Wednesday, May 29, 2019

উচ্চমাধ্যমিকে স্টার নম্বর পেয়ে ডাইনি অপবাদের জবাব দিলেন আদিবাসী কন্যা বাসন্তী কিস্কু।

বছর তিনেক আগে এক আদিবাসী পরিবারকে ডাইনি অপবাদ দিয়েছিল গ্রামবাসীরা। ডাইনি অপবাদে মার জুটেছিল। সপরিবার ছিলেন ঘরছাড়া। সেই পরিবারের মেয়ে বাসন্তী কিস্কু ছাত্রী-নিবাসে থেকে নাছোড় লড়াইয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার নম্বর ৩৯০ পেল।
তিন বছর আগে শান্তিনিকেতন থানার রূপপুর পঞ্চায়েতের বিনোদপুর গ্রামে মা-বাবা, মাসি-দিদার সঙ্গে থাকত বাসন্তী কিস্কু। গ্রামের এক বৃদ্ধ রোগে মারা যান। পাঁচ দিনের মাথায় ওই বৃদ্ধের ছেলেকেও সাপে কাটে। তাঁকে ঝাড়খণ্ডের এক ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওঝার নিদান ছিল, ‘গ্রামে ডাইনি পরিবার রয়েছে। পরপর মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী। ওঝার নিদান! তাই চিকিৎসার অভাবে ওই যুবকের মৃত্যু সত্ত্বেও গ্রামবাসীর সমস্ত আক্রোশ পড়ে বাসন্তীর পরিবারের উপরে। পরিবারের সকলকে বেধড়ক মার, বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। আহত অবস্থায় বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে কিছু দিন ভর্তিও থাকতে হয় বাসন্তী এবং বাড়ির লোকেদের।
এর পরে বাসন্তীর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। একটা সময় বাসন্তী ভেবেছিলেন, পড়া ছেড়ে দেবেন। তার পরে মন বদলালেন। অপবাদ মাথায় নিয়ে বাঁচবেন না বলে ঠিক করলেন বাসন্তী কিস্কু। লড়াইয়ের সেই শুরু। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে বাড়ি ছেড়ে মোলডাঙা বীণাপাণি আদিবাসী ছাত্রী-নিবাস থেকে পড়াশোনা শুরু করেন বাসন্তী। পরীক্ষার কিছু দিন আগে গ্রামে ফিরে উচ্চমাধ্যমিক দেন বিনুড়িয়া সুমিত্রা বালিকা বিদ্যালয় থেকে। বাসন্তী ভাল ভাবে পাশ করলেও গ্রামের লোকেরা খবরটুকুও নেয়নি। বাসন্তী বলছেন, ‘‘গ্রামের লোক আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। বাড়িতেও কেউ আসে না।’’
জেলায় জেলায় ডাইনি অপবাদে মারধর, ঘরছাড়া করার ঘটনা নতুন নয়। বহু সচেতনতা শিবির, আইনি উদ্যোগেও অনেকের মন থেকেই বহুলালিত এই অন্ধবিশ্বাস মুছে ফেলা যায়নি। বিনোদপুরের বাসিন্দা ফুলুই বেসরা মানলেন, ‘‘গ্রামের পালা-পরবেও ওই পরিবারের কাউকে ডাকা হয় না।’’ গ্রামের মোড়ল কালীচরণ হাঁসদা অবশ্য বলেন, ‘‘সমাজ থেকে ব্রাত্য করে রাখা হয়নি। ওরাই গ্রামের মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশা করেন।’’
সে তর্ক সরিয়ে এমন মেয়ের লড়াইকে কুর্নিশ করছেন বিনুড়িয়া সুমিত্রা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা অদিতি মুখোপাধ্যায় মজুমদার। তাঁর কথায়, ‘‘কুসংস্কারকে জয় করে যে ভাবে বাসন্তী পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে, সেটা দৃষ্টান্ত। নিশ্চয়ই অনেকে অনুপ্রাণিত হবে।’’
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, বাসুদেব ঘোষ, ৩০ মে, ২০১৯।

আদিবাসী চিকিৎসক পায়েল তাদভির আত্মহত্যা ও আত্মসমিক্ষা।

মুম্বইয়ের বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক তথা স্ত্রীরোগ বিভাগের স্নাতকোত্তরের আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের ছাত্রী পায়েল তাদভির আত্মহত্যা ও আত্মসমিক্ষা।

জাতপাত নিয়ে ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন ও অপমানের কারণে মুম্বইয়ের বি ওয়াই এল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক তথা স্ত্রীরোগ বিভাগের স্নাতকোত্তরের আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের ছাত্রী পায়েল তাদভি আত্মঘাতী হলেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসেই। দিনের পর দিন সিনিয়র তথা সহকর্মীদের দ্বারা হেনস্থা হতে হচ্ছিল ওই চিকিৎসক তথা স্নাতকোত্তরের ছাত্রীকে, জাত তুলে কটূকাটব্য করা হচ্ছিল, অপমানিত-অপদস্থ করা হচ্ছিল একনাগাড়ে বলে অভিযোগ পায়েল তাদভির পরিবারের। সুরাহা চেয়েছিলেন পায়েল ও তাঁর পরিবার মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার, কিন্তু কোনও ফল হয়নি বলে অভিযোগ। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত পায়েল শেষ পর্যন্ত শেষ করে দিলেন নিজেকেই।
জাতপাতের ঘৃণার শিকড় কতটা গভীরে থাকলে সমাজের আলোকিততম অংশেও এ ভাবে অস্তিত্বশীল হতে পারে বৈষম্য তথা সামাজিক বিভাজন ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। জাতপাতের নামে মানসিক নির্যাতন কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এই রকম চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয় কাউকে ভাবলেই শিউরে উঠতে হচ্ছে। সমাজের যে স্তরে এই সাংঘাতিক বিদ্বেষের উপস্থিতির কথা সামনে আসছে, তা জেনে আরও বিস্মিত হতে হচ্ছে। অনালোকিত, অনগ্রসর কোনও অংশ নয়, সমাজের সবচেয়ে আলোকপ্রাপ্ত এবং এগিয়ে থাকাদের সমাহার যেখানে, সেখানেও জাতপাতের নামে এত বিদ্বেষের রমরমা! এত ঘৃণা! সে ঘৃণা বা বিদ্বেষকে আবার নিতান্তই সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা হয়, যেন এমনটা তো হতেই পারে। না হলে রেসিডেন্ট চিকিৎসক এবং তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বার বার অভিযোগ পেয়েও গুরুত্বই দেবেন না কেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ?
বিপর্যয়টা ঘটে যাওয়ার পরে হইচই শুরু হল। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। পুলিশেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। মেডিক্যাল কলেজের যে কর্তারা সব জেনেও এত দিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ, সেই কর্তাদের জবাব তলব করা হয়েছে। কিন্তু চোর পালানোর পরে বুদ্ধি খুললে কাজের কাজ যে খুব একটা হয় না, সে তো বলাই বাহুল্য।
সমাজ কতটা অসুস্থ হলে সমাজের শীর্ষ স্তরেও এমন ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ ঘাঁটি গেড়ে থাকতে পারে! কোনও বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতি কিন্তু নয় এ। শুধু মহারাষ্ট্রের একটা মেডিক্যাল কলেজে এ ঘটনা ঘটেছে, এমন নয় মোটেই। এ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজেও জাতিবিদ্বেষী আচরণের অভিযোগ ঘোরাফেরা করে। খুব বড় আকারে সে সব অভিযোগ সামনে আসেনি ঠিকই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা এ সব থেকে মুক্ত। পরিস্থিতিটা তাই দুর্ভাগ্যজনক ঠেকে।
যে পরিস্থিতির শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক পায়েল তাদভি, কোনও সুস্থ সামাজিকতা তাকে প্রশ্রয় দেয় না। কোনও রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে এই বিদ্বেষের পৃষ্ঠপোষণা করে, এমনও নয়। তা সত্ত্বেও সমাজের সব স্তরে এর উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়, বিদ্বেষের বিষ কী ভাবে অবিরল ছুটে বেড়াচ্ছে শিরায়-উপশিরায়। সামাজিক চেতনায় এবং বোধের উৎসে কত বড় ধাক্কা দিতে পারলে এই বিষ জব্দ হবে, বোঝা কঠিন হয় আজ।
এক আদিবাসী তরুণীর চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের স্বপ্নটি অপূর্ণ রইল। পায়েল তাদভির আত্মহত্যা এক গভীর সঙ্কটের বার্তা। ২০১৬ সালে হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা হইতে ২০১৯ সালে মুম্বইয়ের এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্নাতকোত্তর ছাত্রী পায়েল তাদভির আত্মহনন, উচ্চশিক্ষায় দলিত-আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক বিপন্নতার দুইটি দৃষ্টান্তমাত্র। রোহিতের পূর্বে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়েই সাত জন দলিত ছাত্র আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০০৬ থেকে এমস, আইআইটি-র মতো বিবিধ শীর্ষস্থানীয় শিক্ষায়তনে বাইশ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। আরও কত পায়েল তাদভি, রোহিত ভেমুলা নিজেদের জীবন শেষ করে অপমানের জ্বালা জুড়িয়েছেন, কে বলতে পারে? তাদের অপমান করার সহজ উপায়, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ গ্রহণ করার জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। সংরক্ষণ তাদের অধিকার। কিন্তু তাঁরা যে বস্তুত উচ্চশিক্ষার অধিকারী নন, ‘পিছনের দরজাদিয়ে প্রবেশ করেছেন, এমন একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এবং অনধিকার প্রবেশকরার জন্য নানা শাস্তিবর্ষিত হয়ে থাকে। অপমানিত, ব্যর্থতার সম্ভাবনায় শঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা নীরবে সরে যান উচ্চশিক্ষা থেকে, কেও কেও আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
আক্ষেপ, এই জঘন্য অপরাধ যারা করছেন, তাঁরা তথাকথিত শিক্ষিত,’ এমনকি অনেকে শিক্ষক। শিক্ষা যে তাদের ক্ষুদ্রতা হইতে মুক্তি দেইনি, সাম্য ও যুক্তিবাদে উন্নীত করে নি, আবারও তাঁর প্রমাণ মিলল পায়েলের আত্মহত্যায়। অপমান ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে পায়েল এবং তাঁর বাবা-মা অভিযোগ করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু তাঁরা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি। অভিযুক্ত তিন ডাক্তারের শাস্তিও হয়নি। কলেজের ডিন জানিয়েছেন, তিনি জানতে পারলে এর প্রতিকার করতেন। অর্থাৎ বিষয়টি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি বিভাগীয় প্রধান। স্কুল থেকেই দলিত ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের এই অবিচারের শিকার হয়ে থাকে। কখনও দলিতদের পৃথক বসবার জায়গা নির্দিষ্ট করে থাকেন শিক্ষকেরা, কখনও স্কুলের পূজায় তাঁরা অংশগ্রহণ করতে চাইলে তিরস্কার করেন। কর্নাটকে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, ব্রিটিশ শাসনকালে অপরাধপ্রবণবলে চিহ্নিত জনজাতির শিশুদের প্রতি আজও স্কুলগুলি নিতান্ত নিষ্করুণ। দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও হিংসার জন্য কঠোরতর শাস্তি নির্দিষ্ট করে আইন হয়েছে। কিন্তু তাতেও তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির চেতনা হয়নি।
শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও তথাকথিত উচ্চবর্ণেরই দাপট। নিম্নবর্গের প্রতি তাদের বিদ্বেষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা সুবিদিত। শুধু আইন করে সেই বিদ্বেষ মোছা অসম্ভব। তাঁর জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ভিন্ন তা সৃষ্টি হয় না। দায়িত্ব মূলত সরকারের। নিম্নবর্গের প্রতি যে কোনও অবিচারে কঠোরতম ব্যবস্থা করে দ্ব্যর্থহীন বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। গত দফায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই কাজটিতে ব্যর্থ হয়েছিল। বস্তুত, বারে বারেই ভুল বার্তা প্রেরিত হয়েছিল। এই দফায় কি তাঁরা ভুলটি শুধরে নিতে পারবেন কিনা আগামী দিনে দেখা যাবে।
সৌজন্য সুত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮/০৫/২০১৯।

Tuesday, May 28, 2019

কাগজ কুড়নো আদিবাসী কিশোর জিতেন টুডু, উচ্চমাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেছে।


জঞ্জালের স্তূপ থেকে কাগজ কুড়ত আদিবাসী কিশোর জিতেন টুডু, সহৃদয় যুবক মহম্মদ মুসা জিতেনকে স্কুলে ভরতি করে দিলে সবাইকে তাক লাগিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ বা স্টার নম্বর নিয়ে পাশ করেছে।

দশ বছর আগের কথাউত্তর দিনাজপুরের এক সামান্য কৃষক মহম্মদ মুসা একদিন এক কাগজ কুড়নো ছেলেকে লক্ষ্য করেন। সারা গায়ে ধুলো মাখা একটা বাচ্চা ছেলে রাস্তা থেকে কাগজ কুড়িয়ে সেই কাগজটাই মন দিয়ে পড়ছে। তারপর কাগজের টুকরোটা ঝোলায় পুরে আবার একটা ছেঁড়া, ফেলে দেওয়া কাগজের খোঁজ করে। মুসা খোঁজ করে জানতে পারেন, জিতেন টুডু নামে সেই আদিবাসী ছেলের বাড়ি তাঁদের পাশের গ্রামেই। সেই ছেলেকে মুসা যেন নিজের ছেলেই করে নেন। তাকে ঘরে নিয়ে আসেন। ভর্তি করিয়ে দেন স্কুলে। সেই জিতেন টুডু এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ বা স্টার নম্বর নিয়ে পাশ করেছে।
মহম্মদ মুসা নিজে মাধ্যমিক পাশ। ছোট চাষি। সামান্য জমি রয়েছে। থাকেন উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায়। পাশের গ্রাম গোয়ালগাঁওয়ে বাড়ি জিতেন টুডুর। তিন বছর বয়স থেকে থাকতেন দিদা ফুলমণি ওরাওঁর কাছে। দিদা সংসার চালাতে পারতেন না। কিছুটা বড় হয়ে ওঠার পরে জিতেন দিদার সঙ্গে পথে কাগজ কুড়োত। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জিতেনের যখন তিন বছর বয়স, ফুলমণির কাছে তাঁকে রেখে তাঁর মা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিছু দিন পর বাবাও চলে যান ভিন্ রাজ্যে। দুজনেই আর ফেরেননি।
তার মধ্যেই যতটুকু সম্ভব পড়াশোনা করতেন জিতেন। স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলে যাওয়া আর হত না। তখনই পাশে পান মুসাকে। মুসাই গিয়ে ফুলমণির সঙ্গে কথা বলে জিতেনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সোমবার মুসা বলেন, ‘‘প্রতি দিন সাইকেল চেপে ১২ কিলোমিটার দূরে চাকুলিয়া হাইস্কুল গিয়ে পড়াশোনা করত। ওর মধ্যে জেদ রয়েছে। মেধা রয়েছে। ওর পাশে আমরা আছি।’’
মহম্মদ মুসার চার ছেলেমেয়ে। তাঁর স্ত্রী রহিমা জানান, জিতেনও তাঁদেরই সন্তান। তাঁদের সংসারের সুখ-দুঃখ জিতেনেরও সুখ দুঃখ।
জিতেনেরও বক্তব্য তাই। তাঁর কথায়, ‘‘আমার জন্মদাতা বাবা-মা কোথায় জানি না। কিন্তু তার পরে আমি বাবা পেয়েছি। মা পেয়েছি। সংসার, ভাইবোন পেয়েছি। এ বার আমারও ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আমি ভাল করে পড়াশোনা করে যেতে চাই। পরে শিক্ষকতা করব।’’
খুশি ফুলমণিও। খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব দে বলেন, ‘‘জিতুর জন্য যত গর্ব হচ্ছে, মুসার জন্য তার চেয়ে কম হচ্ছে না। আজ মুসারই জয়ের দিন।’’
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, মেহেদি হেদায়েতুল্লা, ২৮/০৫/২০১৯।

জাত নিয়ে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করলেন আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের এক ডাক্তারি ছাত্রী।


মহারাষ্ট্রে নিজের জাত নিয়ে ক্রমাগত সিনিয়ারদের কাছে অপমানিত হতে হতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের এক ডাক্তারি ছাত্রী।

মনে পড়ে যাচ্ছে আদিম আদিবাসী লোধা সমাজের প্রথম স্নাতক চুনি কোটালের কথা। নিজের সমাজের প্রথম স্নাতক হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভরতি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সে। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষী শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের একাংশের লাগাতার জাতি বিদ্বেষী মন্তব্য ও অপমানের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এই কিছু দিন আগের রোহিত ভেমুলার কথাও আমরা অনেকেই জানি। এবার সিনিয়ার ছাত্রীদের লাগাতার জাতি বিদ্বেষী মন্তব্য ও অপমানের কারণে আত্মহত্যা করলেন মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের স্নাতকোত্তর বিভাগের আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের মহিলা চিকিৎসক পায়েল তাদভি।
মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের স্নাতকোত্তর বিভাগের চিকিৎসকরাই ভয়ঙ্কর রোগের শিকার। তবে শারীরিক নয়, জাতিবিদ্বেষের মানসিক রোগাক্রান্ত। আর তাঁদের সেই রোগ’-এর মাশুল প্রাণ দিয়ে দিতে হল এক আদিবাসী মহিলা রেসিডেন্ট চিকিৎসককেগত ২২ মে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হন পায়েল তাদভি নামে বছর ছাব্বিশের ওই আদিবাসী চিকিৎসক। এই ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ আদিবাসী সমাজ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে
মৃতার পরিবারের অভিযোগ পেয়ে অভিযুক্ত তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। সাসপেন্ড করা হয়েছে তিন জনকেই। যদিও পরিবারের অভিযোগ, আগেও বহুবার অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু তখন কেউ তাঁদের অভিযোগ শোনেননি। আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে মেয়ের এই পরিণতি হত না, বলেছেন পায়েলের মা আবেদা তাদভি। দোষীদের কড়া শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
মহারাষ্ট্রের জলগাঁও জেলার বাসিন্দা আদিবাসী ভীল সম্প্রদায়ের পায়েল তাদভি ২০১৮ সালের মে মাসে স্ত্রী রোগ বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। ডিসেম্বরেই পরিবারের লোকজনকে জানান, নিচু জাত বলে তাঁকে তাঁরই ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকরা হেনস্থা করছেন। সামান্য কারণেও জাত তুলে তাঁকে নানা ভাবে অপদস্থ করেন। পায়েলের মায়ের অভিযোগ, ‘‘ওই ঘটনার পরই চিকিৎসকদের বিষয়টি জানিয়েছিলাম এবং সমস্যা মেটানোর জন্য বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা আমার কথায় কান দেননি। কলেজের ডিনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করি। কিন্তু সাক্ষাতের অনুমতি পাইনি।’’ তিনি বলেন, ২২ মে ঘটনার দিন বিকেল চারটের সময়ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ও আমাকে জানিয়েছিল, মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তার পরই মৃত্যুর খবর আসে।’’
পায়েলের স্বামী সলমনও পেশায় চিকিৎসক। তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে পায়েলের ঊর্ধ্বতন তিন চিকিৎসক হেমা আহুজা, ভক্তি মেহতা এবং অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়ালের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে আগরিপাড়া থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। যদিও কাউকেই এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্তকারী অফিসাররা জানিয়েছেন, প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিন জনের বিরুদ্ধে র‌্যাগিং, অত্যাচার ও  তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটিও আলাদা ভাবে তদন্ত  শুরু করেছে।
বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষও। কলেজের ডিন রমেশ ভারমল বলেন, স্ত্রী রোগ বিভাগের প্রধান এস ডি শিরোদকর, এবং পায়েলের ইউনিট হেড ই চিং লিং-কে শো কজ করা হয়েছে। কেন বার বার অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তার সদুত্তর দিতে বলা হয়েছে দুজনকে। অন্য দিকে ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে আদিবাসী সমাজও। দোষীদের শাস্তির দাবিতে আগামিকাল মঙ্গলবার তাঁরা প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দিয়েছেন।
বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিদ্যায় পোস্টগ্র্যাজুয়েট এর ছাত্রী পায়েলের এই মর্মান্তিক মৃত্যু মনে করিয়ে দিচ্ছে রোহিত ভেমুলার কথা। ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন ওই দলিত ছাত্র। তিন বছরেও যে দেশে দলিত দলনের ছবিটা তেমন পাল্টায়নি, পায়েলের ঘটনাই তার প্রমাণ।
জানা গেছে, হাসপাতালের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা ও চিকিৎসা করছিলেন পায়েল। তাঁর তিন সিনিয়র দিদিঅঙ্কিতা খাণ্ডেওয়াল, ভক্তি মাহেব ও হেমা আহুজা সব সময়েই নানা ছুতোয় পায়েলকে অপমান করত, যার মোদ্দা কারণ ছিল সংরক্ষণের কোটায় পায়েলের ভর্তি হওয়া। এমনকী তারা কলেজের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও সবার সামনে বারবার পায়েলকে অপদস্থ করত বলে অভি়যোগ৷ তাদেরই পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷
জানা গিয়েছে, এরকম সমস্যার মুখে পড়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন পায়েল। বারবার এই নিয়ে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ফল পাননি পায়েল৷ এমনকী তাঁকে এমন অপদস্থ করার কথা তিনি তাঁর পরিবারকেও জানিয়েছিলেন৷ তাঁরাও কোনও রকম সুরাহা বার করতে পারেননি। শেষমেষ কোথাও কোনও সুবিচার না পেয়ে, অপমানের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে, আত্মহননের পথ বেছে নেন পায়েল৷
মহারাষ্ট্র অ্যাসোসিয়েশনের এক জন প্রতিনিধি আবাসিক চিকিৎসক জানান, ঘটনার আগের দিনই পায়েল দুটি অস্ত্রোপচার করেছিলেন সফল ভাবে। এ সময় তাঁর মধ্যে কোনও রকম চাপের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। তার পরেই তিনি নিজের ঘরে চলে যান। এর প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা পরে দরজা খুলে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় থানায় পায়েলের পরিবার ওই তিন জনের নামে অভিযোগ দায়ের করে৷ তাদের দাবি, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই পায়েল আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ প্রাথমিক তদন্ত করে জানায়, পায়েলের পরিবারের অভিযোগ সত্যি৷ পরে পুলিশি জেরায় ওই তিন অভিযুক্ত নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকারও করে নেয়৷ তাদের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে৷
পায়েলের এই বিষয়ে করা অভিযোগের কথা অবশ্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ৷ তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য পায়েল এমন অভিযোগ করেননি৷ আর করলেও তা হয়তো মৌখিক ভাবে কারও কাছে করেছিলেন৷
মহারাষ্ট্রের আদিবাসী তাদভি ভিল গোষ্ঠীর তরুণী পায়েল শিডিউলড ট্রাইব কোটায় ভর্তি হয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। কয়েক মাস আগেই বিয়েও হয়েছিল তাঁর। এই ঘটনায় ভেঙে পড়েছে গোটা পরিবার। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়েও ডাক উঠেছে পায়েলের সুবিচারের।
পায়েলের বাবা স্থানীয় জেলা পরিষদের অফিসে সরকারি চাকরি করেন নিচু পোস্টে। দাদা শারীরিক প্রতিবন্ধী, বাড়িতে বসে মোবাইল সারায়। দাদাকে ছোট থেকে দেখেই ডাক্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পায়েল। পায়েলের মা আবেদা তাদভি বলেন, “আমাদের গোটা জাতের মধ্যে ও-ই প্রথম মেয়ে, যে ডাক্তারি পাশ করেছিল। আমাদের পরিবারে কেউ এত বড় হয়নি ওর মতো। ও এত পরিশ্রম করেছিল ডাক্তার হবে বলে…. সব শেষ।
পায়েলের স্বামী সলমন তাদভিও ওই একই হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি বলেন, “ও যখন নায়ার হাসপাতালে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করতে এল, ওকে কয়েক দিনের জন্য হেমা আহুজা এবং ভক্তি মেহারের সঙ্গে থাকতে বলা হয়েছিল। তখন থেকেই ওকে অবদস্থ করতে থাকে ওরা। এমনকী ওরা টয়লেট থেকে এসে ইচ্ছে করে পায়েলের খাটে পা মুছত।
পায়েলের পরিবারের দাবি, গত বছর ডিসেম্বর মাসে পায়েলের মা আবেদা তাদভি নিজে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। তিনি বলেন, “আমার মেয়েটার খুব মনের জোর ছিল। অনেক দিন ধরে সহ্য করছিল। কিন্তু শেষমেশ ভেঙে পড়ল। জানতে পারিনি, এতটা হতাশ হয়ে গেছে ও।
তাঁর দাবি, দোষীদের যত দ্রুত সম্ভব শাস্তি হোক। ওদের এমন শাস্তি দেওযা হোক, যাতে আর কেউ কারও সঙ্গে এমনটা করতে সাহস না পায়। তবেই পায়েলের সুবিচার হবে।
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা ও দি ওয়াল, ২৭ মে, ২০১৯

Sunday, May 26, 2019

গোমাংস খাওয়ার অধিকার নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে গ্রেফতার আদিবাসী অধ্যাপক জিতরাই হাঁসদা।

গোমাংস খাওয়ার অধিকার নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে গ্রেফতার হলেন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আদিবাসী অধ্যাপক জিতরাই হাঁসদা।

গতবছর ২০১৭ এ আদিবাসীদের গোমাংস খাওয়ার অধিকার নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করেছিলেন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আদিবাসী অধ্যাপক জিতরাই হাঁসদা। তার জেরেই গ্রেফতার হলেন। বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডের সাকচির ঘটনা। অভিযোগ, সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি কলকাঠি নাড়ায় কলেজ থেকে সাসপেন্ডও হয়েছেন ওই অধ্যাপক। ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আদিবাসী সামাজিক সংগঠন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের রাজ্য নেতা দাসমত হাঁসদা। জিতরাই হাঁসদার পক্ষ নিয়ে কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিঠি লিখেছেন দাসমত হাঁসদা।
জিতরাইয়ের আইনজীবী জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ফেসবুকে পোস্টটি করেছিলেন ওই অধ্যাপক। তার পরেই তাঁর নামে অভিযোগ দায়ের হয়। ওই অধ্যাপককে থানায় হাজিরা দিতে বলা হলেও গ্রেফতার করা হয়নি তখন। প্রায় দুবছর পরে, গত কালই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন তিনি। তাঁর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক স্বার্থেই ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার পরে গ্রেফতার করা হয়েছে জিতরাইকে। ভোটের আগে আদিবাসীদের চটিয়ে তাঁদের সমর্থন হারাতে চায়নি রঘুবর দাসের নেতৃত্বাধীন রাজ্যের বিজেপি সরকার। ঝাড়খণ্ডে এ বার ১৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১২টি-ই পেয়েছে বিজেপি। অনেকেই মনে করছেন, আদিবাসী ক্ষুব্ধ হলে এতটা ভাল ফল করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব হত না।
জিতরাই নিজে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করেন। পাশাপাশি নাট্যব্যক্তিত্বও। ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, ভারতে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে গোমাংস খাওয়ার রেওয়াজ বহু দিনের। এটা তাঁদের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। ভারতে গোমাংস ভক্ষণ বিরোধী আইনের বিরোধী তাঁরা। তিনি আরও জানান, দেশের জাতীয় পাখি ময়ূরের মাংসও খান এই সম্প্রদায়ের মানুষ। ফেসবুকে হিন্দু রীতি অনুসরণ করার অনিচ্ছাও প্রকাশ করেন তিনি।
জিতরাইয়ের আইনজীবী জানিয়েছেন, ফেসবুক পোস্টটি করার কিছুদিনের মাথায় কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। তত দিনে তলায় তলায় জিতরাইকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে এবিভিপি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে তা জানার পরে কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চিঠি লেখে আদিবাসী অধিকার রক্ষা সংস্থা ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের রাজ্য নেতা দাসমত হাঁসদা। কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ একটি কলেজের অধ্যাপক জিতরাই। ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের নেতা দাসমত হাঁসদা কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে লেখা চিঠিতে লেখেন, ‘‘আদিবাসীরাও ভারতের নাগরিক। অন্যদের মতো আমাদেরও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করার অধিকার রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি গোহত্যায় নিষেধাজ্ঞা আনে, তবে তা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করবে।’’ যদিও এই চিঠিতে কাজ হয়নি। কিছু দিনের মাথায় সাসপেন্ড করা হয় জিতরাই হাঁসদাকে।
পুলিশ জানিয়েছে, এটা পুরনো ঘটনা। ওই অধ্যাপক বেশ কয়েক মাস নিখোঁজ ছিলেন। খবর পেয়ে গত কাল তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭/০৫/২০১৯।

উড়িষ্যার চন্দ্রাণী মুর্মূই এইবারে দেশের মধ্যে কনিষ্ঠতম সাংসদ।


কেওনঝড় লোকসভা কেন্দ্রের বিজেডি সাংসদ সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ ২৫ বছরের আদিবাসী কন্যা চন্দ্রাণী মুর্মূই এইবারে দেশের মধ্যে কনিষ্ঠতম সাংসদ।

সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি খুঁজছিলেন ২৫ বছরের আদিবাসী কন্যা চন্দ্রাণী মুর্মূ। সেই সময় উড়িষ্যার শাসক দল বিজু জনতা দল বা বিজেডি দলের পক্ষ থেকে কেওনঝড় লোকসভা আসনের জন্য প্রার্থী হবার প্রস্তাব আসে। লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশসেবার চাকরি পেলেন চন্দ্রাণী মুর্মূ এবং সেই সঙ্গে হলেন এবারের লোকসভায় দেশের মধ্যে কনিষ্ঠতম সাংসদ।
ওড়িশার আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা কেওনঝড় থেকে একেবারে সংসদে। নজরকাড়া প্রার্থীদের তালিকায় না থেকেও নজর কেড়েছেন গোটা দেশের। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে তিনিই এ বার কনিষ্ঠতম সাংসদ। চন্দ্রাণী মুর্মূর বয়স মাত্র ২৫ বছর। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। পড়াশোনা করেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। পড়া শেষে চাকরির খোঁজ করছিলেন। এমন সময়েই তাঁর কাছে নির্বাচনে লড়ার একটা সুযোগ চলে আসে। দ্বিতীয় বার ভাবেননি। ভোটে লড়ার প্রস্তাবটা শেষমেশ গ্রহণ করে ফেলেন। এমনটাই জানিয়েছেন চন্দ্রাণী।
যেখানে সংসদীয় ক্ষেত্র থেকে চন্দ্রাণী দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নই আদিবাসী মানুষগুলোর অন্যতম প্রধান চাহিদা। রাজনীতির অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু যে মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, তাঁদের সমস্যার অভিজ্ঞতাটা তাঁর অস্থিমজ্জায় রয়েছে। আর তাই এক জন সাংসদ হিসেবে তাঁর সর্বপ্রথম লক্ষ্যই হবে কেওনঝড়ে প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। জয়ের পর সংবাদমাধ্যমকে এমনটাই জানিয়েছেন কনিষ্ঠতম এই সাংসদ। চন্দ্রাণী বলেন, “এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, কেওনঝড়ের মতো খনিজসমৃদ্ধ জেলায় কর্মসংস্থানের প্রবল অভাব। রাজ্যের যুব সম্প্রদায় ও মহিলাদের হয়ে কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করবেন। পাশাপাশি তিনি এটাও জানান, তাঁর জেলায় শিল্প আনতে চেষ্টার কোনও খামতি রাখবেন না।
বিজু জনতা দলের টিকিটে কেওনঝড় থেকে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন চন্দ্রাণী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল দুবারের জয়ী বিজেপি সাংসদ অনন্ত নায়ক। সেই অনন্ত নায়ককেই ৬৬ হাজার ২০৩ ভোটে হারিয়েছেন চন্দ্রাণী। আর সেই সঙ্গে কেনওঝড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাঁর পথ প্রশস্ত হয়ে চলে গিয়েছে সংসদের অন্দরে!
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬/০৫/২০১৯।

Saturday, May 25, 2019

জঙ্গলমহলকন্যা মনিকা মাহাতকে ধর্ষণ করে খুনের বিচার চাইতে কলকাতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল।

২৫ শে মে, ২০১৯ শনিবার ‘জঙ্গলমহল উদ্যোগ’ এর ডাকে জঙ্গলমহল কন্যা মনিকা মাহাতকে ধর্ষণ করে খুনের বিচার চাইতে কলকাতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল।

জঙ্গলমহলের এক মেধাবী ছাত্রী মনিকা মাহাতকে ধর্ষণ করে খুনের প্রতিবাদে আজ ২৫ শে মে, ২০১৯ শনিবার ‘জঙ্গলমহল উদ্যোগ’ এর ডাকে মোমবাতি মিছিল হচ্ছে কলকাতা শহরের অ্যাকাদেমি-চত্বরে। জঙ্গলমহলের ১৭ বছরের মণিকা মাহাতোর খুনের অপরাধীদের শাস্তির জন্য। বিচারের দাবিতে আজই যেখানে জঙ্গল মহলের কুড়মি সম্প্রদায় নেতারা চার জেলায় বৈঠকে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছেন, সেখানে শহরে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জঙ্গলমহল উদ্যোগ। এ খবর নিয়ে ইতিমধ্যে ফেসবুকে পড়েছে নানা প্রতিবাদী পোস্ট।
পুরুলিয়ার বাসিন্দা প্রশান্ত রক্ষিতের কথায়, ‘মণিকার বয়স ১৭, পড়ত ক্লাস টুয়েলভে। ক্ষেতমজুর বাবা-মা গরিব। লেখাপড়ার কারণে বোরোর মামড়ো গ্রাম ছেড়ে মণিকা বান্দোয়ানে থাকত জেঠুর বাড়ি। ও ৯৫% নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। ৩ মে সকালে টিউশনে বের হয়েছিল মণিকা। জেঠুর বাড়িতে জানিয়ে গিয়েছিল, সেই রাতে বাবা-মায়ের কাছেই থাকবে। কিন্তু পড়া শেষে বাড়ি যেতে বান্দোয়ানের বাসস্ট্যান্ড অপেক্ষারত মণিকাকে নাকি তুলে নিয়ে যায় এক সুমো গাড়ি। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ। পরে মণিকার দেহর সন্ধান মেলে, সেখানকার ডুংরি টিলায়। গলায় গভীর দাগ। অনুমান তাকে ধর্ষণ করে, খুন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে মণিকার পরিচিত দুই যুবক। কিন্তু তারপর তদন্ত থমকে। অপরাধীদের আড়াল করছে পুলিশ। সেই কারণেই বোকারো জাতীয় সড়কে বসেছেন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। সিআইডি তদন্তের দাবিতে ঘেরাও হয়েছেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার। কলকাতায় সংগঠনের তরফে সুভাষ রায়, গোপা চক্রবর্তীদের বক্তব্য, ‘ভোটের জন্য মিছিল করতে দেরি হয়ে গেল, তবু মেয়েটার জন্য অবশ্যই কিছু করা উচিত।
সৌজন্য – এইসময়, সুমিত দে, ২৫/০৫/২০১৯।   

Wednesday, May 15, 2019

পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে আদিবাসী নাবালিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগে জওয়ানের জেল।


আদিবাসী নাবালিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগে ধৃত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিল রঘুনাথপুর মহকুমা আদালত। বিএসএফএর এএসআই পদে কর্মরত রাজবীর সিং নামে ওই জওয়ানের বাড়ি রাজস্থানে। জওয়ানের এই কাজে এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, যাদের উপর সুরক্ষার দায়িত্ব রয়েছে, তারাই যদি মেয়েদের প্রতি এমন ব্যবহার করে তাহলে মানুষ কার উপর ভরসা রাখবে। এনিয়ে নানা মহলে গুঞ্জন উঠছে।
উল্লেখ্য, রবিবার ষষ্ঠ দফার নির্বাচনে রঘুনাথপুর মহকুমার কাশীপুর ব্লকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেখানে রাজবীর সিং নামে ওই জওয়ানকে রিজার্ভে রাখা হয়েছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রিজার্ভে থাকার কারণে ওই জওয়ান কাশীপুরের আগরডি-চিত্রা পঞ্চায়েতের ভাটিন এলাকার জঙ্গলে একা মদ খেতে যায়। সেই সময় জঙ্গলে এক আদিবাসী নাবালিকাকে একা পেয়ে তার শ্লীলতাহানি করে বলে অভিযোগ। সেই সময় নাবালিকাটি চিৎকার করলে স্থানীয় বাসিন্দারা ছুটে এসে মেয়েটিকে উদ্ধার করে। বাসিন্দাদের দেখে ওই জওয়ান পালিয়ে যায়। ওই রাতেই এনিয়ে নাবালিকার পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয়। সোমবার ওই জওয়ান ভোটের ডিউটি করতে পুরুলিয়া ছেড়ে কলকাতা ও শহরতলি এলাকায় যাচ্ছিল। তখনই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিস রাজবীরকে গ্রেপ্তার করে।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের এই কাজে সকলে হতবাক। বিষয়টি নিয়ে কাশীপুর ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি তথা জেলা পরিষদের সদস্য সৌমেন বেলথরিয়া বলেন, ভোটে যারা সাধারণ মানুষকে অভয় দান করতে এসেছে, তারাই এমন বিচিত্র ঘটনা ঘটাচ্ছে। কোথাও বুথে লাঠি চার্জ, কোথাও ঝামেলা করা, কোথাও গুলি, এবার আবার শ্লীলতাহানির ঘটনা। মানুষ কার উপর ভরসা রাখবে। শুনেছি, ওই জওয়ান জঙ্গলে মদ খেতে গিয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক কমলাকান্ত হাঁসদা বলেন, ঘটনার কথা শুনেছি। এই ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আমরাও এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। (ছবি - প্রতীকী)
সংবাদ সৌজন্য – বর্তমান পত্রিকা, ১৫/০৫/২০১৯।

Tuesday, May 14, 2019

আদিম আদিবাসী টোটো সমাজের জীবন্ত কিংবদন্তী ধনীরাম টোটো।


ধনীরাম টোটো একজন টোটো ভাষাভাষী মানুষ। থাকেন আলিপুরদুয়ারে মাদারিহাট থানা এলাকার টোটোপাড়ায়। চাকরি করেন রাজ্য সরকারের অধীন অনগ্রসর শ্রেণীকল্যাণ দপ্তরে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই ভাষাভাষির মানুষ এই বাংলায় আছেন মাত্র ১৬০১ জন। ভাষা থাকলেও এই জনজাতির এখন পর্যন্ত কোনও লিপি নেই। টোটো সমাজের জন্য নিজস্ব লিপির জন্য বিরল লড়াই করেছেন ধনীরাম টোটো। বাংলা হরফে লেখা টোটো ভাষা কবিতা, সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে প্রান্তিক ডুয়ার্সের এই মানুষটাকে বার বার নিজেদের লিপি না থাকার কথা কুরে কুরে খেত। টবি আন্ডারসন নামে ভাষাতত্ত্বের বিশারদ এক অষ্ট্রেলিয়ান নাগরিকের সহায়তায় অবশেষে টোটো সমাজের জন্য নিজস্ব লিপি তৈরির কাজটা শুরু করেন ধনীরাম। যা শেষ হয়েছে সম্প্রতি। 
ধনীরাম বলেন, ‘একটা জাতি যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষায় কোনও লিপি নেই। যারা এই পরিস্থিতির মুখে আছেন একমাত্র তারাই এই অসুবিধের কথা বুঝতে পারবেন। কী করে টিকবে সেই জাতি?’
বেটেখাঁটো চেহারার ধনীরাম টোটো রাতের পর রাত জেগেছেন। সংসারের চাহিদা বেশি নয়, তাই সরকারি কর্মী হিসেবে যে টুকু টাকা বেতন হিসেবে পেয়েছেন, তা দিন যাপনের জন্য রেখে বাদ বাকি পুরোটাই প্রায় খরচ করে দিয়েছেন ভাষাতত্ত্ব, ফোনেটিক, লিপির বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানা বই সংগ্রহ করতে। তিন বছর ধরে টানা অধ্যবসায়ের পর এখন ধনীরাম অনেকটা নিশ্চিত। তাঁর মনে হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যতম বিপন্ন ভাষাকে বাঁচানোর মতো একটি চলনসই লিপি তিনি আবিস্কার করে ফেলেছেন। এবার ধনীরামের সামনে আসল চ্যালেঞ্জ। এতদিন যে ভাষার কোনও লিপিই ছিল না, সেই লিপির স্বীকৃতির জন্য ভাষা দিবসের প্রাক্কালে শপথ নিয়েছেন তিনি।
এই লিপি বোঝাতে বাংলা ও ইংরেজি হরফ ব্যবহার করে একটি শব্দকোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে ধনীরাম ভালো মতোই জানেন, কেবল লিপি আবিস্কারের দাবি করলেই হবে না। এই বিপন্ন ভাষাকে বাঁচাতে প্রয়োজন পড়বে সরকারি স্বীকৃতির এবং ছাড়পত্র লাগবে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। রসদ খুব কম। তার মধ্যেও নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে এলাকায় কিছু কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করেছেন তিনি। সেখানে এলাকাবাসীর পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষাবিদদেরও ডেকেছিলেন এই মানুষটি। এমনই এক সেমিনারে ধনীরামের লিপি আবিস্কার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে, টোটো লিপি শিখলে কী চাকরি পাওয়া যাবে? ধনীরামের বক্তব্য, ‘বুদ্ধিজীবীরা কী জানেন না, ইংরেজি ভাষা শিখেও ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না। টোটো ভাষা চাকরি আনতে পারবে কি না জানি না। কিন্তু এতো আমাদের জাতিসত্ত্বার প্রশ্ন। একটা ভাষাকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া।
এই তাগিদেই ধনীরাম নিজের কাজ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। কিন্তু সেবার মুখ্যমন্ত্রী ধর্মতলায় ধর্না মঞ্চে আন্দোলনরত থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি ধনীরামের। ফিরে গিয়ে এলাকার সরকারি বেসরকারি স্কুল এবং নিজের দপ্তরে সেই কাজ জমা করেছেন। ১ মার্চ, ২০১৯ কলকাতায় টোটো জনজাতি এবং ধনীরামের কাজ নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের উদ্বোধন করেন কলকাতায় তাঁর বন্ধু স্বপন বসু। ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘১৯৭৮ সালে শেষবার অলচিকি লিপিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারপর আর কোনও লিপিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি। ধনীরামের কাজ নিয়ে সরকারের কাছেই আবেদন করতে হবে। লিপিগুলি আলাদা হতে হবে, তবে এতটা আলাদা যেন না হয় যাতে চিনতে অসুবিধে হয়।
সৌজন্য – এইসময়, জয় সাহা, ২১/০২/২০১৯।  

Sunday, May 12, 2019

ভোট নিয়ে উৎসাহ নেই পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডীর আদিবাসী পাহাড়িয়াদের।


দুবেলা ভরপেট খাবার জোটাতে দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়, আর তাই ভোট নিয়ে উৎসাহ নেই পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডীর আদিবাসী পাহাড়িয়াদের।

ডিজিটাল ইন্ডিয়া নামক প্রদীপের তলায় আজও পড়ে আছে ভারতবর্ষের একটি গ্রাম বড়গোড়া যেখানে চলতি লোকসভা ভোট নিয়ে কোন তাপ-উত্তাপ নেই। আর তাপ-উত্তাপ থাকবেই বা কি করে ? এখনও পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী এই গ্রামে ভোট প্রচার করতে আসেন নি। কোন দলের প্রচারে দেওয়াল লিখনও নেই।
পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি পাহাড় কোলে একপাশে থাকা এই গ্রামটি সমতল থেকে প্রায় শখানেক ফুট উঁচুতে। চারিদিকে জঙ্গল ঘেরা এলাকায় পাহাড়িয়া আদিবাসীদের বাস। ১৪টি পাহাড়িয়া পরিবার। সেই গ্রামে পা রাখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে। গ্রামের একেবারে পিছন দিকে কাঁঠাল গাছের তলাতেই যে বনপার্টির লোকেরা মিটিং বসাত। লম্ফ নিয়ে বিপ্লবের পাঠ দিত। সমাজ বদলানোর স্বপ্ন দেখাত। গণ আদালতে শাস্তির কথাও আলোচনা হত এই কাঁঠাল গাছের তলায়। তারপর বন্দুক নিয়ে কার্যকর হত মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা। মিটিং বসত ভোট বয়কটের। ফলে এই বড়গোড়া সেভাবে বুথমুখী হত না।
কিন্তু, এখন দিন বদলেছে। বনপার্টি আর নেই। ফলে রাতের অন্ধকারে লম্ফ নিয়ে বসে না মিটিং। গণ আদালতে শাস্তির কথাও উঠে আসে না। আলোচনা হয় না ভোট বয়কটের। তবুও নির্বাচন কমিশনের ভাষায় দেশের সবচেয়ে বড় পরব ভোট উৎসবনিয়ে কোনও উৎসাহ নেই এই বড়গোড়ার। গ্রামের আদিবাসী পাহাড়িয়ারা বলেন, “ভোটের আগের দিন স্লিপ দিতে আসবেক। তখনই জানতে পারব কবে ভোট বটে।  এর বেশি লোকসভা ভোট নিয়ে আর কোনও ভাবনাই নেই এই পাহাড়ি জনপদের। থাকবেই বা কি করে? গাঁয়ের একটি মাত্র কুয়োতে এই বৈশাখেই জলস্তর নেমে গিয়েছে ৪০ ফুট নিচে। তাই প্রায় এক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ভেঙে অযোধ্যা পাহাড়ের বাঁকাদহ ঝরনা থেকে হাঁড়ি-কলসি নিয়ে জল আনতে হয় মহিলাদের।
দুবেলা ভরপেট খাবার জোটাতে, দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কাঠ কুড়িয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বলরামপুর হাটে বিক্রি করতে যেতে হয়। তারপর সেই কাঠ বেঁচে পাওয়া টাকায় ১৬ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি পথে অযোধ্যা হিলটপের কচুরিরাখা গ্রাম থেকে রেশন আনলে তবেই উনুনে হাঁড়ি চড়ে। তাই আদিবাসী পাহাড়িয়ারা বলেন, “পেট চালাতেই যে দিন চলে যায়। তাই ভোট-টোট নিয়ে কোনও চিন্তা মনে আসে নাই।ফলে ১০ কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা যাওয়ার পথে শিমূলবেড়া বুথে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের মানেও যেন সঠিকভাবে বোঝে না এই বড়গোড়া। তাই, দেশের নাম জানা নিয়েও কোনও উৎসাহ নেই ওঁদের।
সংবাদ সৌজন্য – সংবাদ প্রতিদিন, সুমিত বিশ্বাস, ১০/০৫/২০১৯।

Saturday, May 11, 2019

লক্ষ্য আদিবাসী ভোট, নির্বাচনী প্রচারে জান লড়িয়ে দিচ্ছে সমস্ত রাজনৈতিক দল।


এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবন কাশীপুরের শুকদেব হেমব্রম বা বাঘমুন্ডির বুধনি হাঁসদার। বনবাসী হিসেবে জমির পাট্টা পেয়ে গিয়েছেন। সে কারণেই তাঁদের গ্রামে যখন প্রচারে আসেন তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো, তখন গোটা গ্রাম স্বাগত জানায়।
প্রচারে সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়েছে। ডুমসাই গ্রামে যখন পৌঁছলেন ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম, প্রখর গরমে তাঁকে বেলের সররত এনে দিলেন গ্রামবাসীরা। আবার আররা পঞ্চায়েতের আদিবাসী গ্রামে তাঁকে ডাবের জল দিলেন মানুষ।
মহম্মদবাজারের গণপুর, চরিচা গ্রামে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডলকে আবার গলায় বনফুলের মালা পরালেন আদিবাসী মহিলারা। নিজস্ব প্রথায় পিতলের ঘড়ায় জল ভরে রাখা হয় তাঁর পায়ের কাছে।
আদিবাসী ভোট পেতে জান লড়িয়ে দিচ্ছে সব পক্ষই। আদিবাসী মন জয়ে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের বেশ কিছু জায়গায় সাঁওতালি ভাষা এবং অলচিকি হরফে দেওয়ালও লিখেছে তৃণমূল। মালদাতেও সাঁওতালি ভাষা কিন্তু বাংলা হরফে লিখে প্রচার চালিয়েছে শাসকদল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৬টি আসনের মধ্যে ১৩টিতেই জিতেছিল তৃণমূল। তবু আদিবাসী সমর্থন আদায়ে চেষ্টার কসুর করছে না শাসকদল।
উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা-বাগান এবং পশ্চিমের জঙ্গলমহলে, বীরহর, শবর, টোটোদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজে প্রথম থেকেই ২ টাকা কিলো চাল দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তার পরেও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ১৬টি বিধানসভার মধ্যে ৪টিতে লিড পেয়েছিল বিজেপি। যদিও গত বিধানসভা ভোটে মাত্র একটিই ধরে রাখতে পেরেছে তারা। সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির আদিবাসী ভিত্তিতে সার্বিক ফাটলের ইঙ্গিত মিলেছে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং রাজস্থান বিধানসভার ভোটেও।
পুরুলিয়ার কাশীপুর, বাঘমুন্ডি, বান্দোয়ান, সাঁতুরির মতো এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে বাস আদিবাসীদের। মৃগাঙ্ক মাহাতোর দাবি, ‘পুরুলিয়া তো বটেই, সারা রাজ্যেই বেশির ভাগ আদিবাসী মানুষকে ইতিমধ্যে বনবাসী হিসেবে জমির পাট্টা দিয়েছে আমাদের সরকার। সে কারণেই আদিবাসী গ্রামে প্রচারে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।সুপ্রিম কোর্ট আদিবাসীদের নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে সংশোধন আনায় প্রতিবাদে রেল রোকো হয়েছিল খড়গপুর, ইসলামপুর-সহ রাজ্যের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায়। এ নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে। মোদী জমানায় সংখ্যালঘুদের মতো আদিবাসীদের মধ্যেও যে সঙ্কট-বোধ তৈরি হয়েছে, তার জেরে আদিবাসীদের মন জয় আরও সুগম করতে চাইছে তৃণমূল।
বাম জমানায় আদিবাসীদের সমর্থন মোটের উপর ছিল বামেদের দিকেই। ২০১১-র পরিবর্তনের ভোটেও ১৬টির মধ্যে ১০টি আসনেই জিতেছিল বামেরাই। তবে পরিস্থিতি বদলেছে অনেকটাই। তবু দেবলীনা হেমব্রমরা বলছেন, ‘নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রামে আন্তরিক সাড়া পাচ্ছি। আশা করি, আদিবাসীদের সমর্থন ফের বামেদের দিকেই আসবে।আবার গেরুয়া শিবিরেরও আশা, সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনের জোর আর তৃণমূলের উপর বিরক্ত হয়েই আদিবাসীদের বড় অংশ সমর্থন করবেন বিজেপিকেই।
উত্তরবঙ্গের মুজনাই, রামঝোরার মতো চা-বাগানে গত কয়েক বছর ধরেই সাংগঠনিক বিস্তার ঘটিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। উত্তরবঙ্গের বহু চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় এখন বজরঙ্গবলী মন্দির। হবিবপুরের বিধায়ক খগেন মুর্মু সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে মালদা (উত্তর) কেন্দ্রে প্রার্থীও হয়েছেন। হবিবপুর, গাজোল, মালদা বিধানসভা কেন্দ্রেও উল্লেখযোগ্য ভোট আদিবাসীদের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই লোকসভা কেন্দ্রে ৬টি জেলা পরিষদের আসনে বিজেপি জেতায় লোকসভাতেও আশাবাদী খগেন।
এর পাল্টায় রামপুরহাট, নলহাটির গ্রামে প্রচারের ফাঁকে আদিবাসী মহিলাদের সঙ্গে নেচেছেন বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। আদিবাসী গ্রামে ধামসা, মাদল বাজিয়ে প্রচার সেরেছেন আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তিরকেও।
বান্দোয়ান, বিনপুর, রানিবাঁধ, ঝাড়গ্রামের মতো জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা এক সময় ছিল মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলা করে আদিবাসী গ্রামে উন্নয়নই নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলের মস্ত হাতিয়ার। উন্নয়ন, বনবাসী পাট্টা, পশ্চিমাঞ্চলে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে আদিবাসী যুবকদের নিয়োগ, ২ টাকার চাল, জঙ্গলমহলের জন্য বিশেষ রেশন কার্ড, বন্ধ চা বাগানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথাই আদিবাসী এলাকায় প্রচারে তুলে ধরছে শাসকদল। আর সেই উন্নয়নের ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টাতেই ব্যস্ত বিরোধীরা। ‘ডোলের রাজনীতি আদপে উন্নয়ন কিনা, আত্মসম্মানের কিনা সে প্রশ্নও অবশ্য উঠছে।
সৌজন্য – এইসময়, কৌশিক সরকার, ১০/০৫/২০১৯।

সরকারী সুযোগ সুবিধে ও উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত ভাঙ্গড়ের আদিবাসী মহল্লা।


আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে বেজায় ক্ষিপ্ত ভাঙড়ের আদিবাসী মহল্লা। ফি বছর নির্বাচন এলেই দেখা মেলে নেতাদের। হাতজোড় করে তাঁরা গ্রামে আসেন ভোট ভিক্ষা করতে। গালভরা প্রতিশ্রুতি দেন এলাকার উন্নয়ন নিয়ে। পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বেহাল রাস্তা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরকারি আবাসের কথা বলেন। কিন্তু কোথায় কী? ভোট মিটে গেলেই সব ফক্কা। ধুলোয় গড়াগড়ি খায় সব প্রতিশ্রুতি। যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যায় ভাঙড়ের আদিবাসী মহল্লা। বাম-ডান সব আমলেই এখানে না জ্বলে বাতি, না পড়ে পিচের প্রলেপ, না জোটে মাথার উপর ছাদ। বছরভর কষ্ট করেই দিন কাটে আদিবাসী মানুষের। তাই এ বার আর বুথমুখী হবেন না বলে ঠিক করেছেন বেওতা কুলবেড়ের নতুন পাড়া, ঘাসখালির বাসিন্দারা। ভোটের কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছেন ওঁরা। গুচ্ছের অভিযোগ। গুচ্ছের বঞ্চনা। ওঁরা তাই ঠিক করেছেন, ভোট দিতেই যাবেন না। কোন নেতা কথা রাখে না। তাই ভোটে আগ্রহ নেই ভাঙড়ের আদিবাসী মহল্লার, বলছেন এলাকার আদিবাসীরা।
কুলবেড়িয়া নতুন পাড়াতেই বাস সাবিত্রী সরদার, আলপনা সরদারদের। সাবিত্রী দেবী বলেন, ‘প্রতিদিন এখান থেকে সাইকেল চালিয়ে নিউটাউনে যাই পরিচারিকার কাজ করতে। আজও এখানকার একমাত্র রাস্তা পাকা হল না, কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠল না। ভোট এলে নেতারা আসেন, প্রতিশ্রুতি দেন, তার পর ভোট মিটে গেলে নেতারাও হাওয়ায় মিলিয়ে যান।সরদার পাড়ার খালপাড়ে বাড়ি কাশী সরদারের। পেট চালাতে তিনি এবং এক নাবালক ছেলে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। সেই কাশীর ঝোপড়পট্টি কালবৈশাখির ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। কাশীর স্ত্রী সোনামণি সরদার বলেন, ‘একটা ঘরের জন্য পঞ্চায়েত, বিডিও অফিস সর্বত্র ছোটাছুটি করলাম। কিন্তু ঘর আমরা পেলাম না। তাই এ বার আমরা ভোট দিতে যাব না বলে ঠিক করেছি।’
ভাঙড় ২ ব্লকের একেবারে শেষ প্রান্তে নিউটাউন লাগোয়া বেওতা ১ অঞ্চলের ঘাসখালি এবং বেওতা ২ অঞ্চলের কুলবেড়িয়া নতুন পাড়ায় প্রায় দুশো আদিবাসী পরিবার আছে। সমগ্র ভাঙড়ে উন্নয়নের ছিটেফোঁটা দেখা গেলেও বরাবরই বঞ্চিত আদিবাসী মহল্লা। যা নিয়ে বারেবারেই ক্ষোভ জানিয়ে আসছেন আদিবাসীরা।
আদিবাসী গৃহবধূ সরস্বতী সরদার বলেন, ‘ভোটের দিন নেতারা আমাদের জন্য অটো, টোটো পাঠান বুথে যাওয়ার জন্য। কোনও কোনও রাজনৈতিক দল আবার বিরিয়ানি, মিষ্টির প্যাকেটের ব্যবস্থা করেন। আমাদের মতো গরিব মানুষ সে-সব পেয়ে সব ভুলে যান। কিন্তু ভোট মিটলেই আর কেউ আমাদের চিনতে পারেন না। পঞ্চায়েত প্রধান, উপপ্রধান, বিধায়ক কেউই আর এ তল্লাটে আসেন না আমাদের সুখদুঃখের খবর নিতে।এই পাড়া থেকে ভেড়ির পাড় ধরে চল্লিশ মিনিট সাইকেল চালিয়ে বামনঘাটায় যান কলেজ পড়ুয়া পূজা সরদার। সেখান থেকে আবার দুটো বাস পাল্টে গড়িয়াহাটের কলেজ। পূজার অভিযোগ, ‘যোগাযোগ অবস্থার উন্নতি না-হওয়ার জন্য এখানাকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
বেওতা ২ এর আদিবাসী পাড়াটি ৩৬ নং বুথের অন্তর্গত। ওই বুথের ৮৫০ জন ভোটারের মধ্যে ৪০০ ভোটার আদিবাসী। আদিবাসীদের অভিযোগ, তাঁরা ভোটে নির্ণায়ক শক্তি হলেও সরকারি শৌচালয়, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর, বাংলা আবাস যোজনার ঘর, বিশুদ্ধ পানীয় জল কিছুই জোটে না তাঁদের কপালে। এ নিয়ে আদিবাসীদের সংগঠন ‘অল আদিবাসী সাদ্রি সুশার অ্যাসোসিয়েশন’ জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছে। বেওতা ২-এর উপপ্রধান সুকুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমরা আদিবাসীদের জন্য যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ওঁদের জন্য সরকারি স্তরে যা করণীয় তা করা হয়।ভাঙড় ২ ব্লকের বিডিও কৌশিককুমার মাইতি বলেন, ‘ওই এলাকায় ১৮০ টির মতো পরিবার আছে। কিছুদিন আগে আধিকারিকরা গিয়ে প্রতিটি বাড়িই সার্ভে করেছেন। যাঁরা সঠিক দাবিদার তাঁরা সকলেই সরকারি আবাস যোজনার ঘর পাবেন।
সংবাদ সৌজন্য – এইসময়, প্রশান্ত ঘোষ, ১১/০৫/২০১৯।       

বাঁকুড়ার সিমলাপালে পানীয় জল ও রাস্তার দাবীতে পথ অবরোধ করলেন আদিবাসীরা।



বাঁকুড়া জেলার সিমলাপালের মন্ডল গ্রাম পঞ্চায়েতের লক্ষ্মণপুরে আদিবাসী মহিলারা পথ অবরোধ করলেন পানীয় জল ও রাস্তার দাবিতে। সিমলাপাল ভূতশহর রোডে লক্ষ্মণপুর বাস স্টপেজের কাছে প্রায় শতাধিক পরিবার পথ অবরোধ করেন। লক্ষ্মণপুরের এই আদিবাসি পাড়ার একশোর বেশী পরিবার গত তিন মাস ধরে পানীয় জলের সঙ্কটে ভুগছে। অভিযোগ, বার বার গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে বিডিও সকলকে জানিয়েও কোন ফল হয়নি। বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার জন্য তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে নদী থেকে জল নিয়ে এসে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করছেন।

এ প্রসঙ্গে মন্ডল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেবাশিষ রাম জানান, এই আদিবাসি পরিবারগুলির পানীয় জলের সমস্যার কোনও দরখাস্ত পঞ্চায়েতে জমা পড়েনি। কিন্তু যখন পানীয় জলের নিয়ে সমস্যার রাস্তা অবরোধ হয়েছে তাই এই মুহূর্তে বিডিও সাহেবের সাথে কথা বলে একটি জলের গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সংবাদ সৌজন্য - ANM NEWS, বনমালী ষন্নিগ্রহী, ১০/০৫/২০১৯।

Friday, May 10, 2019

তপশিলি উপজাতি হওয়ার আশা নিয়ে এবারেও ভোট দিয়েছেন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ধীমালরা।


ভোট মানে অধিকার। ভোট মানে একটা পরিচয়। কিন্তু যাঁদের পরিচয়টাই নেই? উত্তরবঙ্গের ধীমালরা লড়ছেন তপশিলি উপজাতি হওয়ার আশায়। প্রতিবার ভোটের আগে পরিচয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন নেতারা। ধীমালদের ভোটও পান। তবে ধীমালরা থেকে যায় ব্রাত্যই।
শিলিগুড়ি শহর থেকে খুব দূরে নয়। নেপাল সীমান্তের দিকে যেতে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, মাটিগাড়া ব্লক। মাত্র ২৫-৩০ কিলোমিটার হবে। সেখানে যেন এক আলাদা দেশ। থাকেন ধীমালরা। ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, সেই দেশ বাঁচে নিজের খেয়ালে।
পাশিংডো বা দোতারা, তুলজাই বা ঢোল, উড়নি, টুমনা, মরচুঙ্গা, গোমনার মতো বাঁশের তৈরি বাদ্যযন্ত্রে এখানে সুর বাজে। শিকার করার নাচকে ধীমালরা বলেন লেইয়াদা, গ্রামীণ পুজো এখানে ডেরাদি। পুলিশ প্রশাসন নয়, ধীমালদের সমস্যা মেটান প্রধান বা মাঝি। মাঝিরা খবর পান লানডার থেকে। দোষীদের শাস্তি দেয় মাঝির নেতৃত্বে পঞ্চ।
উত্তরবঙ্গের তরাইয়ের অন্যতম প্রাচীন জনজাতি ধীমাল। ১৪টি গ্রামে প্রায় ৪০০ বছর ধরে ধীমালদের বাস। এখন জনসংখ্যা ১ হাজার ১৫ জন। এঁদের মধ্যে ভোটার ৩০০ জন। এঁরা ঝুম চাষ এবং শিকার নির্ভর জনজাতি।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ধীমালরা মঙ্গোলীয় উপজাতির। কোচ, মেচ, রাভা, লিম্বু জনজাতির সঙ্গে ধীমালদের কিছু মিল থাকলেও বেশিরভাগটাই অমিল। অস্তিত্বের লড়াইয়ে নেমে তাঁরা বারবার দাবি জানিয়েছেন, তপশিলি উপজাতি হওয়ার। প্রতি ভোটে নিয়ম করে ভোটও দিয়েছেন, তবে দাবি মেটেনি। উলটে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে গিয়েছেন। এই জনজাতির মধ্যে প্রথম স্নাতক গর্জন মল্লিক স্থানীয় পানিঘাটা হাইস্কুলের শিক্ষক। তাঁর প্রশ্ন, সংখ্যায় কম বলেই কি অবহেলা ?
বিজেপির ইশতেহারে গতবারের মত এবারেও জায়গা পেয়েছে ধীমালদের মর্যাদার দাবি। তবে প্রতিবারই বিশ্বাস ভাঙে ধীমালদের। কেউ কথা রাখে না। ধীমালরা নিজেদের জীবনেই খোঁজে খুশির আলো। শুধু অস্তিত্বের অন্ধকার মুছতে চাওয়ার দাবি। ভোট দিলেও কেন ব্রাত্য থাকা? প্রশ্ন তোলে প্রাচীন জনজাতি।
সংবাদ সৌজন্য - News18 Bangla, April 17, 2019

লক্ষ্য আদিবাসী ভোট, নির্বাচনী প্রচারে জান লড়িয়ে দিচ্ছে সমস্ত রাজনৈতিক দল।


এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবন কাশীপুরের শুকদেব হেমব্রম বা বাঘমুন্ডির বুধনি হাঁসদার। বনবাসী হিসেবে জমির পাট্টা পেয়ে গিয়েছেন। সে কারণেই তাঁদের গ্রামে যখন প্রচারে আসেন তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো, তখন গোটা গ্রাম স্বাগত জানায়।
প্রচারে সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়েছে। ডুমসাই গ্রামে যখন পৌঁছলেন ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম, প্রখর গরমে তাঁকে বেলের সররত এনে দিলেন গ্রামবাসীরা। আবার আররা পঞ্চায়েতের আদিবাসী গ্রামে তাঁকে ডাবের জল দিলেন মানুষ।
মহম্মদবাজারের গণপুর, চরিচা গ্রামে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডলকে আবার গলায় বনফুলের মালা পরালেন আদিবাসী মহিলারা। নিজস্ব প্রথায় পিতলের ঘড়ায় জল ভরে রাখা হয় তাঁর পায়ের কাছে।
আদিবাসী ভোট পেতে জান লড়িয়ে দিচ্ছে সব পক্ষই। আদিবাসী মন জয়ে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রের বেশ কিছু জায়গায় সাঁওতালি ভাষা এবং অলচিকি হরফে দেওয়ালও লিখেছে তৃণমূল। মালদাতেও সাঁওতালি ভাষা কিন্তু বাংলা হরফে লিখে প্রচার চালিয়েছে শাসকদল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৬টি আসনের মধ্যে ১৩টিতেই জিতেছিল তৃণমূল। তবু আদিবাসী সমর্থন আদায়ে চেষ্টার কসুর করছে না শাসকদল।
উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা-বাগান এবং পশ্চিমের জঙ্গলমহলে, বীরহর, শবর, টোটোদের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজে প্রথম থেকেই ২ টাকা কিলো চাল দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তার পরেও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ১৬টি বিধানসভার মধ্যে ৪টিতে লিড পেয়েছিল বিজেপি। যদিও গত বিধানসভা ভোটে মাত্র একটিই ধরে রাখতে পেরেছে তারা। সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপির আদিবাসী ভিত্তিতে সার্বিক ফাটলের ইঙ্গিত মিলেছে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং রাজস্থান বিধানসভার ভোটেও।
পুরুলিয়ার কাশীপুর, বাঘমুন্ডি, বান্দোয়ান, সাঁতুরির মতো এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে বাস আদিবাসীদের। মৃগাঙ্ক মাহাতোর দাবি, ‘পুরুলিয়া তো বটেই, সারা রাজ্যেই বেশির ভাগ আদিবাসী মানুষকে ইতিমধ্যে বনবাসী হিসেবে জমির পাট্টা দিয়েছে আমাদের সরকার। সে কারণেই আদিবাসী গ্রামে প্রচারে ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছি।সুপ্রিম কোর্ট আদিবাসীদের নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে সংশোধন আনায় প্রতিবাদে রেল রোকো হয়েছিল খড়গপুর, ইসলামপুর-সহ রাজ্যের আরও বেশ কয়েকটি জায়গায়। এ নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে। মোদী জমানায় সংখ্যালঘুদের মতো আদিবাসীদের মধ্যেও যে সঙ্কট-বোধ তৈরি হয়েছে, তার জেরে আদিবাসীদের মন জয় আরও সুগম করতে চাইছে তৃণমূল।
বাম জমানায় আদিবাসীদের সমর্থন মোটের উপর ছিল বামেদের দিকেই। ২০১১-র পরিবর্তনের ভোটেও ১৬টির মধ্যে ১০টি আসনেই জিতেছিল বামেরাই। তবে পরিস্থিতি বদলেছে অনেকটাই। তবু দেবলীনা হেমব্রমরা বলছেন, ‘নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রামে আন্তরিক সাড়া পাচ্ছি। আশা করি, আদিবাসীদের সমর্থন ফের বামেদের দিকেই আসবে।আবার গেরুয়া শিবিরেরও আশা, সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনের জোর আর তৃণমূলের উপর বিরক্ত হয়েই আদিবাসীদের বড় অংশ সমর্থন করবেন বিজেপিকেই।
উত্তরবঙ্গের মুজনাই, রামঝোরার মতো চা-বাগানে গত কয়েক বছর ধরেই সাংগঠনিক বিস্তার ঘটিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। উত্তরবঙ্গের বহু চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় এখন বজরঙ্গবলী মন্দির। হবিবপুরের বিধায়ক খগেন মুর্মু সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে মালদা (উত্তর) কেন্দ্রে প্রার্থীও হয়েছেন। হবিবপুর, গাজোল, মালদা বিধানসভা কেন্দ্রেও উল্লেখযোগ্য ভোট আদিবাসীদের। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই লোকসভা কেন্দ্রে ৬টি জেলা পরিষদের আসনে বিজেপি জেতায় লোকসভাতেও আশাবাদী খগেন।
এর পাল্টায় রামপুরহাট, নলহাটির গ্রামে প্রচারের ফাঁকে আদিবাসী মহিলাদের সঙ্গে নেচেছেন বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। আদিবাসী গ্রামে ধামসা, মাদল বাজিয়ে প্রচার সেরেছেন আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তিরকেও।
বান্দোয়ান, বিনপুর, রানিবাঁধ, ঝাড়গ্রামের মতো জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা এক সময় ছিল মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলা করে আদিবাসী গ্রামে উন্নয়নই নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলের মস্ত হাতিয়ার। উন্নয়ন, বনবাসী পাট্টা, পশ্চিমাঞ্চলে সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে আদিবাসী যুবকদের নিয়োগ, ২ টাকার চাল, জঙ্গলমহলের জন্য বিশেষ রেশন কার্ড, বন্ধ চা বাগানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথাই আদিবাসী এলাকায় প্রচারে তুলে ধরছে শাসকদল। আর সেই উন্নয়নের ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টাতেই ব্যস্ত বিরোধীরা। ‘ডোলের রাজনীতি আদপে উন্নয়ন কিনা, আত্মসম্মানের কিনা সে প্রশ্নও অবশ্য উঠছে।
সৌজন্য – এইসময়, কৌশিক সরকার, ১০/০৫/২০১৯।

Thursday, May 9, 2019

জীবিকার জন্য হাওড়া জেলার জলাভূমি থেকে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি সংগ্রহ আদিবাসী শবর মহিলাদের।

জীবিকার জন্য হাওড়া জেলার জলাভূমি থেকে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি সংগ্রহ করেন আদিম আদিবাসী শবর মহিলারা।

হাওড়া জেলার জলাভূমি এই গরমে আদিম আদিবাসী শবর মহিলাদের সামান্য রোজগারের সুযোগ করে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রায় প্রতিদিন খড়গপুর থেকে হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনে করে বাগনান, ফুলেশ্বর, আবাদা, মৌড়িগ্রাম এর জলাভূমি থেকে শামুক, গেঁড়ি, গুগলি সংগ্রহ করতে যান আদিম আদিবাসী শবর মহিলারা। সংগ্রহ করা শামুক, গেঁড়ি, গুগলি পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে দিন গুজরান করেন আদিম আদিবাসী শবর মহিলারা।
প্রতিদিন বাসি ভাত, মুড়ি, ঘুগনি ইত্যাদি খেয়ে আদিবাসী মহিলারা দল বেঁধে ভোরের ট্রেন ধরেন। তার পরে কেউ নামেন বাগনান, কেউ ফুলেশ্বর, আবাদা, কেউ বা মৌড়ীগ্রাম স্টেশনে। নেমে কখনও কাছাকাছি গ্রামে, কখনও বা বাসে করে আরও ভিতরে অন্য কোনও গ্রামে। অতঃপর সেখানকার জলায় গেঁড়ি, গুগলি, কটু (ছোট কচ্ছপ) খোঁজা। কোন স্টেশনে দল নামবে, ঠিক নেই। দুদিন বাগনান হলে তার পরের তিন দিন হয়তো মৌড়ীগ্রাম।
গ্রামের পুকুরে গেঁড়ি, গুগলি খোঁজার জন্য আগে পয়সা দিতে হত না। এখন কোনও কোনও ঝিল মাস পাঁচেকের জন্য হাজার চারেক টাকা জমা নেয়। দলের দশ-পনেরো জন চাঁদা তুলে সেই টাকা জোগাড় করেন। অতঃপর সবাই মিলে দুপুর অবধি তন্নতন্ন করে জলার আগাছা হাতড়ানো। কোনও কোনও পুকুরমালিক আবার উদার। তাঁরা বলে দেন, গেঁড়ি-গুগলি খোঁজার আগে পুকুরের ধারের আগাছা, জঙ্গল সাফ করে দিতে হবে। বিনিময়ে দুপুরে তিনি ভরপেট ভাত দেবেন। পয়সা এবং গতর-খাটানো বিনিময় প্রথা দুটোই এই পুষ্করিণী-পৃথিবীতে স্বাগত।
দলটা ফেরার পথে আবার লোকাল ট্রেনে ওঠে। পাঁশকুড়া, হাউরে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বস্তা কিনে নেয়। ছোট গুগলি সব চেয়ে দামি, ৮ টাকা কেজি। আর বড় শামুক, ঝিনুক হলে কেজিতে পাঁচ টাকা। নগদ পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরে রান্না। পর দিন সকালে ফের সেই রুটিন।
সংগ্রহকারীরা অধিকাংশই জাতিতে শবর। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে সাঁওতাল, মুন্ডা, শবর প্রায় এক। কিন্তু ফারাক আছে। সাঁওতাল, মুন্ডারা বহু কাল চাষবাস করেন, নিকোনো ঘরদোর ছবির মতো সুন্দর। দুন্দুভি বেজে ওঠে ডিমডিম রবে/ সাঁওতাল পল্লিতে উৎসব হবে,’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার ওই সময়েই, ১৯৩১ সালেই ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার শবরদের ডাকাত ও অপরাধী জাতিবলে দেগে দিচ্ছে। অরণ্যচারী এই জনজাতি তখনও কৃষির সংস্পর্শে আসেননি, শিকারই জীবিকা। উপনিবেশের বাবুরা তাঁদের বাঁকা চোখে দেখবে, বলা বাহুল্য।
কোন কোনদিন ভাগ্যক্রমে জলায় গোসাপ পেলে হয় সেটি রান্না করে খাওয়া হয় অথবা কেটেকুটে, ছাল ছাড়িয়ে শবরপাড়ায় পরিচিত আগ্রহীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এক কেজি মাংসের দাম ৬০ টাকা। আগে আরও অনেক কিছু পাওয়া যেত। কিন্তু এখন এত কেমিক্যাল সার, পোকা মারার ওষুধের পাল্লায় কিছুই থাকে না। মানিকপাড়া, ঝাড়গ্রামে জলা শুকিয়ে যায়, হাওড়ার খালে তবু জিনিসপত্র মেলে, বলে জানান সংগ্রহকারীরা।
সংগ্রহকারী শবররা দুটাকা কেজি চাল পান। মাঝে মাঝে জঙ্গলে খাম আলু পাওয়া যায়। কিছু সব্জি কিনতে হয়। পাতে মহার্ঘ ডাল এবং মাছ রোজ জোটে না। প্রোটিন বলতে এই গেঁড়ি-গুগলি-গোসাপই ভরসা। গোসাপ শুনে শিউরে ওঠার কিছু নেই। চণ্ডীমঙ্গল’-এর কালকেতু ব্যাধ গোসাপ শিকার করেই ঘরে ফিরেছিল। বছরে বড়জোর ৪০ দিন খেতমজুরের কাজ জোটে।
বালিচক স্টেশনে নেমে টোটোয় চকসাহাপুর গ্রামে শবরপাড়ায় অধিকাংশ সংগ্রহকারীদের বাড়ি। গ্রামে চকসাহাপুর লোধা সেবক সংঘের মেয়ে হোস্টেল আছে। মেয়েরা সেখানে ক্লাস ফোর অবধি পড়াশোনা করে। লোধা সেবক সংঘের কর্মকর্তা প্রহ্লাদকুমার ভক্তা। লোধা সমাজের প্রথম মহিলা স্নাতক, আত্মহত্যা করে যিনি জীবন শেষ করে দিয়েছেন সেই চুনি কোটালের মামা এবং লোধাশবর সমাজে প্রথম স্নাতক এই প্রহ্লাদবাবু। তাঁর সাফ কথা, লোধা বালিকার জন্য সাইকেলের থেকেও হোস্টেল জরুরি। অন্তত, মাধ্যমিক অবধি মেয়েদের হোস্টেল জরুরি। বাবা, মা দুজনে শিকারের খোঁজে, দিনমজুরির কাজে। মেয়েই তখন ঘর সামলায়, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। ক্লাস ফোরের পর বাড়ি ফিরে তাই পড়াশোনা আর সে চালাতে পারে না।
সংবাদ সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৯/০৫/২০১৯।