বছর পনেরোর
মেয়েটার বাবা নেই। মা শয্যাশায়ী। দুই দিদি আছে, কিন্তু তারা কিছু করে
না। তাই সংসার চালানোই দায়। ফলে মেয়েটাকে একদিন কাজের কথা বলে এক পড়শি। তার সঙ্গে
মেয়েটিও এদিক সেদিক যাওয়া আরম্ভ করল। একদিন একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল মেয়েটিকে।
তাকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে দেওয়া হল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’জন খদ্দের হাজির। মেয়েটি ধর্ষিত হল। ওর হাতে সামান্য টাকা গুঁজে দিয়ে চলে
গেল দু’টি লোক। মেয়েটিকেও বাড়ি যেতে দেওয়া হল। কিন্তু ভয়
দেখানো হল, আবার না-এলে সবাইকে সব বলে দেওয়া হবে বলে। দিনে
প্রায় কুড়ি জন খদ্দের সামলে এক বছর পর মেয়ে যখন অসুস্থ, তখন
ব্যাপারটা ধরতে পারলেন তাঁর মা। খবর গেল কলকাতা পুলিশের মানব পাচার বিরোধী শাখায়।
অতঃপর কলকাতা পুলিশ ও ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন মেয়েটিকে উদ্ধার করে একটি বাড়ি
থেকে। গ্রেপ্তার হয় দুই যৌনকর্মী, যারা মেয়েটিকে দিয়ে
দেহব্যবসা করাত।
এ ভাবেই শহর
কলকাতা ও গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে ‘কমার্শিয়াল সেক্সুয়াল
এক্সপ্লয়েটেশন’ বা সিএসই। তবে তা শুধু গরিব, অসহায় মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানে সামিল
মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের স্কুলের মেয়েরাও। এবং তা ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়!
চমকানোর কিছু
নেই। কলকাতা পুলিশের তথ্যই বলছে, হুড়মুড়িয়ে বেড়েছে সিএসই। ১০ বছর আগে যা
ছিল, সে তুলনায় লাফিয়ে বেড়েছে এই প্রবণতা। আগে যেখানে
বিষয়টা এক্কেবারে আড়ালে-আবডালে হত, এখন রীতিমতো বিজ্ঞাপন
দিয়ে চলে এই ব্যবসা।
এই স্কুলের
মেয়েদের কিন্তু কেউ ভুলিয়ে আনছে না। তারা আসছে নিজে থেকে। এটা তাদের ‘পার্ট
টাইম’ কাজ। এতে যা পয়সা রোজগার হয়, তা
দিয়ে তারা তাদের শখ মেটায়। যেমন ফোন-ট্যাব কেনা, ভালো পোশাক
কেনা, নামি পাঁচতারা হোটেলে খাওয়া, এক কথায় হাইফাই
লাইফস্টাইলের জন্যই তারা এ পথ বেছে নিচ্ছে। আর এসব দেখে ওত পেতে থাকে দালালচক্রও।
বছরখানেক আগে একটি মধুচক্রে হানা দিয়ে পুলিশ ১৬ জন স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করে। তারা
প্রত্যেকেই ছিল স্কুল ইউনিফর্মে। সাম্প্রতিক কালে এই ধরনের অভিযোগ বাড়ছে বলে
জানাচ্ছে এ নিয়ে কাজ করা ‘ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন।’
পুলিশ সূত্র
বলছে, এর বাইরেও মেয়েদের ফাঁদে ফেলার উপায় আছে। এক অফিসারের কথায়, ‘লক্ষ্য করে দেখবেন, আজকাল ‘মনের
মতো বন্ধু পান’ বলে মোবাইলে ও কাগজে নানা বিজ্ঞাপন আসে,
মাস্যাজ পার্লারের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে থাকে রাস্তা ঘাট। এর অধিকাংশই
সিএসই-র জন্য। যেখানে বেশ ভালো টাকার বিনিময়ে শরীর কেনাবেচা হয়। আর সেখানে টার্গেট
মূলত স্কুলের মেয়েরাই।’
সিএসই-র এই
রমরমা কপালে ভাঁজ ফেলেছে পুলিশের। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘এর
সঙ্গে ভোগবাদেরও যোগ রয়েছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখন নানা গ্যাজেটে মজে। রয়েছে
লাক্সারি জীবনের হাতছানি। যেই মুহূর্তে সেগুলো তারা পাচ্ছে না, তারা সহজে আয়ের পথ খুঁজছে। এবং সেখানে সিএসই-র মোকাবিলা করা খুবই কঠিন।’
কাউন্সেলিং
করাতে গিয়ে পুলিশের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা ভয়াবহ। এই মেয়েরা মনেই
করছে না, তারা কোনও অপরাধ করছে। তাদের সাফ কথা, এতে অন্যায়ের কী আছে! যারা ভুলটা বুঝতে পারছে, তাদের
সংখ্যাটা হাতেগোনা।
পুলিশের মতে, একা
কোনও পক্ষই কিছু করতে পারবে না। একসঙ্গে কাজ করতে হবে পুলিশ, এনজিও এবং অভিভাবকদের। নজর রাখতে হবে বিজ্ঞাপনে, বিভিন্ন
পার্লার, লজ, হোটেল, প্রাইভেট রেসিডেন্স, সহ সর্বত্র। সর্বোপরি সচেতনতা বাড়াতে হবে স্কুলের
বাচ্চাদের।
সংবাদ সৌজন্য
– এইসময়, অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৯/০৭/২০১৯।
No comments:
Post a Comment