ধনীরাম টোটো একজন টোটো ভাষাভাষী মানুষ। থাকেন
আলিপুরদুয়ারে মাদারিহাট থানা এলাকার টোটোপাড়ায়। চাকরি করেন রাজ্য সরকারের অধীন
অনগ্রসর শ্রেণীকল্যাণ দপ্তরে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই ভাষাভাষির মানুষ এই বাংলায়
আছেন মাত্র ১৬০১ জন। ভাষা থাকলেও এই জনজাতির এখন পর্যন্ত কোনও লিপি নেই। টোটো
সমাজের জন্য নিজস্ব লিপির জন্য বিরল লড়াই করেছেন ধনীরাম টোটো। বাংলা হরফে লেখা
টোটো ভাষা কবিতা,
সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে প্রান্তিক ডুয়ার্সের এই মানুষটাকে বার বার
নিজেদের লিপি না থাকার কথা কুরে কুরে খেত। টবি আন্ডারসন নামে ভাষাতত্ত্বের বিশারদ
এক অষ্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সহায়তায় অবশেষে টোটো সমাজের জন্য নিজস্ব লিপি তৈরির
কাজটা শুরু করেন ধনীরাম। যা শেষ হয়েছে সম্প্রতি।
ধনীরাম বলেন, ‘একটা জাতি যে ভাষায় কথা বলে,
সেই ভাষায় কোনও লিপি নেই। যারা এই পরিস্থিতির মুখে আছেন একমাত্র
তারাই এই অসুবিধের কথা বুঝতে পারবেন। কী করে টিকবে সেই জাতি?’
বেটেখাঁটো চেহারার ধনীরাম টোটো রাতের পর রাত জেগেছেন।
সংসারের চাহিদা বেশি নয়,
তাই সরকারি কর্মী হিসেবে যে টুকু টাকা বেতন হিসেবে পেয়েছেন, তা দিন যাপনের জন্য রেখে বাদ বাকি পুরোটাই প্রায় খরচ করে দিয়েছেন
ভাষাতত্ত্ব, ফোনেটিক, লিপির বিজ্ঞান
সংক্রান্ত নানা বই সংগ্রহ করতে। তিন বছর ধরে টানা অধ্যবসায়ের পর এখন ধনীরাম অনেকটা
নিশ্চিত। তাঁর মনে হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম বিপন্ন ভাষাকে
বাঁচানোর মতো একটি চলনসই লিপি তিনি আবিস্কার করে ফেলেছেন। এবার ধনীরামের সামনে
আসল চ্যালেঞ্জ। এতদিন যে ভাষার কোনও লিপিই ছিল না, সেই
লিপির স্বীকৃতির জন্য ভাষা দিবসের প্রাক্কালে শপথ নিয়েছেন তিনি।
এই লিপি বোঝাতে বাংলা ও ইংরেজি হরফ ব্যবহার করে একটি
শব্দকোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে ধনীরাম ভালো মতোই জানেন, কেবল
লিপি আবিস্কারের দাবি করলেই হবে না। এই বিপন্ন ভাষাকে বাঁচাতে প্রয়োজন পড়বে
সরকারি স্বীকৃতির এবং ছাড়পত্র লাগবে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। রসদ খুব কম। তার
মধ্যেও নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে এলাকায় কিছু কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন
করেছেন তিনি। সেখানে এলাকাবাসীর পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষাবিদদেরও ডেকেছিলেন এই
মানুষটি। এমনই এক সেমিনারে ধনীরামের লিপি আবিস্কার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, টোটো লিপি শিখলে কী চাকরি পাওয়া যাবে? ধনীরামের
বক্তব্য, ‘বুদ্ধিজীবীরা কী জানেন না, ইংরেজি
ভাষা শিখেও ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না। টোটো ভাষা চাকরি আনতে পারবে কি না জানি
না। কিন্তু এতো আমাদের জাতিসত্ত্বার প্রশ্ন। একটা ভাষাকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া।’
এই তাগিদেই ধনীরাম নিজের কাজ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। কিন্তু সেবার মুখ্যমন্ত্রী ধর্মতলায় ধর্না
মঞ্চে আন্দোলনরত থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি ধনীরামের। ফিরে গিয়ে এলাকার সরকারি
বেসরকারি স্কুল এবং নিজের দপ্তরে সেই কাজ জমা করেছেন। ১ মার্চ, ২০১৯ কলকাতায়
টোটো জনজাতি এবং ধনীরামের কাজ নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের উদ্বোধন করেন কলকাতায় তাঁর
বন্ধু স্বপন বসু। ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘১৯৭৮ সালে শেষবার অলচিকি
লিপিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারপর আর কোনও লিপিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে
শুনিনি। ধনীরামের কাজ নিয়ে সরকারের কাছেই আবেদন করতে হবে। লিপিগুলি আলাদা হতে হবে,
তবে এতটা আলাদা যেন না হয় যাতে চিনতে অসুবিধে হয়।’
সৌজন্য – এইসময়, জয় সাহা, ২১/০২/২০১৯।
No comments:
Post a Comment