Sunday, May 5, 2019

একমাত্র এমএ পাশের চাকরি জোটেনি, মাঝপথে পড়া ছাড়ছেন আদিম আদিবাসী টোটোরা।


ভোটবাজারের গরমে অস্তিত্ব সঙ্কটে টোটো আদিবাসীরা। দেশ এগোচ্ছে, কিন্তু মাত্র ৩৪০ পরিবারের এই আদিবাসী জনজাতি দ্রুত পিছিয়ে পড়ছে। একদিকে উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী সভার প্রতিযোগিতা চলছে মোদী-মমতার। এরই মধ্যে ভুটান সীমান্তে টোটোপাড়ায় শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। আলিপুরদুয়ারের এই আদিবাসীদের মধ্যে আক্ষেপ, পড়াশোনা করেও চাকরি না জোটায় ড্রপ আউটেরসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র প্রথম শ্রেণীর স্নাতকোত্তর সদস্যের বেকারত্বের ছাপ পড়ছে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরেও। স্নাতকরা পেটের টানে ভুটানে ছুটছেন। সবদিক থেকেই বিপন্ন বোধ করছেন টোটোরা।
১১ এপ্রিল, ২০১৯ আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন। রাজ্যের প্রথম দফার ভোট আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে। দার্জিলিং বাদেও উত্তরবঙ্গের অন্য আসনে খাতা খুলতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। অন্য দিকে, এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই লড়াইয়ের আওয়াজ টোটোপাড়ায় পৌঁছে গেলেও তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। টোটোদের এখন একটাই আশঙ্কা, এত লড়াইয়ের পর জাতির উন্নয়ন ফের পিছিয়ে যাবে! পড়াশুনার উন্নয়নের জন্য গ্রামে হস্টেল হয়েছে, এভাবে ড্রপ আউটচলতে থাকলে একদিন তারও কোনও মুল্য থাকবে না। রোজের কাজেই আটকে যাবে গোটা জাতি।
টোটো আদিবাসীদের মধ্যে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে একমাত্র প্রথম শ্রেণীর স্নাতকোত্তর ধনঞ্জয় টোটো। টোটোপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে শিলিগুড়ির স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ। তারপর আলিপুরদুয়ার থেকে উচ্চমাধ্যমিক। ডুয়ার্স কলজে থেকে স্নাতক। কলকাতায় ডিপ্লোমা। কিন্তু এত কিছুর পরও বেকার বাড়িতে বসে অলস সময় কাটছে ধনঞ্জয়ের। পড়াশোনার কী হাল টোটোদের? কী বলছেন ধনঞ্জয়? তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “হতাশা গ্রাস করছে টোটোদের। পড়াশোনা করা টোটোদের চাকরি না হওয়ায় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে পরবর্তী প্রজন্ম। অনেকেই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে। স্বভাবতই আমরা ফের পিছিয়ে যাব। আবার ফিরে যাব আগের অবস্থায়।
ধনঞ্জয় বলেন, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউতে পাঁচটা ফুলের নাম জিজ্ঞেস করেছিল। ব্যাস। কিন্তু চাকরি হয়নি। দীর্ঘ সাত বছর হতে চলল এসএসসি নিয়োগের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখনও এসএসসিতে বসার কোনও সুযোগ পাইনি। আর স্বাস্থ্য দফতরে একবার লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ করবে শুনে আবেদন করেছিলাম। ইন্টারভিউও দিয়েছিলাম। খুব ভাল ইন্টারভিউ হয়েছিল। সেখানে আবার বিশেষ কারণবশত অন্যদের চাকরি হয়েছিল, আমার হয় নি। জানি না কি হবে।একমাত্র এমএ পাশের এই হাল দেখে অনেকেই স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এছাড়া আরও জনাদশেক বিএ পাশ করে বেকার বসে রয়েছেন।
টোটোপাড়াতেই রয়েছে একটি গ্রন্থাগার। সেই গ্রন্থাগারে গত ১০ বছর ধরে লাইব্রেরিয়ান নেই, জানালেন ধনঞ্জয়। তাঁর মতে, “এই লাইব্রেরিতে অস্থায়ী ভাবেও তো নিয়োগ করতে পারত। টোটোদের মধ্যে একমাত্র লাইব্রেরি সায়েন্সে এমএ প্রার্থীকে টোটোপাড়ার গ্রন্থাগারে নিয়োগ করা যায় না? তাতে জাতির উন্নয়নও সহজ হত। চোখের সামনে এই কর্মসংস্থান দেখলে ড্রপ আউট আটকানো সহজ হত। রাজ্যের মন্ত্রীদের কাছে হাজারো আবেদন করলেও সাড়া পান নি, জানান ধনঞ্জয়।
২০১৩ সালের স্নাতক তিলে টোটো। চাকরি না পেয়ে অন্নের সংস্থানে ভুটানে যাতায়াত করেন। তিলে টোটো বলেন, “পড়াশোনা করে কী লাভ? আমরা কোনও চাকরি না পাওয়ায় গ্রামে ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়ছে। নবম-দশম শ্রেণীতেই পড়া ছেড়ে দিচ্ছে অনেকেই। এটা ট্রেন্ডে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের অনেকেই আমার মত রোজগারের জন্য শ্রমিকের কাজ নিয়ে ভুটান চলে যাচ্ছে।বিএ পাশ তিলে জানালেন, “আমি ভুটানের লোকচিনায় এলাচ কাটার কাজ করছি। ৩০০ টাকা হাজিরা। আমার মত এখানকার অনেকে ভুটানে রোজের হিসাবে কাজ করতে যায়। এছাড়া কোনও উপায়ও নেই।
চার বছর বয়সে বাবাকে হারান সূর্যন টোটো। অতিকষ্টে বিএ পাশ করেছেন সূর্যন। সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছেন একটা চাকরির আশায়। তাঁর মধ্যেও বিমর্ষের ছাপ। সূর্যনেরও একই আক্ষেপ, “এভাবে চললে জাতিটা ফের পিছিয়ে পড়বে।লগন টোটো দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় পড়া ছেড়ে দেয়। তার মতে, “দাদারা পড়াশুনা করে চাকরি পায়নি। রোজের কাজ করেই যখন খাবার জোটাতে হবে তখন পড়াশোনা করে কী হবে? তাই আমিও পড়া ছেড়ে দিয়েছি।এমন উদাহরণ রোজ তৈরি হচ্ছে পাহাড়ের কোলের এই আদিম আদিবাসীদের গ্রামে। টোটোপাড়ার বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, “আমরা তফশিলি উপজাতিভুক্ত। যেহেতু আমাদের সংখ্যা সারা বিশ্বে মাত্র দেড় হাজারের একটু বেশি, অনেক লড়াই করে পড়াশোনা করতে হয়। সেক্ষেত্রে চাকরির নিয়োগে বিশেষ ছাড় দিতে পারত সরকার। কিন্তু মন্ত্রী-নেতাদের আত্মীয়-স্বজন সে সুযোগ পেলেও আমরা বঞ্চিত। আমাদের পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
টোটো আদিবাসীদের বাস একমাত্র টোটোপাড়ায়। জলদাপাড়া বনাঞ্চলের উত্তরপ্রান্তে বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এই অঞ্চল। এখনও প্রায় শদুয়েক মানুষ টোটো ভাষায় কথা বলেন। তাঁরা বাংলা জানেন না। স্থানীয় বাসিন্দা অশোক টোটো জানান, “এখানে রয়েছে মোট ৩৪০টি টোটো পরিবার। মোট জনসংখ্যা ১,৬০৮। প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও কোনও সরকারি বাস চলে না। একটি বেসরকারি বাস চলাচল করে। উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য পড়তে যেতে হয় মাদারিহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাসে যাতায়াতের খরচ ৪০ টাকা। গ্রামে হাইস্কুলের অনুমতি মিললেও এখনও পড়া চালু হয়নি।
ধনঞ্জয় টোটোর বাবা ধনীরাম টোটো। ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়লেও জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব বজায় রাখতে লড়াই করছেন তিনি। বছর দুয়েক আগে আবিষ্কার করেন টোটো লিপি। তিন মাসের প্রচেষ্টায় ৩১টি অক্ষর সৃষ্টি করেছেন তিনি। ধনীরামের মতে, “টোটোদের জন্য একেবারে স্বতন্ত্র লিপি তৈরি করেছি। জাতিসত্ত্বাকে রক্ষা করতে হলে নিজস্ব লিপির প্রয়োজন। সেই চেষ্টাই করেছি। আমাদের পৃথক ভাষা রয়েছে। বিশ্বে অনেক উপজাতি রয়েছে যাদের ভাষা থাকলেও লিপি নেই। এই লিপির চর্চা চলছে।তাঁর আরও বক্তব্য, “ঠিকমত চর্চা হলে সংযোজন-বিয়োজন হত। ঘষামাজা করলেই আরও উন্নত হত এই অক্ষর। এই ভাষার জন্য চাকরি হয়ত হবে না, কিন্তু নিজস্ব সত্ত্বা তৈরি হত টোটোদের।আর এই লিপি একেবারেই নতুন, কারও সঙ্গে মিল নেই বলেই দাবি ধনীরামের।
মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়ার দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। যাত্রাপথে বেশ কয়েকটি নদী পার হতে হয়। নদীর ওপর দিয়েই গাড়ি চলাচল করে। বর্ষায় গাড়ির যাতায়াত বন্ধই থাকে। যাত্রাপথ অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য়ে ভরপুর। আর টোটোপাড়া যেন একেবারে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মত। অমোঘ অপরূপ আকর্ষণ ভুটানের কোলের এই আদিবাসীদের গ্রামে। টোটোপাড়া থেকে ভুটান সীমান্তের দূরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার। গ্রাম জুড়ে সুপারি গাছের সারি। কাঠের বাড়ি। কিন্তু বহির্জগতের সেই সৌন্দর্যের কোনও প্রতিফলন নেই টোটোদের বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে।
সৌজন্য – iebangla, The Indian Express, Joyprakash Das, Apr 10, 2019.

No comments:

Post a Comment