মহারাষ্ট্রে নিজের জাত নিয়ে ক্রমাগত সিনিয়ারদের কাছে
অপমানিত হতে হতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের এক ডাক্তারি
ছাত্রী।
মনে পড়ে যাচ্ছে আদিম আদিবাসী লোধা সমাজের প্রথম স্নাতক
চুনি কোটালের কথা। নিজের সমাজের প্রথম স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভরতি হয়েছিলেন
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সে। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষী শিক্ষক ও
ছাত্রছাত্রীদের একাংশের লাগাতার জাতি বিদ্বেষী মন্তব্য ও অপমানের কারণে আত্মহত্যা
করতে বাধ্য হন। এই কিছু দিন আগের রোহিত ভেমুলার কথাও আমরা অনেকেই জানি। এবার
সিনিয়ার ছাত্রীদের লাগাতার জাতি বিদ্বেষী মন্তব্য ও অপমানের কারণে আত্মহত্যা করলেন
মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের স্নাতকোত্তর বিভাগের আদিবাসী
ভীল সম্প্রদায়ের মহিলা চিকিৎসক পায়েল তাদভি।
মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের
স্নাতকোত্তর বিভাগের চিকিৎসকরাই ভয়ঙ্কর রোগের শিকার। তবে শারীরিক নয়, জাতিবিদ্বেষের
মানসিক রোগাক্রান্ত। আর তাঁদের সেই ‘রোগ’-এর মাশুল প্রাণ দিয়ে দিতে হল এক আদিবাসী মহিলা রেসিডেন্ট চিকিৎসককে। গত ২২ মে
হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন পায়েল তাদভি নামে বছর
ছাব্বিশের ওই আদিবাসী চিকিৎসক। এই ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ আদিবাসী সমাজ আন্দোলনের
প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মৃতার পরিবারের অভিযোগ পেয়ে অভিযুক্ত তিন চিকিৎসকের
বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। সাসপেন্ড করা হয়েছে তিন জনকেই। যদিও পরিবারের
অভিযোগ,
আগেও বহুবার অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু তখন কেউ তাঁদের অভিযোগ
শোনেননি। আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে মেয়ের এই পরিণতি হত না, বলেছেন
পায়েলের মা আবেদা তাদভি। দোষীদের কড়া শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
মহারাষ্ট্রের জলগাঁও জেলার বাসিন্দা আদিবাসী ভীল
সম্প্রদায়ের পায়েল তাদভি ২০১৮ সালের মে মাসে স্ত্রী রোগ বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি
হন। ডিসেম্বরেই পরিবারের লোকজনকে জানান, নিচু জাত বলে তাঁকে তাঁরই
ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকরা হেনস্থা করছেন। সামান্য কারণেও জাত তুলে তাঁকে নানা ভাবে
অপদস্থ করেন। পায়েলের মায়ের অভিযোগ, ‘‘ওই ঘটনার পরই
চিকিৎসকদের বিষয়টি জানিয়েছিলাম এবং সমস্যা মেটানোর জন্য বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা
আমার কথায় কান দেননি। কলেজের ডিনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করি। কিন্তু সাক্ষাতের
অনুমতি পাইনি।’’ তিনি বলেন, ২২ মে
ঘটনার দিন বিকেল চারটের সময়ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে জানিয়েছিল,
মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তার পরই মৃত্যুর খবর আসে।’’
পায়েলের স্বামী সলমনও পেশায় চিকিৎসক। তাঁর অভিযোগের
ভিত্তিতে তদন্তে নেমে পায়েলের ঊর্ধ্বতন তিন চিকিৎসক হেমা আহুজা, ভক্তি
মেহতা এবং অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়ালের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে পুলিশ।
তাঁদের বিরুদ্ধে আগরিপাড়া থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। যদিও কাউকেই এখনও
গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্তকারী অফিসাররা জানিয়েছেন, প্রাথমিক
তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিন জনের বিরুদ্ধে র্যাগিং, অত্যাচার
ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা
হয়েছে। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত
অ্যান্টি র্যাগিং কমিটিও আলাদা ভাবে তদন্ত
শুরু করেছে।
বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষও।
কলেজের ডিন রমেশ ভারমল বলেন, স্ত্রী রোগ বিভাগের প্রধান এস ডি শিরোদকর,
এবং পায়েলের ইউনিট হেড ই চিং লিং-কে শো কজ করা হয়েছে। কেন বার বার
অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তার সদুত্তর দিতে বলা
হয়েছে দু’জনকে। অন্য দিকে ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে আদিবাসী
সমাজও। দোষীদের শাস্তির দাবিতে আগামিকাল মঙ্গলবার তাঁরা প্রতিবাদ মিছিলের ডাক
দিয়েছেন।
বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিদ্যায়
পোস্টগ্র্যাজুয়েট এর ছাত্রী পায়েলের এই মর্মান্তিক মৃত্যু মনে করিয়ে দিচ্ছে রোহিত
ভেমুলার কথা। ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন ওই দলিত ছাত্র। তিন বছরেও যে দেশে দলিত
দলনের ছবিটা তেমন পাল্টায়নি, পায়েলের ঘটনাই তার প্রমাণ।
জানা গেছে, হাসপাতালের হস্টেলে থেকে
পড়াশোনা ও চিকিৎসা করছিলেন পায়েল। তাঁর তিন সিনিয়র ‘দিদি’
অঙ্কিতা খাণ্ডেওয়াল, ভক্তি মাহেব ও হেমা
আহুজা সব সময়েই নানা ছুতোয় পায়েলকে অপমান করত, যার মোদ্দা
কারণ ছিল সংরক্ষণের কোটায় পায়েলের ভর্তি হওয়া। এমনকী তারা কলেজের হোয়াটসঅ্যাপ
গ্রুপেও সবার সামনে বারবার পায়েলকে অপদস্থ করত বলে অভি়যোগ৷ তাদেরই পুলিশ
গ্রেফতার করেছে৷
জানা গিয়েছে, এরকম সমস্যার মুখে পড়ে
মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পায়েল। বারবার এই নিয়ে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ
জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ফল পাননি পায়েল৷ এমনকী তাঁকে এমন অপদস্থ করার কথা তিনি
তাঁর পরিবারকেও জানিয়েছিলেন৷ তাঁরাও কোনও রকম সুরাহা বার করতে পারেননি। শেষমেষ
কোথাও কোনও সুবিচার না পেয়ে, অপমানের বোঝা বইতে বইতে
ক্লান্ত হয়ে, আত্মহননের পথ বেছে নেন পায়েল৷
মহারাষ্ট্র অ্যাসোসিয়েশনের এক জন প্রতিনিধি আবাসিক
চিকিৎসক জানান,
ঘটনার আগের দিনই পায়েল দু’টি অস্ত্রোপচার
করেছিলেন সফল ভাবে। এ সময় তাঁর মধ্যে কোনও রকম চাপের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। তার
পরেই তিনি নিজের ঘরে চলে যান। এর প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা পরে দরজা খুলে তাঁর লাশ উদ্ধার
করা হয়।
স্থানীয় থানায় পায়েলের পরিবার ওই তিন জনের নামে অভিযোগ
দায়ের করে৷ তাদের দাবি,
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার
কারণেই পায়েল আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করে জানায়, পায়েলের পরিবারের অভিযোগ সত্যি৷ পরে পুলিশি জেরায় ওই তিন অভিযুক্ত
নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকারও করে নেয়৷ তাদের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা
দায়ের করা হয়েছে৷
পায়েলের এই বিষয়ে করা অভিযোগের কথা অবশ্য সম্পূর্ণ
অস্বীকার করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য পায়েল এমন অভিযোগ
করেননি৷ আর করলেও তা হয়তো মৌখিক ভাবে কারও কাছে করেছিলেন৷
মহারাষ্ট্রের আদিবাসী তাদভি ভিল গোষ্ঠীর তরুণী পায়েল
শিডিউলড ট্রাইব কোটায় ভর্তি হয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। কয়েক মাস আগেই বিয়েও হয়েছিল
তাঁর। এই ঘটনায় ভেঙে পড়েছে গোটা পরিবার। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়েও ডাক উঠেছে পায়েলের
সুবিচারের।
পায়েলের বাবা স্থানীয় জেলা পরিষদের অফিসে সরকারি চাকরি
করেন নিচু পোস্টে। দাদা শারীরিক প্রতিবন্ধী, বাড়িতে বসে মোবাইল সারায়।
দাদাকে ছোট থেকে দেখেই ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পায়েল। পায়েলের মা আবেদা
তাদভি বলেন, “আমাদের গোটা জাতের মধ্যে ও-ই প্রথম মেয়ে,
যে ডাক্তারি পাশ করেছিল। আমাদের পরিবারে কেউ এত বড় হয়নি ওর মতো। ও
এত পরিশ্রম করেছিল ডাক্তার হবে বলে…. সব শেষ।”
পায়েলের স্বামী সলমন তাদভিও ওই একই হাসপাতালের চিকিৎসক।
তিনি বলেন,
“ও যখন নায়ার হাসপাতালে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করতে এল, ওকে কয়েক দিনের জন্য হেমা আহুজা এবং ভক্তি মেহারের সঙ্গে থাকতে বলা
হয়েছিল। তখন থেকেই ওকে অবদস্থ করতে থাকে ওরা। এমনকী ওরা টয়লেট থেকে এসে ইচ্ছে করে
পায়েলের খাটে পা মুছত।”
পায়েলের পরিবারের দাবি, গত বছর ডিসেম্বর মাসে পায়েলের
মা আবেদা তাদভি নিজে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু
তাতেও কাজ হয়নি। তিনি বলেন, “আমার মেয়েটার খুব মনের জোর ছিল।
অনেক দিন ধরে সহ্য করছিল। কিন্তু শেষমেশ ভেঙে পড়ল। জানতে পারিনি, এতটা হতাশ হয়ে গেছে ও।”
তাঁর দাবি, দোষীদের যত দ্রুত সম্ভব
শাস্তি হোক। “ওদের এমন শাস্তি দেওযা হোক, যাতে আর কেউ কারও সঙ্গে এমনটা করতে সাহস না পায়। তবেই পায়েলের সুবিচার
হবে।”
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা ও দি ওয়াল, ২৭ মে, ২০১৯।