জঙ্গলমহলের পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূলের সাথে টক্কর নিয়ে ভোট করাল বিজেপি ও
আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ।
শুধু কয়েকটা পতাকা লাগিয়ে বা দেওয়াল লিখে নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে কার্যত
ময়দানে নেমে শাসকদলের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করল বিজেপি৷ পাশাপাশি জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ
এলাকায় শাসক তৃণমূলকে কোণঠাসা করে দিয়ে দাপটে ভোট করে গেল আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চও৷ বিজেপিকে
নির্বাচনের দিন জঙ্গলমহলে খুঁজেই পাওয়া যাবে না বলে দাবি করেছিল শাসকদল৷ আর এ দিন তৃণমূলের
প্রার্থী তথা জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরা এ দিন বিজেপির বিরুদ্ধে
তাঁকে হেনস্থা করার অভিযোগ তুললেন৷ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য
করেছেন, ‘জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সমর্থনে বিজেপি কিছু জায়গায় দাপাদাপি করেছে৷ তবে ফলাফলে
এর প্রভাব পড়বে না৷’
বেলপাহাড়ির আমলাশোল, কাঁকড়াঝোরে ভোটের দিন তৃণমূলের টিকিও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ শাসকদলের
বুথ এজেন্ট তো দূরের কথা, কোনও লোকজনকেই দেখা যায়নি৷ আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতারাই
কার্যত ভোট করান ওই এলাকায়৷ ঝাড়খণ্ড সীমানায় বেলপাহাড়ির পাহাড় ঘেরা প্রত্যন্ত এলাকায়
ভোটারদের লম্বা লাইন ছিল সকাল থেকে৷ আদিবাসী মঞ্চের নেতারা দূরে গাছের তলায় ত্রিপল
বিছিয়ে বুথ স্লিপ দেওয়া থেকে শুরু করে ভোটারদের মুড়ি-ছোলা-চানাচুর হাতে হাতে ধরিয়ে
দেন৷ ধোবাকাচায় তৃণমূলের ক্যাম্প থাকলেও, সেখানে প্রার্থী ছাড়া মাত্র দু’জন বসেছিলেন৷ উল্টোদিকে, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের ক্যাম্পে ভিড়
থিকথিক করছে৷
ধোবাকাচার তৃণমূল প্রার্থী পরেশচন্দ্র হেমব্রমের অভিযোগ, ‘ওরা সমাজের নাম করে ভোটারদের
ভয় দেখাচ্ছে৷ মাওবাদী-জনসাধারণ কমিটির যে সব নেতা জামিনে মুক্ত, তারাই এখন সমাজের লিডার৷’
আবার বুড়িঝোরে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল প্রার্থী জলেশ্বর সিং এতটাই আত্মবিশ্বাসী,
যে সাফ বলছেন, ‘জিতব তো অবশ্যই, আমি সমাজের পক্ষ থেকে প্রধানও হব৷ তৃণমূলের নেতারা
মানুষের জন্য কিছু করেনি, নিজেরা সব খেয়েছে৷’ কাঁকড়াঝোরের আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতা
ধর্মাল মান্ডি বলেন, ‘কোথাও দশ টাকা, আবার কোথাও সাদা কাগজ আমরা ঢুকিয়ে দিয়েছি বাক্সের
মধ্যে৷ গণনার দিন বাক্স খোলার সময়ে যদি ওই টাকা বা সাদা কাগজ না পাওয়া যায় তা হলে বুঝব
ভোটের বাক্স বদল করেছে৷’
বেলপাহাড়ির ভুলাভেদার কেচন্দা বুথে ব্যালট বাক্স ছুড়ে তৃণমূলের এজেন্ট চিরঞ্জীব
দত্তের মাথা ফাটানোর অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে৷ মেদিনীপুর সদর, শালবনি এবং গড়বেতা
২-এর মতো একদা মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের ব্লকে লড়াই করতে দেখা গেল বিজেপিকে৷ মুখ
টিপে শালবনির এক তৃণমূল নেতা মানছেন, ‘শাল-পিয়ালের জঙ্গলে পদ্ম ফুটে যাবে মনে হচ্ছে!’
শালবনি ব্লকের পিড়াকাটায় ঢোকার আগে ভাদুতলা-লালগড় রাজ্য সড়কের মাঝ বরাবর রাস্তায়
বিজেপি কর্মী, সমর্থকরা পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছে৷ পিড়াকাটা হাইস্কুলে তৃণমূল নেতা কর্মীদের
জমায়েত করা নিয়ে সরব হয় বিজেপি কর্মী, সমর্থকরা৷ জয়পুরের দিকে কিছুটা এগোতেই শাসকদলের
পাশাপাশি সমান বুথ ক্যাম্প চোখে পড়ল বিজেপির৷ গড়বেতা-২ ব্লক বা গোয়ালতোড়েও চোখে পড়েছে
বিজেপি কর্মী, সমর্থকদের বুথ পাহারা৷ তিনটি ব্লকের পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে সিংহভাগ
আসনেই প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি৷ গোয়ালতোড় লাগোয়া গড়বেতা ৩ ব্লকের সেকাশোলে বিজেপি কর্মীদের
বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ করেছেন বিদায়ী সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরা৷
গোটা গোয়ালতোড় জুড়ে শাসকদলের সঙ্গে রীতিমতো টেক্কা দিয়ে পোস্টার, দেওয়াল লিখন করেছে
বিজেপি৷ ভোটের আগে পরে তৃণমূল বুথ ক্যাম্প থেকে ভোটারদের যেমন ছোলা-মুড়ি দেওয়া হয়েছে,
তেমনই বিজেপিও পাল্টা মুড়ি-পেঁয়াজি দিয়েছে৷ কপালে তিলক, গলায় গেরুয়া গামছা নিয়ে ঘুরে
বেড়িয়েছে বিজেপি কর্মীরা৷ নয়াগ্রাম ব্লকের বিভিন্ন বুথে সকালের দিকে বিজেপির বুথ এজেন্টদের
বসতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু বেলা গড়াতেই চিত্রটা একেবারে
পাল্টে যায়৷ কলমাপুকুরিয়া, ছোটঝরিয়া, খাসজঙ্গলের বুথগুলিতে বিজেপি বাইরের লোক এনে হামলা
চালায়৷ খাসজঙ্গল বুথের তৃণমূলের এজেন্ট জগদীশ মাহাতোকে বুথের মধ্যে ঢুকে অপহরণ করার
অভিযোগ উঠেছে৷ ছোটঝরিয়ায় তৃণমূলের এজেন্ট শশাঙ্ক বেরা বলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে এখানে
ভোট হচ্ছে, কোনও গন্ডগোল হয়নি৷ আজকে বিজেপি বাইরের লোক এনে হামলা চালাল৷’
ঝাড়গ্রামের আমলাচটি বুথে সাতসকালে লাইনে দাড়িয়ে ভোট দেন অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ
দফতরের মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতো৷ লালগড়, জামবনি, সাঁকরাইল, গোপীবল্লভপুর এলাকায় ভোট
উৎসবের মেজাজে হয়েছে৷ তৃণমূল-বিজেপি উভয় দলের পক্ষ থেকে মুড়ি-চানাচুর-চপ বিলি করা হয়েছে
ভোটারদের৷ গোপীবল্লভপুর-২ নম্বর ব্লকের কুলিয়ানা জুনিয়ার হাইস্কুলে ভোট দিতে আসার কথা
ছিল বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের৷ যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ভোট দিতে আসেননি৷ কুলিয়ানা
বুথে বিজেপির এজেন্ট তথা দিলীপ ঘোষের ভাই সুকেশ বলেন, ‘তৃণমূল গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টায়
ছিল৷ আমরা রটিয়ে দিয়েছিলাম দিলীপদা ভোট দিতে আসছে, ওরা আর গণ্ডগোল করতে সাহস করেনি৷’৷
সৌজন্য – এইসময়, সমীর মণ্ডল, অরূপকুমার পাল, ১৫ ই মে, ২০১৮।
No comments:
Post a Comment