বাড়ি থেকে
ঝগড়া করে পালিয়ে এসেছিল ১৫ বছরের কিশোরী মনীষা (নাম পরিবর্তিত)। এই ভুলের চরম
মাসুল দিতে হল মেয়েটিকে। নিজের অজান্তেই চারটি যৌন পল্লীতে বিক্রি হয়ে যায়।
বাড়ি থেকে
পালিয়ে শিয়ালদহ রেল স্টেশনে এসে মনীষা যখন এদিক-সেদিক ঘুরছে, তখন
পাপ্পু নামে এক ব্যক্তি মনীষাকে চাকরির টোপ দেয়। বলে রাজস্থানের ঝুনঝুনুতে ‘ভালো কাজ’ আছে। গরিব পরিবারের মেয়েটি আপত্তি করেনি।
সে পাপ্পুকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে সেখানে চলে যায়। গিয়েই বুঝতে পারে ‘ভালো কাজ’ মানে দেহব্যবসা। মনীষাকে পাপ্পু একটি
যৌনপল্লিতে বিক্রি করে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি মনীষার। ফের
তাকে বিক্রি করা হয়। এ বার এলাহাবাদে। সেখানে দিন কয়েক থাকার পর দিল্লির ‘সোনাগাছি’ জি বি রোডে। সেখানে সপ্তাহ দুই কাটিয়ে এ
বার ঠাঁই হয় এলাহাবাদের এক যৌনপল্লিতে। জি বি রোড থেকেও মনীষাকে বিক্রি করে দেওয়া
হয়। অবশেষে ফের হাতবদল হয়ে তার ‘ঠাই’ হয়
শিলচরের এক যৌনপল্লি।
পশ্চিমবঙ্গ
থেকে রাজস্থান,
সেখান থেকে এলাহাবাদ (প্রয়াগ রাজ), তার পরে
দিল্লি, ফের এলাহাবাদ হয়ে শিলচর, ক্লাস নাইনে পড়া ১৫ বছরের
মেয়েটার জীবনের গত দুই মাস এই ভাবেই যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। একের পর এক হাতবদল
হয়েছে। প্রত্যেক বারই সে যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়ে গেছে। অতঃপর
স্বাধীনতার স্বাদ এল গত ২৬শে জুলাই, যেদিন উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশ ও
অসম পুলিশের যৌথ অভিযানে ক্লাস নাইনের মেয়েটা উদ্ধার হল।
১৫ বছরের
কিশোরী মনীষা এত জায়গায় বিক্রি হয়ে যাওয়ায় তাকে খুঁজে পেতে পুলিশকে প্রচুর কাঠখড়
পোড়াতে হয়। সূত্র ছিল,
একটি মাত্র মোবাইল নম্বর। মনীষা মে মাসের ২৩ তারিখে বাড়ি থেকে রাগ
করে বেরিয়ে যায়। তার পর বহু জায়গায় তার খোঁজ করে পরিবার। কিন্তু কোথাও মেয়েকে
পাওয়া যায়নি। স্থানীয় থানায় এফআইআর দায়ের করে তারা। তবে প্রথম যাত্রায় পুলিশও কিছু
করতে পারেনি। অবশেষে সূত্র মেলে। ১৮ জুন নাগাদ মনীষা অন্য কারও মোবাইল থেকে লুকিয়ে
ফোন করে বাড়িতে, বাঁচানোর জন্য করুণ আর্তি জানাতে থাকে। সক্রিয় হয়ে ওঠে উত্তর ২৪
পরগনা পুলিশ ও মধ্যমগ্রামের এনজিও ‘সৃষ্টির পথে।’ তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করে
জানা যায়, সেটি দিল্লির জি বি রোডের কোনও একটি অঞ্চল।
গ্রাহকের নাম ও ঠিকানাও সেখান থেকে বের করে তারা। জানা যায়, ফোনটি
নেহা নামে কারও এক জনের। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঠিকানাটা ভুয়ো। এবং দিন
কয়েকের মধ্যে মোবাইলটি অফ করে দেওয়া হয়। যদিও তাতেও হাল ছাড়েনি পুলিশ। তারা এ বার
আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে ফোনের অবস্থানে নজরদারি চালাতে থেকে। ইতিমধ্যে চলতি মাসের
১৩ তারিখ দিল্লির জি বি রোডে হানা দেয় দিল্লি পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা
শক্তিবাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু মনীষাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। তার দু’দিন পরে ১৫ তারিখ বাংলা পুলিশ জানতে পারে ওই মোবাইলে নয়া সিম ভরে ব্যবহার
করছেন দিল্লির সাগরপুর এলাকার শান্তি বলে কেউ এক জন। বাংলা ও দিল্লি পুলিশ এবং
শক্তিবাহিনী গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি জানান, জি বি
রোডের কোঠা নম্বর ৫৬-র বাসিন্দা নেহা ওরফে রাধিকার থেকে তিনি ফোনটি কিনেছেন। তিনি
আর কিছু জানেন না। ফলত, পরের দিন সেখানে হানা দেয় পুলিশ। এবং
নেহাকে গ্রেপ্তার করে। শান্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নেহা জেরায় জানায়, মনীষাকে সে এলাহাবাদে বিক্রি করে দিয়েছে। পুলিশ চাইলে নেহাকে উদ্ধারে সে
সহায়তা করবে।
এর পরের
গন্তব্য ছিল এলাহাবাদে মৈলি তামাংয়ের বাড়ি। পুলিশকে মৈলি জানায়, মনীষাকে
সে শিলচরে বিক্রি করে দিয়েছে। বাংলা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এর দিন কয়েক পর ২৬
তারিখ এই ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ অফিসার তাঁর টিম নিয়ে শিলচরে যান। সেখানে অসম
পুলিশের সহায়তায় মেয়েটিকে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয়
যৌনপল্লির অন্যতম মালকিন স্বপ্না দাসকে। তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, তাঁরা মনীষাকে নিয়ে ৩০ তারিখ ফিরবেন। ফিরে এসে মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা
হবে ও সিডব্লিউসি-র সামনে পেশ করা হবে।
এই ঘটনা
প্রসঙ্গে দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শক্তিবাহিনীর সদস্য ঋষিকান্ত বলেন, ‘পাচার
যে কী সুসংহত ভাবে হচ্ছে, এটা তার প্রমাণ। পশ্চিমবঙ্গ
সরকারকে অনুরোধ করব, পাচারকারীরা যেন কোনও মতেই জামিন না পায়,
তাতে তদন্তে সমস্যা হয়। রাজ্য পুলিশ এ ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করেছে।’
মনীষা এখনও
মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। তবে তার মধ্যেও সে জানিয়েছে, ফিরে এসেই ফের স্কুলে
যেতে চায় সে। সেটাই তাকে আলো দেখাবে।
সংবাদ সৌজন্য
– এইসময়, অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৯/০৭/২০১৯।
No comments:
Post a Comment