স্ত্রীর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে সৎকারের
জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে ৪ দিন লাগল আদিম আদিবাসী শবর যুবকের।
কাঁধে স্ত্রীর দেহ নিয়ে ১২ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন উড়িষ্যার দানা মাঝি। সেই ছবি সংবাদ
মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল৷ কিন্তু গরিব আদিবাসীদের জন্য যে
ছবিটা পাল্টায়নি, তার প্রমাণ মিলল এই বাংলাতেই৷ গাড়ি ভাড়া করার টাকা নেই বলে বেলপাহাড়ির
আদিম আদিবাসী শবর জাতির এক যুবক তাঁর স্ত্রীর দেহ চার দিন ফেলে রাখতে বাধ্য হলেন হাসপাতালের
মর্গে৷ কোন সরকারী আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধির সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত
এক আদিবাসী প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ১,৮০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে দেওয়ায় ঝাড়গ্রামের
সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর দেহ নিয়ে বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত ধোবাকচা গ্রামে
পৌঁছলেন আদিম আদিবাসী কানাই শবর৷ রাজ্য সরকারের সমব্যাথী প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এই
ঘটনায় প্রশাসনিক গাফিলতিই সামনে এল৷
লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি খগেন্দ্রনাথ মান্ডি আক্ষেপ করে বলেন,
‘আমি হাসপাতালে গিয়ে সুপারকে বলেছিলাম, একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিন, যাতে আদিম আদিবাসী
কানাই শবর স্ত্রীর দেহ বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন৷ সুপার বলেছিলেন, দেহ পাঠানোর কোনও সরকারি
ব্যবস্থা নেই৷ সেখানে তখন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও দীপক সরকারও ছিলেন৷ তাঁকেও বললাম৷ কিন্তু
গরিবের কথা কে শোনে? আমি সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। সংগঠনের সদস্যরা এই ঘটনায় কেউ জড়াতে চাননি।
কানাই যাতে স্ত্রীর দেহ নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন সে জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে
বলেছিলাম ’
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা থেকে পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক, সকলের মন্তব্যেই স্পষ্ট,
গরিব বলেই কেউ কানাই শবরের কথায় কান দেননি৷ বেলপাহাড়ির তৃণমূল বিধায়ক খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম
বলেন, ‘আমি ঝাড়গ্রামের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বলেছিলাম৷ উনি বলেছিলেন, ঝাড়গ্রাম
হাসপাতালে বলে দেবেন?’ সুপার মলয়কুমার আদক ফোন না ধরায় তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি৷
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অশ্বিনীকুমার মাঝির সাফাই, ‘এমএলএ বলায় আমি হাসপাতাল
সুপারকে জানিয়েছিলাম৷ উনি বললেন, ‘মৃতের পরিবার গাড়ি ভাড়া করলে আমরা টাকা দিয়ে দেব৷
আমরা কোথায় গাড়ি খুঁজবো?’ তার পর আর খোঁজ নিইনি৷’
শিমূলপালের পঞ্চায়েত প্রধান লীলাবতী হাঁসদা বলেন, ‘ভোটের জন্য এখন অনেক সমস্যা৷
আমার কাছে ওঁরা আসেননি৷’ কানাই শবর কিন্তু বলেন, ‘আমার পরিবার প্রধানের কাছে গিয়েছিল৷
দেহ আনতে উনি কোনও সাহায্য করেননি৷’
কানাই শবরের মুশকিল আসান যিনি করলেন, সেই শ্রীকান্ত মুর্মু কিন্তু তাঁর আত্মীয়ও
নন, সরকারি কর্তাও নন৷ ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা একজন শিক্ষক মাত্র৷ শ্রীকান্ত বলেন,
‘ওদলচুয়ার এক শিক্ষকের কাছে ঘটনাটি শুনে আজ হাসপাতালে এসে গাড়ি ভাড়া করে দিই৷’
ওদলচুলা থেকে ঝাড়গ্রাম এর দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার৷ সেখানে খবর পৌঁছতে পারে৷ ঝাড়গ্রামের
সরকারি কর্তাদের কানে খবর পৌঁছয়নি৷
বেলপাহাড়ির ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক উত্তম মান্ডি কিন্তু ঘটনাটি জানেনই না৷ তিনি
বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখব৷’
বেলপাহাড়ির শিমূলপাল পঞ্চায়েতের ধবাকাচার বাসিন্দা কানাই শবরের তরুণী স্ত্রী সুজিতা
শবর (১৯) বাড়িতে রান্না করার সময় গত ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ অগ্নিদগ্ধ হন। খাটিয়ায় চাপিয়ে
কাঁধে করেই সুজিতাকে ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেই অ্যাম্বুল্যান্সে সুজিতাকে আনা হয় ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার
স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। তাঁর স্বামী কানাই দিনমজুর। যৎসামান্য রোজগার। দু’বেলা খাবারের সংস্থান করতেই টাকা ফুরিয়ে যায় তাঁর।
ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত ২ মে সকালে সুজিতার মৃত্যু
হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে পুলিশ। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পরে দেহ ঝাড়গ্রাম
জেলা পুলিশ মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। স্ত্রীর মৃতদেহ পেতে এর পর হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে
ঘুরতে থাকেন কানাই। তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে তাঁকে বলা হয়েছিল, মর্গের বিষয়টি প্রশাসন
দেখে। শবর সংগঠনের নেতাদের দ্বারস্থ হন কানাই। কিন্তু আগুনে পোড়া ঘটনায় জড়াতে চাননি
কেউই। পুলিশ জানিয়ে দেয়, বেলপাহাড়ির কদলবনি গ্রাম থেকে সুজিতার বাপের বাড়ির তরফে কেউ
এলে মৃতদেহ ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো টাকাও ছিল না কানাইয়ের কাছে।
শেষে খবর পেয়ে শুক্রবার সুজাতার দাদা বাবুলাল শবর লিখিত আবেদন করায় কানাই দেহ পেয়ে
যান।
কিন্তু দেহ নিয়ে যাবেন কী ভাবে? টাকা নেই তো! তাই হাসপাতাল চত্বরেই পড়েছিল দেহ।
অবশেষে বেলপাহাড়ির লালজল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীকান্ত মুর্মু বিষয়টি জানতে
পেরে রবিবার এগিয়ে আসেন। আরও কয়েক জন সহৃদয় ঝাড়গ্রাম শহরবাসীর উদ্যোগে গাড়ি ভাড়া করে
দেওয়া হয়। স্ত্রীর দেহ নিয়ে ফিরে যান কানাই। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা গরিব মানুষ। কী ভাবে
দেহ পেতে হয়, সেটা জানতেই তিন দিন লাগল।”
আদিম আদিবাসী শবরদের জন্য সরকারি স্তরে নানা ধরনের সহযোগিতার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে
‘সমব্যথী’প্রকল্প। তা হলে? ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক
(সাধারণ) নকুলচন্দ্র মাহাতো বলেন, “ কেউ ওই ঘটনার কথা আমাকে জানাননি। পরিবারটিকে সাহায্যের
ব্যবস্থা করা হবে।” বেলপাহাড়ির বিডিও সন্তু তরফদারের বক্তব্য, “ওই মহিলার পারলৌকিক
কাজের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে।”
সৌজন্য – এই সময় ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৭ ই মে ২০১৮।
No comments:
Post a Comment