কয়লাখনির জন্য জঙ্গল ধ্বংসের
বিরুদ্ধে বিশাল জমায়েত করে বিডিওকে স্মারকলিপি আদিবাসীদের।
বীরভূম জেলার খয়রাশোলে
কয়লাভূমির জন্য নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে বনভূমি বলে অভিযোগ আদিবাসীদের। তাই জমি-জঙ্গলের
অধিকার সুরক্ষিত করতে এলাকার আদিবাসী সমাজ গড়ে তুলেছে ‘বির বানচাও কমিটি’। যার অর্থ
জঙ্গল রক্ষা কমিটি। এই ডাক দিয়েই বৃহত্তর আন্দোলনে নামলেন বীরভূম-ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী
দশটি গ্রামের আদিবাসীরা। গত বৃহস্পতিবার ২৫/০৭/২০১৯ এই সব গ্রামের মহিলারা স্থানীয়
বিডিও অফিসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান। নিজেদের দাবি জানিয়ে ডেপুটেশনও দেন। এতে কাজ না
হলে আগামিদিনে সারা জেলার আদিবাসীরা জেলাশাসকের অফিস দখল করবে বলেও হুমকি দিলেন আদিবাসী
নেতারা।
কয়েক বছর আগেই খোলামুখ
কয়লা খনি করার ছাড়পত্র মিলেছে বীরভূম জেলার খয়রাশোলের গঙ্গারামপুরচক মৌজায়। ঝাড়খণ্ড
ঘেঁষা ওই এলাকায় খনি তৈরির জন্য জঙ্গল কাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই খবর কানে পৌঁছতেই
জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার হারানোর আশঙ্কায় দিশেহারা খয়রাশোলের গঙ্গারামপুরচক, বাস্তবপুর,
সগরভাঙা, গাংপুর, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া, দেবগঞ্জের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের বাসিন্দারা।
কয়লাখনির জন্য এলাকার
প্রায় সাড়ে সাতশো বিঘারও বেশি ঘন বনভূমি চিহ্নিত হয়েছে। শুরু হয়েছে বনভূমি সাফাইয়ের
কাজও। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আদিবাসীরা। তাই এককাট্টা হয়েছেন খয়রাশোলের গঙ্গারামপুরচক,
বাস্তবপুর, সগরভাঙা, গাংপুর, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া, দেবগঞ্জের মানুষ। ইতিমধ্যেই ‘বির বানচাও
কমিটি’ গড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কমিটির নেতা বাবুরাম পাউরিয়া বলেন, ‘বনভূমি কেটে ফেলায়
আমাদের জীবন-জীবিকায় টান পড়বে। এই জঙ্গল থেকে আমরা জ্বালানি কাঠ, শালপাতা, কেন্দু
পাতা, মধু, জাম, খেজুর, পিয়াল, মহুয়া সংগ্রহ করি। দৈনন্দিন জীবনে এর কোনওটা আমাদের
পেট ভরায়। আবার কোনও কোনও জিনিস বিক্রি করে আমাদের চাল-ডাল জোটে। জঙ্গল কেটে কয়লা
খনি হলে না খেয়ে মরতে হবে।’
স্থানীয় আদিবাসী সংগঠন
‘বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা’-র নেতা সুনীল সোরেন বলেন, ‘অরণ্যের উপর নির্ভরশীল আদিবাসীরা
কয়লাখনির নামে অবিচারে ব্যাপক হারে সবুজ ধ্বংসের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন। ‘বনাধিকার
আইন ২০০৬’-কে মান্যতা না দিয়ে এবং গ্রামসভা ছাড়াই কী ভাবে ১০১ একর প্রাকৃতিক অরণ্যকে
ধংস করে আদিবাসীদের জীবন জীবিকা বিপন্ন করার মতো গুরুতর ও মারাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করা হল, তার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন।’
খয়রাশোলের বিডিও সঞ্জয়
দাস বলেন, ‘যেখানে কয়লাখনি তৈরি হবে, সেই এলাকার বাসিন্দাদের যাতে কোনও অসুবিধা না
হয়, তা আমরা খতিয়ে দেখব। কয়লা খনির জন্য জঙ্গল নিয়ে সিদ্ধান্ত আমার নেওয়ার কথা নয়।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাকি দাবি গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখব।’
২০১৪ সালে কয়লার ব্লক-বণ্টন
বাতিল হওয়ার আগে খয়রাশোলের কৃষ্ণপুর-বড়জোড় ও গঙ্গারামচক মৌজার মাটির নীচে কয়লা উত্তোলনের
বরাত পায় ‘এমটা’। সেই কয়লা বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল
ওই সংস্থার। ২০১১ সালের পর থেকে কৃষ্ণপুর-বড়জোড় অঞ্চল এবং তার পরে গঙ্গরামচকে কিছু
অংশে খোলামুখ খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন শুরু করেছিল তারা। কিন্তু ২০১৪ সালে সারা দেশে
২০৪টি কোল-ব্লক বাতিলের তালিকায় ছিল খয়রাশোলের দুটি ব্লক-ও।
কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৫
সালে নয়া কয়লা ব্লক বণ্টন আইন প্রনয়ণ করে দেশের বহু কয়লা ব্লক বণ্টন করে। সেই সময়
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল) রাজ্যে পাঁচটি কোল ব্লক থেকে কয়লা
উত্তোলনের অনুমতি পায়। সেই পাঁচটির মধ্যে দু’টি ব্লক রয়েছে খয়রাশোলের বড়জোড় ও গঙ্গারামচক
মৌজার। কোল ব্লক থেকে কয়লা তোলার অনুমতি পেলেও পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয়
অনুমোদন না মেলায়, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে কয়লা উত্তোলনের কোনও উদ্যোগ
নিতে পারেনি পিডিসিএল। তবে এর মধ্যে প্রয়োজনীয় এনওসি নিয়ে ২০১৭ সালের শেষ দিকে খয়রাশোলের
কৃষ্ণপুর-বড়জোড় মৌজা থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্ততি শুরু হয়ে যায়। তবে জটিলতা থেকে
যায় গঙ্গারামচক মৌজা নিয়ে। কারণ এই মৌজার একটি বড় অংশে রয়েছে বিশাল জঙ্গল। প্রায়
সাড়ে সাতশো বিঘারও বেশি ঘন বনভূমি চিহ্নিত হয়েছে ওই এলাকায়। ফলে প্রথমে বাদ সাধে বন
দপ্তর।
বন দপ্তর জানিয়ে দেয়,
যে পরিমাণ বনভূমি নষ্ট হচ্ছে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার সমপরিমাণ জমি দিতে হবে। শুধু তাই
নয়, সেখানে গাছ লাগানোর যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে পিডিসিএলকে। এর জন্য বন দপ্তরের
‘কমপেনসেটারি অ্যাফরেস্টেশন ফান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং অথরিটি’ কর্মসূচির
বিস্তারিত নিয়ম জানিয়ে দেওয়া হয়। গত কয়েক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ নিগম ওই স্কিমের আওতায়
উত্তরবঙ্গের বৈকণ্ঠপুরে সমপরিমাণ এলাকা ‘কপমেনসেট’ করেছে বন দপ্তরকে। সেখানে গাছ লাগানোর
খরচও দিয়েছে তারা। কিন্ত বীরভূমের ওই অঞ্চলের ১০১ হেক্টর বনভূমি শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
বিকল্প হিসাবে খরাপ্রবণ এই জেলার খয়রাশোল ব্লকে নতুন করে সমপরিমাণ বনভূমি গড়ে ওঠার
বিষয়ে বীরভূমের এডিএফও বিজন কুমার নাথ বলেন, ‘যে অঞ্চলে কয়লাখনি করার জন্য বনভূমি
নষ্ট করা হচ্ছে, সেখানে নিয়ম মেনে সমপরিমাণ জমি এবং তাতে বন সৃজনের খরচ দিয়েছে পিডিসিএল।
তবেই বন দপ্তর অনুমতি দিয়েছে।’
তবে আদিবাসীরা পরিষ্কার
ভাবেই জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লাখনি তৈরির বিরুদ্ধে তাদের অনড় মনোভাবের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
তাদের সাফ কথা, জঙ্গল ধ্বংস করে কয়লাখনি নয়। সেটা করতে হলে তাঁদের জীবন জীবিকা সুরক্ষিত
রেখেই করতে হবে। এই জোড়া শর্ত সামনে রেখেই গত বৃহস্পতিবার ২৫/০৭/২০১৯ বিশাল জমায়েত
করে খয়রাশোলের বিডিওকে স্মারকলিপি দিল আদিবাসীদের দুটি সংগঠন, বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা
ও বীর বানচাও কমিটি। বৃহস্পতিবার ওই জঙ্গল কাটা বন্ধ করার আর্জি নিয়ে খয়রাশোলে বিশাল
জমায়েত বুঝিয়ে দিল আলোচনা না করে কাজ হাত দিলে সমস্যা রয়েছে।
এ দিন খয়রাশোলের গোষ্টমেলার
মাঠে আদিবাসীদের জমায়েত হবে বলে আগাম খবর ছিল স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। সেই জন্য প্রস্তুত
ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। খয়রাশোলের ব্লক ও জেলার অন্য প্রান্ত থেকেও সংগঠনের সদস্যরা
এসেছিলেন। বেলা ২টো নাগাদ মিছিল করে বিডিও অফিসে গিয়ে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। নেতৃত্বে
ছিলেন বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার নেতা সুনীল সরেন। তবে খনির জন্য জঙ্গল ধ্বংস ছাড়াও,
জীবিকা সুরক্ষিত রাখা, এলাকায় পানীয় জলের সঙ্কট, রাস্তাঘাটের উন্নতি, জাহের থান সংস্কার
সহ আদিবাসীদের সঙ্গে বঞ্চনার নানা অভিযোগ তুলে ধরেন আদিবাসীরা।
আদিবাসীদের অভিযোগ, ব্যক্তিগত
জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে না বলে পিডিসিএল বেমালুম প্রস্তাবিত কয়লাখিনি ঘেঁষে থাকা লোকজনের
কথা ভুলে যাচ্ছে। সেটা হতে দেব না। সুনীল সরেন বলেন, ‘প্রস্তাবিত খনি এলাকা সংলগ্ন
বাস্তবপুর, সগড়ভাঙ্গা, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া গঙ্গারামচক, দেবগঞ্জ এলাকার আদিবাসীদের বসতে
এখনই হাত পড়বে না, কিন্তু যে ভাবে জঙ্গল কেটে কয়লাখনি তৈরির কাজ চলছে, তাতে ঘুরিয়ে
তাঁদের উচ্ছেদের পরিকল্পনাই করা হয়েছে। কারণ জঙ্গল না থাকলে জীবিকা কী ভাবে হবে। দু’দিন বাদে খনিতে বিস্ফোরণে
ঘর ফেটে গেলে উচ্ছেদ হতে হবে। তাই আলোচনার ভিত্তিতে সহমতে না আসা পর্যন্ত জঙ্গল কটা
চলবে না।’
প্রশাসন সূত্রে খবর, অশান্তির
ভয়ে আপাতত গাছ কাটা বন্ধ রেখেছে পিডিসিএল।
সংবাদ সৌজন্য
- এই সময়
ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬/০৭/২০১৯।
No comments:
Post a Comment