জঙ্গল মহলে রাজ্যের শাসক দল তৃনমূল কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি
হিসেবে উত্থান হল আদিবাসী সমাজ সমর্থিত নতুন রাজনৈতিক শক্তি ‘আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ’।
সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আদিবাসী অধ্যুষিত একালাগুলিতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করল রাজ্যের
প্রধান বিরোধী দলের দাবিদার বিজেপি। এই বারের পঞ্চায়েত ভোটে একপ্রকার মুছেই গেল বাম
ও কংগ্রেস।
ভোটের দিনই ইঙ্গিত মিলেছিল৷ ফলাফল প্রকাশ হতে দেখা গেল জঙ্গলমহলে বাজিমাত করেছে
আদিবাসীদের সমন্বয় মঞ্চ৷ মঞ্চের সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা দখল করল দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত৷
বেলপাহাড়ি ব্লকের বাঁশপাহাড়ি ও শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করলেন মঞ্চের নির্দল প্রার্থীরা৷
আর একটুর জন্য মঞ্চের হাতছাড়া হয়ে বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে ভুলাভেদা গ্রাম পঞ্চায়েতটি৷
জঙ্গলমহলের এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই ক্ষমতায় ছিল শাসকদল তৃণমূল৷ আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের
বেলপাহাড়ি ব্লকের সভাপতি বাবলু মুর্মু বলেন, ‘মানুষ অনুন্নয়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে
রায় দিয়েছেন৷ আমরা রাজনীতি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে পঞ্চায়েতে মানুষের উন্নয়ন করব৷’
জঙ্গলমহলের সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, কোডা – র মতো সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলে গঠন
করেছেন আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ৷ এ বারের ভোটেই প্রথম উত্থান হয়ে এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন মঞ্চ৷ মঞ্চের প্রার্থীরা নির্দল
হিসেবে ভোটে লড়েন। তাতে ‘দোসর’ হিসেবে যোগ দেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা৷ তাঁদের অনেকেই
২০১৩ সালে তৃণমূলের হয়ে জিতেও এ বারে টিকিট পাননি৷ রাজ্য সরকারের ঢালাও উন্নয়ন কর্মসূচির
মধ্যেও আদিবাসীদের এই মুখ ফেরানো নিঃসন্দেহে চাপ বাড়াবে শাসকদলের উপর৷
যদিও ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, ‘আদিবাসীরা আলাদা হয়নি৷ ওদের
সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চলছে৷ ভোটের আগেও কথা হয়েছিল৷ আমরা ওই ব্লকে এই ফল আশা করেছিলাম৷’
বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী বলেন, ‘আদিবাসী মানুষের ক্ষোভ আছে৷ মানুষ
তাঁদের সমর্থন করেছে৷’
বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের মধ্যে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দলরা
পেয়েছে সাতটি, তৃণমূল দু’টি ও বিজেপি একটি আসন৷ শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের ১১টি আসনের
মধ্যে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দলরা পেয়েছে ৬টি, ৩টি বিজেপি, ২টিতে তৃণমূল জয়ী হয়েছে৷
বেলপাহাড়ি ব্লকের মোট ৩৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে জয়ী হয়েছে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল
প্রার্থীরা৷
কিন্তু জঙ্গলমহলে দু’টাকা কিলো চাল, আমার বাড়ি প্রকল্পে ঘরের মতো নানা কল্যাণমূলক
প্রকল্পের পরও প্রায় একই ছবি আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়াতেও৷ বলরামপুর, বরাবাজার, বাগমুন্ডি,
আড়শা - সবখানেই পঞ্চায়েতে খাতা খুলেছে বিজেপি৷ শিল্পাঞ্চল রঘুনাথপুরকে ঘিরে থাকা রঘুনাথপুর
১, রঘুনাথপুর ২, সাঁতুড়ি ব্লকেও ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল৷ পুরুলিয়া শহর লাগোয়া পুরুলিয়া
১ ও ২ নম্বর ব্লকে ও তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি৷ আদিবাসীদের বিভিন্ন গণসংগঠন
কাশীপুরের পাহাড়পুর ও রঘুনাথপুরের বেড়ো গ্রামে পাহাড় কেটে গ্রানাইট বের করার বিরুদ্ধে
সরব হয়েছিলেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পাহাড় কাটা বন্ধ হলেও রঘুনাথপুরের প্রকল্পটি
বন্ধ হয়নি৷ দু’টাকা কিলোর চাল পেলেও উৎপাদিত ফসলের বিপণনের ব্যবস্থা হয়নি৷ আদিবাসী
নেতারা বলছেন, এই জমানায় জেলার অধিকাংশ আদিবাসী ছাত্রাবাস বন্ধ, অলচিকি হরফে সাঁওতালি
ভাষার মাধ্যমে পঠনপাঠন হচ্ছে না৷ মুখ্যমন্ত্রীর কুড়মিদের আদিবাসী তালিকাভুক্ত করার
উদ্যোগও ভালো ভাবে নেননি আদিবাসীরা৷
বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘তৃণমূলের স্বজনপোষণ,
দুর্নীতি আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরেছি৷ তাই সন্ত্রাস করে কাশীপুরে জয়ী হলেও আশেপাশে
সর্বত্র হেরেছে ওরা৷’
তবে তৃণমূলের হারের একমাত্র কারণ হিসেবে দলের কিছু কর্মীর অন্তর্ঘাতকেই দায়ী করেছেন
জেলা তৃণমূল সভাপতি ও মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো৷ তিনি বলেন, ‘প্রার্থীদের কয়েকজন দাবিদার
বিরোধীদের সঙ্গে গোপনে আঁতাঁত করেছিল৷ অন্য কোনও কারণে দল হারেনি৷’
ঝাড়গ্রামে রাজ্যের মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতোর নিজের আমলাচটি বুথ সহ শালবনি গ্রাম
পঞ্চায়েতের ৮টি আসনে একটিতেও জিততে পারেনি তৃণমূল৷ জিতেছে বিজেপি৷ চূড়ামণি মাহাত বলেন,
‘মানুষ বেইমানি করলে কী করা যাবে ? বিজেপি প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় টাকা দিয়ে মানুষকে
ভুল বুঝিয়েছে৷’
ঝাড়গ্রামে বিজেপির এই ফল শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি তৃণমূলের জেলা সভাপতি
অজিত মাইতি৷ অজিত বলেন, ‘এতগুলো আসন বিজেপি পায়নি৷’ নির্বাচন কমিশনের রেজাল্ট বলতে
তিনি বলেন,‘আচ্ছা! কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে তা দেখতে হবে৷ আসলে ওরা (দলের নেতারা) রুট
ওয়ার্কটা করেনি৷’
ঋণ স্বীকার – এই সময়, ১৭ ই মে, ২০১৮।
No comments:
Post a Comment