বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লীতে আগুন এবং সেখান থেকে
তাদের উচ্ছেদের ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও পুনর্বাসন করা হয়নি সাঁওতালদের। বরং
পুনর্বাসনের নামে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রতারণার অভিযোগ। হাইকোর্টের
নির্দেশে জেলা প্রশাসন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের বেতারা গ্রামের
নদীতীরবর্তী খাস জমিতে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের
সিন্ধান্ত নেয়,
যা উচ্ছেদ হওয়া স্থান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে
সাঁওতালদের বসবাসের জন্য টিনের ঘর তৈরি করা হয়। গত বন্যায় ওই স্থানটি বসবাসের
অযোগ্য হয়ে পড়ে। বন্যাপরবর্তী সময়ে তা মেরামত করা হলেও সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত
সাঁওতালরা কেউই যাননি। তারপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে
পুনর্বাসন করা হয়েছে।
উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই হাজার সাঁওতাল পরিবার অন্যের জমিতে তাঁবু
টানিয়ে বসবাস করছেন। তাদের নেই কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অনাহার-অর্ধাহারে
মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। দীর্ঘদিন খোলা জায়গায় থেকে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সম্প্রতি লুকু হেমব্রম (৫০) নামে এক সাঁওতাল খেতে না পেয়ে ও অসুস্থ হয়ে মারা যান।
বেতারা গ্রামের নদীতীরবর্তী গুচ্ছগ্রামে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের
কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০টি পরিবারকে এখানে এনে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ জমি দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই গুচ্ছগ্রামে
বসবাসরত কয়েকটি পরিবার জানায়, তারা উচ্ছেদ হওয়া বা
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কেউ না। এমনকি সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার কমিটি
বা আন্দোলনকারীদের সঙ্গেও তাদের সংশ্নিষ্টতা নেই।
এ নিয়ে কথা হয় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর
রাফিউল আলমের সঙ্গে। তার দাবি-সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০টি পরিবারকে
পুনর্বাসন করা হয়েছে। আরও ৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু
গুচ্ছগ্রামে ঘুরে তার দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। সেখানে বসবাসকারী জিসায়েল হেমব্রম, কৃষ্ণা পাহাড়ি সহ কয়েকজন সাঁওতাল বলেন, তাদেরকে বিভিন্ন
এলাকা থেকে ডেকে এনে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের সবার অন্যত্র ঘরবাড়ি রয়েছে।
তাদের অভিযোগ, গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও শিলাব্রত কর্মকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, এখানে বসবাসরতরা উচ্ছেদ হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন এবং পুনর্বাসনের পর
সরকারের দেওয়া সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু শুধু ঘর ছাড়া তারা কিছুই পাননি।
সেখানে কয়েকটি মুসলিম পরিবারও রয়েছে বলে জানান তারা।
একই অভিযোগ সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা.
ফিলিমন বাস্কের। তিনি বলেন,
জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় প্রশাসন মিথ্যাচার করছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১৮ মাসেও পুনর্বাসন করা হয়নি। আড়াই হাজার সাঁওতাল পরিবার
খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের কোনো কর্মসংস্থান না থাকায়
অর্ধাহারে-অনাহারে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তাঁবু টানিয়ে থাকছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০
দিনের কর্মসূচিতে লোক নিলেও তাদেরকে কোনো কাজে নেওয়া হয় না।
তিনি অভিযোগ করেন,
বেতারা গুচ্ছগ্রামে যাদেরকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের
মধ্যে কয়েকজন হলেন, দক্ষিণ আনালেরতাড়ী খোলাহাটির দুলাল, বেতারার সুইটি সরেন,
একই এলাকার মান্নান সরকার, বেড়া বুজরুকের রমেশ টুডু, পালটন টুডু, ম্যানুয়াল কিসকু,
যোহন হেমব্রম ও কইন সরেন। তাদের প্রত্যেকেরই ঘরবাড়ি রয়েছে। সতীশ
কিসকু বলেন,
এখানে ৩০-৩২ জন পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে থাকে
মাত্র ৫-৭টি পরিবার। অন্যরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতেই থাকছে। তিনি আরও বলেন, এখানে থাকার কোনো পরিবেশ নেই। নদী থেকে বালু তুলে তার ওপর ঘর তৈরি করা হয়েছে।
একটু বৃষ্টিতেই ঘরের ভিটা ধসে যায়।
কইন সরেন নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, একটু বাতাসেই ঘর
নড়বড় করে। মনে হয় এই বুঝি ভেঙে গেল। গত দু'দিনের বৃষ্টিতে ঘরের পাশে
পানি জমে গেছে। এ অবস্থায় কেউ এখানে থাকতে রাজি হয় না।
সাঁওতালদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত ইউএনও আবদুর রাফিউল আলমের বক্তব্য,
'এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় বলতে পারবেন।'
ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্বে ছিলেন ইউএনও শিলাব্রত
কর্মকার। তিনি বলেন,
বেতারা গুচ্ছগ্রামে যাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদের
বেশিরভাগই সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল পরিবার। বেতারা
গুচ্ছগ্রামের বর্তমান চিত্র তুলে ধরলে তিনি বলেন, গুচ্ছগ্রামটি আসলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। যখন তারা সেখানে
থাকতে রাজি হয়নি,
তখন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভূমিহীন সাঁওতালদের এনে
পুনর্বাসন করা হয়েছে।
একই বক্তব্য গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পালের। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের জন্য আরও আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হবে।
মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত যারা এখনও পুনর্বাসনের বাইরে রয়েছে, তাদের এখানে আনা হবে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিরোধপূর্ণ জমিতে
পুলিশের উপস্থিতিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ কাটতে গেলে সাঁওতালদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন রমেশ টুডু, মঙ্গল মার্ডি এবং শ্যামল হেমব্রম নামে তিন সাঁওতাল। পরে অতিউৎসাহী পুলিশ
সদস্যরা সাঁওতালপল্লীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তে গোটা সাঁওতালপল্লী পুড়ে ছাই হয়ে
যায়। সেই থেকে খোলা আকাশের নিচে মানববেতর জীবন-যাপন করছে ভূমিপুত্ররা।
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল, আদিবাসী বার্তা।
No comments:
Post a Comment