বীরভূম জেলায়
কয়লাখনি তৈরির জন্য জঙ্গল কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেন আদিবাসীরা।
বীরভূম জেলার
খয়রাশোল ব্লকের গঙ্গারামচক মৌজায় পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম খোলামুখ কয়লাখনি
তৈরির জন্য সম্প্রতি ১০১ হেক্টর বনভূমি সাফাইয়ের কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু এলাকার
আদিবাসীরা জঙ্গল ধ্বংস করার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার হয়েছেন। প্রথমে প্রতিবাদে
বিডিও-র দ্বারস্থ হয়েছিলেন বনভূমি সংলগ্ন এলাকার
কয়েকটি আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, এতে
পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ নষ্ট হচ্ছে, তাতে আঁচ পড়তে পারে স্থানীয়
মানুষের জীবন-জীবিকায়। প্রস্তাবিত খনিএলাকা সংলগ্ন বাস্তবপুর, সগড়ভাঙ্গা, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া
গঙ্গারামচক, দেবগঞ্জ এলাকার আদিবাসীরা গত মঙ্গলবার (১৬/০৭/২০১৯)
বিডিও-র কাছে লিখিত ভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এলাকাবাসীর বক্তব্য, এখনই হয়তো তাঁদের বসতে হাত পড়বে না, কিন্তু যে ভাবে
জঙ্গল কেটে কয়লাখনি তৈরির কাজ চলছে, তাতে ঘুরিয়ে তাঁদের
উচ্ছেদের পরিকল্পনাই করা হয়েছে। অথচ এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনাই করা হয়নি।
খয়রাশোলের
বিডিও সঞ্জয় দাস আদিবাসীদের প্রতিবাদপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলছেন, ‘‘কয়লা
খনি তৈরির জন্য কারও বসতে হাত পড়ছে না। তবে কয়লা খনি লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের
যাতে সমস্যা না হয়, তা নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কথা বলা হবে পশ্চিমবঙ্গ
বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও।’’
স্থানীয় প্রশাসনিক
সূত্রে জানা গিয়েছে,
২০১৪ সালে কয়লার ব্লক-বণ্টন বাতিল হওয়ার আগে খয়রাশোলের
কৃষ্ণপুর-বড়জোড় ও গঙ্গারামচক মৌজার মাটির নীচে কয়লা উত্তোলনের বরাত পায় ‘এমটা’। সেই কয়লা বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে
সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল ওই সংস্থার। ২০১১ সালের পর থেকে কৃষ্ণপুর-বড়জোড় অঞ্চল
এবং তার পরে গঙ্গরামচকে কিছু অংশে খোলামুখ খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন শুরু করেছিল তারা।
কিন্তু ২০১৪ সালে সারা দেশে ২০৪টি কোল-ব্লক বাতিলের তালিকায় ছিল খয়রাশোলের দু’টি ব্লক-ও।
২০১৫ সালে
নয়া কয়লা ব্লক বণ্টন আইনের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুত উন্নয়ন নিগম রাজ্যে যে
পাঁচটি কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব পায়, সেই তালিকায় নাম ওঠে
খয়রাশোলের বড়জোড় ও গঙ্গারামচক মৌজার। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছ থেকে
প্রয়োজনীয় অনুমোদন না মেলায় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে কয়লা উত্তোলন করা
যায়নি। জট কাটিয়ে ২০১৭ সালের শেষ দিকে খয়রাশোলের কৃষ্ণপুর-বড়জোড় মৌজা থেকে কয়লা
উত্তোলনের প্রস্ততি শুরু করলেও জটিলতা ছিল গঙ্গারাপুর নিয়েই। কারণ এই মৌজার একটি
বড় অংশে ছিল বিশাল জঙ্গল। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নিয়ম
মেনে ১০১ হেক্টর জায়গা নিজেদের নামে নিয়ে সেখানে জঙ্গল কাটাচ্ছে নিগম।
তা নিয়েই
আপত্তি তুলছেন প্রস্তাবিত কয়লাখনি লাগোয়া এলাকার আদিবাসীরা। বাবুরাম পাঁউরিয়া, সুমিতা
সরেন, তাপস মারান্ডি, মলিন্দ টুটু,
সোমনাথ হেমব্রমের মতো এলাকাবাসীর অভিযোগ, বনভূমি
কেটে ফেলায় তাঁদের জীবন-জীবিকায় আঘাত আসবে। জ্বালানি কাঠ, শালপাতা,
কেন্দু পাতা, খেজুর, মধু,
পিয়াল ফল — সবই তাঁরা সংগ্রহ করেন জঙ্গল থেকে।
জঙ্গল না থাকলে সেই পথ বন্ধ হবে। পাশাপাশি থাকবে না প্রচুর বন্যপ্রাণ।
তাঁদের আরও
আশঙ্কা,
কয়লাখনি থেকে তাঁদের বসতের দূরত্ব মাত্র ২-৩ কিলোমিটার। আগামী দিনে
কয়লা উত্তোলন শুরু হওয়ার পরে বিস্ফোরণ ঘটালে ফাটল ধরতে পারে তাঁদের মাটির বাড়িতে।
দূষিত হবে পরিবেশও।
বক্রেশ্বর
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জিএম অমরকুমার পাল বলছেন, ‘‘এ বিষয়ে আমার কানে কিছু
আসেনি।’’ বন দফতর জানিয়েছে, বনভূমি
নষ্ট হয়েছে, তাই ‘কমপেনসেটারি
অ্যাফোরেস্টেশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং অথরিটি’ কর্মসূচির আওতায় সম-পরিমাণ এলাকায় নতুন করে গাছ লাগানো হবে। তবে এটাও ঠিক,
সেখানে ঘন জঙ্গল তৈরি হতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
কিন্তু
জঙ্গলভূমি ধ্বংস করে কয়লাখনি তৈরি বিরুদ্ধে আদিবাসীরা তাদের বিরোধিতায় অনড়। আর তাই
বীরভূমের জোড়া কয়লা প্রকল্পের শুরুতেই জট। এবার সরাসরি রাস্তায় নেমে দেওচা-পাচামি
কয়লা প্রকল্প ও খয়রাশোলে গঙ্গারামচক খোলামুখ কয়লা খনি ঘিরে আন্দোলনে নামল
আদিবাসীরা। জঙ্গল কেটে এবং আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কয়লা শিল্প করা যাবে না দাবি
জানিয়ে বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে সামিল
হলেন তারা।
দিন চারেক
আগে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন বীরভূমের দেওচা-পাচামি কয়লা শিল্প সংক্রান্ত ফাইল
কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে হস্তান্তর করেছে। তাঁর ঘোষণার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু
হয় বীরভূমে। লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের আশায় শিল্পকে স্বাগত জানায় যুব সমাজ। যদিও
পাথর খাদান ও ক্রাশার মালিকরা ছাড়াও এলাকার আদিবাসীরা এই ঘোষণায় আশঙ্কাই দেখছে
বেশি।
আদিবাসীরা যে
শুধু মুখে স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার কথা বলেছেন এমনটা নয়। তাদের দাবিতে আগামী দিনেও
যে অনড় থাকবেন তা বুঝিয়ে দিয়েছেন গত সোমবার (২২/০৭/২০১৯)। এ দিন একযোগে বীরভূমের
তিনটি জায়গায় জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। মহম্মদবাজারের জয়পুরে, সিউড়ির
আব্দারপুর, ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন আদিবাসী সংগঠন
বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা। একই সঙ্গে রামপুরহাটের বড়পাহাড়িতেও রামপুরহাট-দুমকা রাস্তা
অবরোধ করা হয়।
খয়রাশোল
ব্লকে গঙ্গারামচক মৌজায় পিডিসিএল খোলামুখ কয়লা খনির জন্য ১০১ একর বনভূমি কাটার
কাজ শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত খনি এলাকার বাস্তবপুর, সগরভাঙ্গা, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া, গঙ্গারামচক,
দেবগঞ্জ এলাকার আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই এই নিয়ে একজোট হতে শুরু
করেছেন। আদিবাসীদের অভিযোগ, বনভূমি কেটে নিলে তাঁদের রুজিতে
টান পড়বে। কারণ, জঙ্গল থেকে কাঠ, মধু, কেন্দুপাতা, শালপাতা, সংগ্রহ
করে জীবিকা নির্বাহ করে আদিবাসী সমাজ। এলাকার বাসিন্দা বুধন হেমব্রম, রবি টুডুদের বক্তব্য, “জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লা খাদান
হলে আমাদের উচ্ছেদ হতে হবে। যদি তা নাও হয় তবে খাদানে বিস্ফোরণ হলে আমাদের মাটির
বাড়ি ভেঙে পড়বে।” যদিও বন দপ্তরকে পিডিসিএল আশ্বাস দিয়েছে ওই পরিমাণ এলাকায়
বনসৃজন করবে তারা।
স্থানীয়
আদিবাসী সংগঠন “বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা”-র সম্পাদক রবীন সরেন বলেন, “খয়রাশোলের
গঙ্গারামচকে জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লা খাদান করা হচ্ছে। কয়লা শিল্প হলে সেখানেও কেটে
ফেলা হবে প্রচুর জঙ্গল। প্রায় তিরিশটি আদিবাসী গ্রামকে উচ্ছেদ করা হবে। ফলে কয়লা
শিল্প হোক তা আমরা চাই না।” বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার আন্দোলনে দেওচা-পাচামি কয়লা
শিল্প ঘোষনার পর বড় আঘাত এল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার
নেতাদের বক্তব্য, “আমরা শিল্পের বিপক্ষে নয়। কিন্তু আদিবাসী
স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে হবে সরকারকে। কয়লা শিল্প নিয়ে এখনও মানুষ কিছুই জানে না।
তাদের কাছে সমস্ত বিষয় স্পষ্ট করতে হবে।” যদিও এই প্রসঙ্গে জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা
বসু বলেন, “জেলার যে কোনও উন্নয়নের কাজে আদিবাসীদের যাতে
কোনও অসুবিধা না হয় আমরা তা খতিয়ে দেখব।”
সংবাদ সৌজন্য
– আনন্দবাজার পত্রিকা (১৮/০৭/২০১৯) ও এইসময় (২৩/০৭/২০১৯)।
Porun sobai
ReplyDelete