এখন অনেকটা
নিশ্চিন্ত জীবন কাশীপুরের শুকদেব হেমব্রম বা বাঘমুন্ডির বুধনি হাঁসদার। বনবাসী
হিসেবে জমির পাট্টা পেয়ে গিয়েছেন। সে কারণেই তাঁদের গ্রামে যখন প্রচারে আসেন
তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো, তখন গোটা গ্রাম স্বাগত জানায়।
প্রচারে সকাল
পেরিয়ে বেলা গড়িয়েছে। ডুমসাই গ্রামে যখন পৌঁছলেন ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের বাম
প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম,
প্রখর গরমে তাঁকে বেলের সররত এনে দিলেন গ্রামবাসীরা। আবার আররা
পঞ্চায়েতের আদিবাসী গ্রামে তাঁকে ডাবের জল দিলেন মানুষ।
মহম্মদবাজারের
গণপুর, চরিচা গ্রামে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডলকে
আবার গলায় বনফুলের মালা পরালেন আদিবাসী মহিলারা। নিজস্ব প্রথায় পিতলের ঘড়ায় জল
ভরে রাখা হয় তাঁর পায়ের কাছে।
আদিবাসী ভোট
পেতে জান লড়িয়ে দিচ্ছে সব পক্ষই। আদিবাসী মন জয়ে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের বেশ কিছু
জায়গায় সাঁওতালি ভাষা এবং অলচিকি হরফে দেওয়ালও লিখেছে তৃণমূল। মালদাতেও সাঁওতালি
ভাষা কিন্তু বাংলা হরফে লিখে প্রচার চালিয়েছে শাসকদল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে
রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৬টি আসনের মধ্যে ১৩টিতেই জিতেছিল তৃণমূল।
তবু আদিবাসী সমর্থন আদায়ে চেষ্টার কসুর করছে না শাসকদল।
উত্তরবঙ্গের
বন্ধ চা-বাগান এবং পশ্চিমের জঙ্গলমহলে, বীরহর, শবর,
টোটোদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজে প্রথম থেকেই ২ টাকা কিলো চাল
দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তার পরেও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে
১৬টি বিধানসভার মধ্যে ৪টিতে লিড পেয়েছিল বিজেপি। যদিও গত বিধানসভা ভোটে মাত্র
একটিই ধরে রাখতে পেরেছে তারা। সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির আদিবাসী ভিত্তিতে সার্বিক
ফাটলের ইঙ্গিত মিলেছে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং রাজস্থান
বিধানসভার ভোটেও।
পুরুলিয়ার
কাশীপুর,
বাঘমুন্ডি, বান্দোয়ান, সাঁতুরির
মতো এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে বাস আদিবাসীদের। মৃগাঙ্ক মাহাতোর দাবি, ‘পুরুলিয়া তো বটেই, সারা রাজ্যেই বেশির ভাগ আদিবাসী
মানুষকে ইতিমধ্যে বনবাসী হিসেবে জমির পাট্টা দিয়েছে আমাদের সরকার। সে কারণেই আদিবাসী
গ্রামে প্রচারে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।’ সুপ্রিম কোর্ট
আদিবাসীদের নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে সংশোধন আনায় প্রতিবাদে রেল রোকো হয়েছিল
খড়গপুর, ইসলামপুর-সহ রাজ্যের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায়। এ
নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে। মোদী জমানায় সংখ্যালঘুদের মতো আদিবাসীদের
মধ্যেও যে সঙ্কট-বোধ তৈরি হয়েছে, তার জেরে আদিবাসীদের মন জয়
আরও সুগম করতে চাইছে তৃণমূল।
বাম জমানায়
আদিবাসীদের সমর্থন মোটের উপর ছিল বামেদের দিকেই। ২০১১-র পরিবর্তনের ভোটেও ১৬টির
মধ্যে ১০টি আসনেই জিতেছিল বামেরাই। তবে পরিস্থিতি বদলেছে অনেকটাই। তবু দেবলীনা
হেমব্রমরা বলছেন,
‘নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রামে আন্তরিক সাড়া পাচ্ছি। আশা করি, আদিবাসীদের
সমর্থন ফের বামেদের দিকেই আসবে।’ আবার গেরুয়া শিবিরেরও আশা,
সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনের জোর আর তৃণমূলের উপর বিরক্ত হয়েই আদিবাসীদের
বড় অংশ সমর্থন করবেন বিজেপিকেই।
উত্তরবঙ্গের
মুজনাই,
রামঝোরার মতো চা-বাগানে গত কয়েক বছর ধরেই সাংগঠনিক বিস্তার
ঘটিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। উত্তরবঙ্গের বহু চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় এখন বজরঙ্গবলী
মন্দির। হবিবপুরের বিধায়ক খগেন মুর্মু সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে মালদা
(উত্তর) কেন্দ্রে প্রার্থীও হয়েছেন। হবিবপুর, গাজোল,
মালদা বিধানসভা কেন্দ্রেও উল্লেখযোগ্য ভোট আদিবাসীদের। গত
পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই লোকসভা কেন্দ্রে ৬টি জেলা পরিষদের আসনে বিজেপি জেতায়
লোকসভাতেও আশাবাদী খগেন।
এর পাল্টায়
রামপুরহাট,
নলহাটির গ্রামে প্রচারের ফাঁকে আদিবাসী মহিলাদের সঙ্গে নেচেছেন
বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। আদিবাসী গ্রামে ধামসা, মাদল বাজিয়ে প্রচার সেরেছেন আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তিরকেও।
বান্দোয়ান, বিনপুর,
রানিবাঁধ, ঝাড়গ্রামের মতো জঙ্গলমহলের
বিস্তীর্ণ এলাকা এক সময় ছিল মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলা করে
আদিবাসী গ্রামে ‘উন্নয়ন’ই নির্বাচনী
প্রচারে তৃণমূলের মস্ত হাতিয়ার। উন্নয়ন, বনবাসী পাট্টা,
পশ্চিমাঞ্চলে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে আদিবাসী যুবকদের নিয়োগ,
২ টাকার চাল, জঙ্গলমহলের জন্য বিশেষ রেশন
কার্ড, বন্ধ চা বাগানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথাই আদিবাসী
এলাকায় প্রচারে তুলে ধরছে শাসকদল। আর সেই উন্নয়নের ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টাতেই
ব্যস্ত বিরোধীরা। ‘ডোলে’র রাজনীতি আদপে উন্নয়ন কিনা,
আত্মসম্মানের কিনা সে প্রশ্নও অবশ্য উঠছে।
সৌজন্য –
এইসময়, কৌশিক সরকার, ১০/০৫/২০১৯।
No comments:
Post a Comment