি গেড়ে থাকতে পারে! কোনও বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি কিন্তু নয় এ। শুধু
মহারাষ্ট্রের একটা মেডিক্যাল কলেজে এ ঘটনা ঘটেছে, এমন নয় মোটেই। এ
রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজেও জাতিবিদ্বেষী আচরণের অভিযোগ ঘোরাফেরা করে। খুব বড় আকারে
সে সব অভিযোগ সামনে আসেনি ঠিকই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা
এ সব থেকে মুক্ত। পরিস্থিতিটা তাই দুর্ভাগ্যজনক ঠেকে।
যে পরিস্থিতির শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক পায়েল
তাদভি, কোনও সুস্থ সামাজিকতা তাকে প্রশ্রয় দেয় না। কোনও রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল
প্রকাশ্যে এই বিদ্বেষের পৃষ্ঠপোষণা করে, এমনও নয়। তা
সত্ত্বেও সমাজের সব স্তরে এর উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, বিদ্বেষের
বিষ কী ভাবে অবিরল ছুটে বেড়াচ্ছে শিরায়-উপশিরায়। সামাজিক চেতনায় এবং বোধের উৎসে কত
বড় ধাক্কা দিতে পারলে এই বিষ জব্দ হবে, বোঝা কঠিন হয় আজ।
এক আদিবাসী তরুণীর চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি
লাভের স্বপ্নটি অপূর্ণ রইল। পায়েল তাদভির আত্মহত্যা এক গভীর সঙ্কটের বার্তা। ২০১৬
সালে হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা হইতে ২০১৯ সালে মুম্বইয়ের এক সরকারি
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্নাতকোত্তর ছাত্রী পায়েল তাদভির আত্মহনন, উচ্চশিক্ষায়
দলিত-আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক বিপন্নতার দুইটি দৃষ্টান্তমাত্র। রোহিতের
পূর্বে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই সাত জন দলিত ছাত্র আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০০৬ থেকে এমস,
আইআইটি-র মতো বিবিধ শীর্ষস্থানীয় শিক্ষায়তনে বাইশ জন ছাত্রছাত্রী
আত্মহত্যা করেছেন। আরও কত পায়েল তাদভি, রোহিত ভেমুলা নিজেদের
জীবন শেষ করে অপমানের জ্বালা জুড়িয়েছেন, কে বলতে পারে?
তাদের অপমান করার সহজ উপায়, সংরক্ষিত আসনের
সুযোগ গ্রহণ করার জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। সংরক্ষণ তাদের অধিকার। কিন্তু তাঁরা যে
বস্তুত উচ্চশিক্ষার অধিকারী নন, ‘পিছনের দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করেছেন, এমন একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা হয়ে
থাকে। এবং ‘অনধিকার প্রবেশ’ করার জন্য
নানা ‘শাস্তি’ বর্ষিত হয়ে থাকে। অপমানিত,
ব্যর্থতার সম্ভাবনায় শঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা নীরবে সরে যান উচ্চশিক্ষা
থেকে, কেও কেও আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
আক্ষেপ, এই জঘন্য অপরাধ যারা করছেন, তাঁরা তথাকথিত ‘শিক্ষিত,’ এমনকি
অনেকে শিক্ষক। শিক্ষা যে তাদের ক্ষুদ্রতা হইতে মুক্তি দেইনি, সাম্য ও যুক্তিবাদে উন্নীত
করে নি, আবারও তাঁর প্রমাণ মিলল পায়েলের আত্মহত্যায়। অপমান ও
নির্যাতনের বিরুদ্ধে পায়েল এবং তাঁর বাবা-মা অভিযোগ করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজ
কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু তাঁরা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
অভিযুক্ত তিন ডাক্তারের শাস্তিও হয়নি। কলেজের ডিন জানিয়েছেন, তিনি জানতে পারলে এর প্রতিকার করতেন। অর্থাৎ বিষয়টি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে জানানোর
প্রয়োজনও বোধ করেননি বিভাগীয় প্রধান। স্কুল থেকেই দলিত ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের এই
অবিচারের শিকার হয়ে থাকে। কখনও দলিতদের পৃথক বসবার জায়গা নির্দিষ্ট করে থাকেন
শিক্ষকেরা, কখনও স্কুলের পূজায় তাঁরা অংশগ্রহণ করতে চাইলে
তিরস্কার করেন। কর্নাটকে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, ব্রিটিশ
শাসনকালে ‘অপরাধপ্রবণ’ বলে চিহ্নিত
জনজাতির শিশুদের প্রতি আজও স্কুলগুলি নিতান্ত নিষ্করুণ। দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে
বৈষম্য ও হিংসার জন্য কঠোরতর শাস্তি নির্দিষ্ট করে আইন হয়েছে। কিন্তু তাতেও তথাকথিত
শিক্ষিত শ্রেণির চেতনা হয়নি।
শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও তথাকথিত উচ্চবর্ণেরই দাপট।
নিম্নবর্গের প্রতি তাদের বিদ্বেষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা সুবিদিত। শুধু আইন করে
সেই বিদ্বেষ মোছা অসম্ভব। তাঁর জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন, রাজনৈতিক
সদিচ্ছা ভিন্ন তা সৃষ্টি হয় না। দায়িত্ব মূলত সরকারের। নিম্নবর্গের প্রতি যে কোনও
অবিচারে কঠোরতম ব্যবস্থা করে দ্ব্যর্থহীন বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। গত দফায়
নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই কাজটিতে ব্যর্থ হয়েছিল। বস্তুত, বারে
বারেই ভুল বার্তা প্রেরিত হয়েছিল। এই দফায় কি তাঁরা ভুলটি শুধরে নিতে পারবেন কিনা
আগামী দিনে দেখা যাবে।
সৌজন্য
সুত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮/০৫/২০১৯।
No comments:
Post a Comment