Sunday, May 27, 2018

বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের প্রেরণা চাঁদনী সাঁওতাল ও তাঁর মা সুমি সাঁওতাল।


অদম্য ইচ্ছা থাকলে নিজের কর্ম আর প্রচেষ্টার জয় হয়-ই একদিন। আর এই জয়ী হওয়ার গল্পই পরে অন্য অনেকের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। এমনি অনুপ্রেরণার দুই নাম খাগড়াছড়ির চাঁদনী সাঁওতাল ও তার মা সুমি সাঁওতাল। মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়েকে শিক্ষিত করার। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অর্থের, সে বাধাকে আরও জোরালো করেছিল বাবার নিরুদ্দেশ হওয়া। তবে এত প্রতিকূলতাও দমাতে পারেনি মাকে। নিজে দিনমজুরি করে মেয়েকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর। আর মায়ের সাহস বুকে ধারণ করে আলোকিত হওয়ার পথে আরও এগিয়ে যাচ্ছেন একমাত্র মেয়ে চাঁদনী সাঁওতাল।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাঁওতালদের বসবাস মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায়। পাহাড়েও যে তাদের বসবাস আছে, সেটি হয়তো অনেকেরই অজানা। তাই পাহাড়ের সাঁওতালদের বঞ্চনার ইতিহাস অজানা থাকাটাও স্বাভাবিক। সেই বঞ্চনার প্রাচীর ভেঙেই প্রথম সরকারি চাকরি পান জেলার পানছড়ি উপজেলার চাঁদনী সাঁওতাল। দুই বছর বয়সে তার বাবা সুনীল সাঁওতাল নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সেই থেকে দাদার বাড়িতে মা সুমি সাঁওতালই তাকে মানুষ করেছেন। বর্তমানে তিনি পানছড়ির গোলক প্রতিমামুখ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের পাশাপাশি খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ইতিহাস অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।
১৯৯৫ সালে পানছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের সাঁওতালপাড়ায় চাঁদনীর জন্ম। নিজেদের বাড়ি-ভিটে কিছুই নেই। চাঁদনী বলেন, মানুষের বাড়ি-জমিতে কাজ করে মা-ই এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস জুগিয়েছেন।
২০০৩ সালে নন্দু চাকমা নামে এক শিক্ষকের সহযোগিতায় চাঁদনীর ঠাঁই হয় খাগড়াছড়ি জেলা শহরের সরকারি শিশু সদনে। এখান থেকেই একমাত্র সাঁওতাল শিক্ষার্থী হিসেবে ২০১১ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। এর আগে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলার সাঁওতালদের কোনো ছেলে বা মেয়ে এসএসসি পাস করতে পারেনি। সাঁওতালরা পদবিতে সাঁওতাল শব্দটি ব্যবহার করে না। তবে পাহাড়ে বসবাসরত চাঁদনীর মতো অনেকেই পদবি হিসেবে সাঁওতাল লিখছেন।
চাঁদনীর মা বলেন, একসময় অনেক জমিজমা ছিল। শিক্ষার অভাবে সব বেহাত-বেদখল হয়েছে। দু'বেলা ভাতের জন্য নিজেদের জমিতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। তাই জেদ ছিল, শত কষ্ট হলেও মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করব, যাতে সমাজে সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই আশা বুকে নিয়েই দূরপানে চেয়ে আছি।
চাঁদনী বলেন, বাড়িতে এসে মায়ের মুখটা দেখলে কেন জানি বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো। আমার জন্য মা এখনও দিনমজুরি করেন। এটা ভাবতে গেলেই জীবনটাকে অসহনীয় মনে হতে থাকে। তবে মেয়ের উদ্দেশে মায়ের একটাই কথা- 'তোমাকে শিক্ষার সর্বোচ্চ জায়গায় দেখতে চাই।' চাঁদনী বলেন, বুকে মায়ের সাহস নিয়ে এখনও এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি জানান, একটি প্রকল্পে কাজের সূত্রে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আবেদন করতে।
গত বছর থেকে গোলক প্রতিমামুখ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত চাঁদনী নিজের সম্প্রদায়ের শিশুদের ঝরে পড়া রোধ, স্কুলমুখী করাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছেন। চাঁদনী বলেন, 'জীবনে এতটুকু আসার পেছনে মায়ের পাশাপাশি নন্দু চাকমা স্যার, পানছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা, অগ্রজ মানিক সাঁওতাল এবং স্থানীয় শিক্ষক বিজয় কুমার দেবের অবদান স্মরণীয়।'
সৌজন্য - প্রদীপ চৌধুরী, http://samakal.com/

বাংলাদেশের গাইবান্ধা থেকে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারগুলি এখনও পুনর্বাসন পেল না।


বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লীতে আগুন এবং সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদের ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও পুনর্বাসন করা হয়নি সাঁওতালদের। বরং পুনর্বাসনের নামে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে প্রতারণার অভিযোগ। হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা প্রশাসন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের বেতারা গ্রামের নদীতীরবর্তী খাস জমিতে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মাধ্যমে ৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের সিন্ধান্ত নেয়, যা উচ্ছেদ হওয়া স্থান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে সাঁওতালদের বসবাসের জন্য টিনের ঘর তৈরি করা হয়। গত বন্যায় ওই স্থানটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বন্যাপরবর্তী সময়ে তা মেরামত করা হলেও সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরা কেউই যাননি। তারপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই হাজার সাঁওতাল পরিবার অন্যের জমিতে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করছেন। তাদের নেই কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অনাহার-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। দীর্ঘদিন খোলা জায়গায় থেকে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি লুকু হেমব্রম (৫০) নামে এক সাঁওতাল খেতে না পেয়ে ও অসুস্থ হয়ে মারা যান।
বেতারা গ্রামের নদীতীরবর্তী গুচ্ছগ্রামে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪০টি পরিবারকে এখানে এনে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ জমি দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত কয়েকটি পরিবার জানায়, তারা উচ্ছেদ হওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কেউ না। এমনকি সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার কমিটি বা আন্দোলনকারীদের সঙ্গেও তাদের সংশ্নিষ্টতা নেই।
এ নিয়ে কথা হয় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রাফিউল আলমের সঙ্গে। তার দাবি-সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আরও ৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু গুচ্ছগ্রামে ঘুরে তার দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। সেখানে বসবাসকারী জিসায়েল হেমব্রম, কৃষ্ণা পাহাড়ি সহ কয়েকজন সাঁওতাল বলেন, তাদেরকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ডেকে এনে এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের সবার অন্যত্র ঘরবাড়ি রয়েছে। তাদের অভিযোগ, গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও শিলাব্রত কর্মকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, এখানে বসবাসরতরা উচ্ছেদ হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজন এবং পুনর্বাসনের পর সরকারের দেওয়া সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু শুধু ঘর ছাড়া তারা কিছুই পাননি। সেখানে কয়েকটি মুসলিম পরিবারও রয়েছে বলে জানান তারা।
একই অভিযোগ সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কের। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় প্রশাসন মিথ্যাচার করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ১৮ মাসেও পুনর্বাসন করা হয়নি। আড়াই হাজার সাঁওতাল পরিবার খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তাঁবু টানিয়ে থাকছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০ দিনের কর্মসূচিতে লোক নিলেও তাদেরকে কোনো কাজে নেওয়া হয় না।
তিনি অভিযোগ করেন, বেতারা গুচ্ছগ্রামে যাদেরকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, দক্ষিণ আনালেরতাড়ী খোলাহাটির দুলাল, বেতারার সুইটি সরেন, একই এলাকার মান্নান সরকার, বেড়া বুজরুকের রমেশ টুডু, পালটন টুডু, ম্যানুয়াল কিসকু, যোহন হেমব্রম ও কইন সরেন। তাদের প্রত্যেকেরই ঘরবাড়ি রয়েছে। সতীশ কিসকু বলেন, এখানে ৩০-৩২ জন পরিবারকে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে থাকে মাত্র ৫-৭টি পরিবার। অন্যরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতেই থাকছে। তিনি আরও বলেন, এখানে থাকার কোনো পরিবেশ নেই। নদী থেকে বালু তুলে তার ওপর ঘর তৈরি করা হয়েছে। একটু বৃষ্টিতেই ঘরের ভিটা ধসে যায়।
কইন সরেন নামে অপর এক ব্যক্তি বলেন, একটু বাতাসেই ঘর নড়বড় করে। মনে হয় এই বুঝি ভেঙে গেল। গত দু'দিনের বৃষ্টিতে ঘরের পাশে পানি জমে গেছে। এ অবস্থায় কেউ এখানে থাকতে রাজি হয় না।
সাঁওতালদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত ইউএনও আবদুর রাফিউল আলমের বক্তব্য, 'এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় বলতে পারবেন।'
ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্বে ছিলেন ইউএনও শিলাব্রত কর্মকার। তিনি বলেন, বেতারা গুচ্ছগ্রামে যাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই সাহেবগঞ্জ/বাগদাফার্ম থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল পরিবার। বেতারা গুচ্ছগ্রামের বর্তমান চিত্র তুলে ধরলে তিনি বলেন, গুচ্ছগ্রামটি আসলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। যখন তারা সেখানে থাকতে রাজি হয়নি, তখন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভূমিহীন সাঁওতালদের এনে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
একই বক্তব্য গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পালের। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের জন্য আরও আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম তৈরি করা হবে। মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত যারা এখনও পুনর্বাসনের বাইরে রয়েছে, তাদের এখানে আনা হবে।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিরোধপূর্ণ জমিতে পুলিশের উপস্থিতিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ কাটতে গেলে সাঁওতালদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন রমেশ টুডু, মঙ্গল মার্ডি এবং শ্যামল হেমব্রম নামে তিন সাঁওতাল। পরে অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যরা সাঁওতালপল্লীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তে গোটা সাঁওতালপল্লী পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই থেকে খোলা আকাশের নিচে মানববেতর জীবন-যাপন করছে ভূমিপুত্ররা।
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল, আদিবাসী বার্তা।

Thursday, May 24, 2018

আদিবাসী সমাজের বিরূপের কারণ জানতে সিভিক পুলিশ দিয়ে সমীক্ষা জঙ্গলমহলে।


পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি আদিবাসী সমাজের বিরূপের কারণ জানতে সিভিক পুলিশ দিয়ে সমীক্ষা জঙ্গলমহলে।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গলমহল তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করলেও কাঁটা হয়েছে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেসের হার ও বিজেপির উত্থান। পঞ্চায়েত নির্বাচনে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেসের হার ও বিজেপির উত্থানে আদিবাসীদের উন্নয়নের সুফল পেতে কোন ফাঁক ছিল কিনা তা জানতে সিভিক পুলিশদের দিয়ে সমীক্ষা করানো শুরু করল রাজ্য সরকার। সিভিক পুলিসেরা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আদিবাসীদের কাছে জানতে চাইছেন যে দু’টাকা কেজি চাল পাচ্ছেন? পরিবারের স্কুল পড়ুয়ারা সবুজ সাথীর সাইকেল পেয়েছে? আর সরকারি প্রকল্পে বাড়ি?
ভোট মিটতেই জঙ্গলমহলের দোরে দোরে এ সব প্রশ্ন নিয়ে হাজির সিভিক ভলান্টিয়াররা। খুঁটিনাটি তথ্য লিখেও নিচ্ছেন তাঁরা। জেলা পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের খবর, ঝাড়গ্রামের ৮টি ব্লকের ৯টি থানা এলাকায় শুরু হয়েছে সমীক্ষা। এলাকাবাসী কী কী সরকারি পরিষেবা পেয়েছেন, না পেলে সমস্যার কারণ, পরিষেবা পেতে কাউকে টাকা দিতে হয়েছে কি না— যাবতীয় তথ্য সিভিক ভলান্টিয়ার জানছেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।
এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি ঝাড়গ্রামের জেলা পুলিশ সুপার অমিতকুমার ভরত রাঠৌর। মুখ খোলেননি জেলাশাসক আর অর্জুনও। তবে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিক পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনে’র রাজ্য সভাপতি সঞ্জয় পড়িয়া বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই আজ এত বেকার যুবক সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ পেয়েছেন। তাঁরা সরকার ও প্রশাসনের অঙ্গ। ফলে, সরকার ও প্রশাসনের তরফে তাঁরা সমীক্ষা করতেই পারেন।’’
ঝাড়গ্রাম জেলা পরিষদ ও ৮টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ছ’টিতেই তৃণমূল জিতেছে। কিন্তু বিশেষত আদিবাসী এলাকায় বিজেপির তুলনামূলক ভাল ফল চিন্তায় ফেলেছে শাসকদের। তৃণমূলের প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, দলের একাংশের ঔদ্ধত্য, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ও গোষ্ঠী রাজনীতিই নিচুতলার জনসমর্থনে ধাক্কা দিয়েছে। তাই পোক্ত সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও পদ্ম ফুটিয়েছে গেরুয়া শিবির। আদিবাসী এলাকায় এই ক্ষোভের তল পেতেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে সমীক্ষার সিদ্ধান্ত বলে জানা গিয়েছে।
ইতিমধ্যে গোপীবল্লভপুর, সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম, ঝাড়গ্রাম থানা এলাকায় সমীক্ষা শুরু হয়েছে। সাঁকরাইলের রোহিণী এলাকার নয়াগাঁর বাসিন্দা সাবিত্রী সিংহ মানছেন, “সিভিকরা জেনে গিয়েছেন, বাড়ির সদস্যরা সরকারি প্রকল্পের কোন কোন সুযোগ পেয়েছেন।”
বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটে যেখানে শাসকদলের প্রার্থীরা হেরেছেন, বেছে বেছে সেখানেই তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক অবনী ঘোষ বলেন, “সিভিকদের হাতে লাঠি ধরিয়ে প্রথমে ভোট লুট করল তৃণমূল। এখন তাদের দিয়ে সমীক্ষা করাচ্ছে। এতেও রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি অবশ্য দোষের কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বত্র সমান ভাবে উন্নয়ন পৌঁছেছে কি না, তার খোঁজ নিতেই এই উদ্যোগ।”
অন্যদিকে আদিবাসী সমাজের নেতৃত্বরা অবশ্য রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা পরিষ্কার জানাছেন যে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকার আদিবাসী সমাজের মূল ক্ষোভের কারণ হয় মানতে চাইছে না বা বুঝতে চাইছে না। তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকার আদিবাসীদের স্বাভিমানের প্রশ্নটিকে উন্নয়নের প্রশ্ন দিয়ে গুলিয়ে ফেলছে বা গুলিয়ে দিতে চাইছে। আদিবাসী সমাজের নেতৃত্ব পরিষ্কার জানাছেন যে একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকার আদিবাসী সমাজের সাথে বিমাতৃসুলভ আচরন করছে আর অন্য দিকে দুটাকা কিলো চাল দিয়ে আনুগত্য কিনতে চাইছে, যা কোনদিনও সম্ভব নয়। আদিবাসী এলাকার স্কুল কলেজগুলিতে সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠন চালু করতে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের চরম অনীহা, আদিবাসী সমাজের মাঝি–পারগানা স্বশাসন ব্যবস্থাকে শেষ করতে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের চেষ্টা, ঘোষণা করেও আদিবাসীদের উপাসনা স্থল “জাহের থান” এর পাট্টা না দেওয়া, লাগাতার আদিবাসী নারী ও নাবালিকাদের ধর্ষণ ও তৃণমূল কংগ্রেসের আদিবাসী নেতা নেত্রীদের নীরবতা ও ধামাচাপা দেবার প্রচেষ্টা, ঝাড়গ্রাম ও সুসুনিয়া একলব্য স্কুলে আদিবাসী ছাত্রীদের ধর্ষণ ও শ্লিলতাহানির অভিযোগকে ধামাচাপা দেবার প্রচেষ্টা আদিবাসী সমাজ ভালভাবে নেইনি। তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকার এই বিষয়গুলি ধামাচাপা দিয়ে শুধুমাত্র দুটাকা কেজি চাল বা সাইকেল বিলি করে আদিবাসী সমাজের আনুগত্য কেনা চেষ্টা করে সফল হতে পারবে না।    
ঋণস্বীকার – আনন্দবাজার পত্রিকা, কিংশুক গুপ্ত, ২৫ মে, ২০১৮।

Thursday, May 17, 2018

জঙ্গলমহলে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের, পাল্লা দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি বিজেপির।


জঙ্গল মহলে রাজ্যের শাসক দল তৃনমূল কংগ্রেসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান হল আদিবাসী সমাজ সমর্থিত নতুন রাজনৈতিক শক্তি ‘আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ’। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আদিবাসী অধ্যুষিত একালাগুলিতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের দাবিদার বিজেপি। এই বারের পঞ্চায়েত ভোটে একপ্রকার মুছেই গেল বাম ও কংগ্রেস।
ভোটের দিনই ইঙ্গিত মিলেছিল৷ ফলাফল প্রকাশ হতে দেখা গেল জঙ্গলমহলে বাজিমাত করেছে আদিবাসীদের সমন্বয় মঞ্চ৷ মঞ্চের সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা দখল করল দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত৷ বেলপাহাড়ি ব্লকের বাঁশপাহাড়ি ও শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করলেন মঞ্চের নির্দল প্রার্থীরা৷ আর একটুর জন্য মঞ্চের হাতছাড়া হয়ে বিজেপির হাতে চলে গিয়েছে ভুলাভেদা গ্রাম পঞ্চায়েতটি৷ জঙ্গলমহলের এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতেই ক্ষমতায় ছিল শাসকদল তৃণমূল৷ আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের বেলপাহাড়ি ব্লকের সভাপতি বাবলু মুর্মু বলেন, ‘মানুষ অনুন্নয়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন৷ আমরা রাজনীতি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে পঞ্চায়েতে মানুষের উন্নয়ন করব৷’
জঙ্গলমহলের সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, কোডা – র মতো সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলে গঠন করেছেন আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ৷ এ বারের ভোটেই প্রথম উত্থান হয়ে এলাকায়  সাড়া ফেলে দিয়েছেন মঞ্চ৷ মঞ্চের প্রার্থীরা নির্দল হিসেবে ভোটে লড়েন। তাতে ‘দোসর’ হিসেবে যোগ দেন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা৷ তাঁদের অনেকেই ২০১৩ সালে তৃণমূলের হয়ে জিতেও এ বারে টিকিট পাননি৷ রাজ্য সরকারের ঢালাও উন্নয়ন কর্মসূচির মধ্যেও আদিবাসীদের এই মুখ ফেরানো নিঃসন্দেহে চাপ বাড়াবে শাসকদলের উপর৷
যদিও ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতি বলেন, ‘আদিবাসীরা আলাদা হয়নি৷ ওদের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা চলছে৷ ভোটের আগেও কথা হয়েছিল৷ আমরা ওই ব্লকে এই ফল আশা করেছিলাম৷’
বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি সুখময় শতপথী বলেন, ‘আদিবাসী মানুষের ক্ষোভ আছে৷ মানুষ তাঁদের সমর্থন করেছে৷’
বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের মধ্যে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দলরা পেয়েছে সাতটি, তৃণমূল দু’টি ও বিজেপি একটি আসন৷ শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের ১১টি আসনের মধ্যে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দলরা পেয়েছে ৬টি, ৩টি বিজেপি, ২টিতে তৃণমূল জয়ী হয়েছে৷ বেলপাহাড়ি ব্লকের মোট ৩৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে জয়ী হয়েছে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল প্রার্থীরা৷
কিন্তু জঙ্গলমহলে দু’টাকা কিলো চাল, আমার বাড়ি প্রকল্পে ঘরের মতো নানা কল্যাণমূলক প্রকল্পের পরও প্রায় একই ছবি আদিবাসী অধ্যুষিত পুরুলিয়াতেও৷ বলরামপুর, বরাবাজার, বাগমুন্ডি, আড়শা - সবখানেই পঞ্চায়েতে খাতা খুলেছে বিজেপি৷ শিল্পাঞ্চল রঘুনাথপুরকে ঘিরে থাকা রঘুনাথপুর ১, রঘুনাথপুর ২, সাঁতুড়ি ব্লকেও ধাক্কা খেয়েছে তৃণমূল৷ পুরুলিয়া শহর লাগোয়া পুরুলিয়া ১ ও ২ নম্বর ব্লকে ও তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি৷ আদিবাসীদের বিভিন্ন গণসংগঠন কাশীপুরের পাহাড়পুর ও রঘুনাথপুরের বেড়ো গ্রামে পাহাড় কেটে গ্রানাইট বের করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পাহাড় কাটা বন্ধ হলেও রঘুনাথপুরের প্রকল্পটি বন্ধ হয়নি৷ দু’টাকা কিলোর চাল পেলেও উৎপাদিত ফসলের বিপণনের ব্যবস্থা হয়নি৷ আদিবাসী নেতারা বলছেন, এই জমানায় জেলার অধিকাংশ আদিবাসী ছাত্রাবাস বন্ধ, অলচিকি হরফে সাঁওতালি ভাষার মাধ্যমে পঠনপাঠন হচ্ছে না৷ মুখ্যমন্ত্রীর কুড়মিদের আদিবাসী তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগও ভালো ভাবে নেননি আদিবাসীরা৷
বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী বলেন, ‘তৃণমূলের স্বজনপোষণ, দুর্নীতি আমরা মানুষের কাছে তুলে ধরেছি৷ তাই সন্ত্রাস করে কাশীপুরে জয়ী হলেও আশেপাশে সর্বত্র হেরেছে ওরা৷’
তবে তৃণমূলের হারের একমাত্র কারণ হিসেবে দলের কিছু কর্মীর অন্তর্ঘাতকেই দায়ী করেছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি ও মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো৷ তিনি বলেন, ‘প্রার্থীদের কয়েকজন দাবিদার বিরোধীদের সঙ্গে গোপনে আঁতাঁত করেছিল৷ অন্য কোনও কারণে দল হারেনি৷’
ঝাড়গ্রামে রাজ্যের মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতোর নিজের আমলাচটি বুথ সহ শালবনি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮টি আসনে একটিতেও জিততে পারেনি তৃণমূল৷ জিতেছে বিজেপি৷ চূড়ামণি মাহাত বলেন, ‘মানুষ বেইমানি করলে কী করা যাবে ? বিজেপি প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় টাকা দিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়েছে৷’
ঝাড়গ্রামে বিজেপির এই ফল শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি৷ অজিত বলেন, ‘এতগুলো আসন বিজেপি পায়নি৷’ নির্বাচন কমিশনের রেজাল্ট বলতে তিনি বলেন,‘আচ্ছা! কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে তা দেখতে হবে৷ আসলে ওরা (দলের নেতারা) রুট ওয়ার্কটা করেনি৷’
ঋণ স্বীকার – এই সময়, ১৭ ই মে, ২০১৮।

জঙ্গলমহলে উত্থান বিজেপি ও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের।


দুর্নীতি আর আদিবাসী সমাজের অসন্তোষের কারণে জঙ্গল মহলে হার তৃণমূলের, উত্থান বিজেপি ও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের।

৫ থেকে ৩২৯! বাংলার সবচেয়ে নতুন জেলা ঝাড়গ্রামের ৪১ শতাংশ গ্রামেই জোড়া-ফুলকে উৎখাত করে পদ্ম ফোটাল বিজেপি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে যে ঝাড়গ্রামে মাত্র পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেই জেলাতেই এই নির্বাচনে শাসক দলকে সমানে টক্কর দিয়ে অন্তত ২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজেপি। ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের এখনও ত্রিশঙ্কু। এর মধ্যে আরও ৩টি বিজেপির দখলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে বিজেপির আরও ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ৬০টি আসনে জয়ী বিজেপি-র প্রার্থীরা। খালি ঝাড়গ্রাম নয়, একই ছবি জঙ্গলমহলের বাকি দু’টি জেলা পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়াতেও।
গোটা রাজ্যে যখন শাসক দল কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে জঙ্গলমহলে এসে তৃণমূলের সেই বিজয়রথ হঠাৎ করেই থমকে গেল। যে জঙ্গলমহলের লাল মাটি থেকে ‘পরিবর্তন’-এর অভিমুখ তৈরি হয়েছিল, সেই লালমাটিতেই গেরুয়ার দাপাদাপি!
বিনপুর-১ ব্লকের সব পঞ্চায়েতের গণনা হয়েছে লালগড় হাইস্কুলে। দুপুর গড়ানোর আগেই ঘোষণা হল সিজুয়া পঞ্চায়েতের ফল। দেখা গেল, মোট ১০টি আসনের মধ্যে ছ’টি বিজেপি-র দখলে। বাইরে অপেক্ষা করা বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল উল্লাস। ধামসা-মাদলের তালে তালে নাচ।
কিন্তু কারা এই বিজেপি সমর্থক? ক’দিন আগেও যাঁদের গোটা এলাকা চিনত সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসাবে, এ দিন তাঁদেরকেই দেখা গেল পদ্মফুলের ঝান্ডা কাঁধে! ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঁটাপাহাড়ি এলাকার বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা, যাঁরা এক সময়ে লালগড় আন্দোলনের মুখ ছিলেন। পরবর্তীতে সেই নেতাদের হাত ধরেই লালগড়ের বুকে জোড়া-ফুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ততক্ষণে খবর আসছে, একের পর এক আসনে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গেরুয়া ব্রিগেড। কিন্তু, বাইরে দাঁড়ানো ওই ভিড়ে কোথাও কোনও আফসোসের চিহ্নমাত্র নেই। এঁদেরই একজন দীপক প্রতিহার। কাঁটাপাহাড়ির এই বাসিন্দা এখনও ওই এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা হিসাবে পরিচিত। তাঁর কথায়, “এখনও এলাকার মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে নয়। জনগণের এই রায় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। এলাকা থেকে শুরু করে জেলা, রাজ্য নেতাদের দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।”
কিন্তু, কেন এত ক্ষোভ মানুষের? দীপকের মতোই মুখ খুললেন এলাকার অন্য তৃণমূল কর্মীরাও। উগরে দিলেন একের পর এক দুর্নীতির গল্প। জঙ্গলমহলের প্রায় সর্বত্র সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে নেতাদের লাখপতি হয়ে ওঠার কাহিনি।
কিন্তু, সেই দুর্নীতিই কি একমাত্র কারণ এই ভরাডুবির? জঙ্গলমহলের মানুষের কথাতেই পাওয়া গেল নতুন এক অসন্তোষের ইঙ্গিত। বাঁশপাহাড়ির এক তৃণমূল কর্মীর গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ল, “কোনও দলই আদিবাসীদের মানুষ বলে মনে করে না। নেতাইয়ে যাঁরা হার্মাদদের গুলিতে মারা গেলেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিল সরকার। কিন্তু খাসজঙ্গলে যে তিনজন মারা গিয়েছেন তাঁদের কোনও ক্ষতিপূরণ সরকার দেয়নি। কারণ, খাস জঙ্গলের সবাই ছিলেন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের।”
এই বিভেদের অভিযোগ যে আদিবাসী-মূলবাসী মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে, তা স্পষ্ট বিনপুর-২ ব্লকের ফলে। সেখানে প্রায় ৩০জন নির্দল প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তাঁরা সবাই আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, মাওবাদী, বিজেপি, সিপিএম একজোট হয়েছে। যদিও তৃণমূলের একাধিক জেলা নেতৃত্ব বিজেপি-র এই জয়ের পিছনে গোষ্ঠীদ্বন্দকেই দায়ী করেছেন।
কেবল ঝাড়গ্রাম নয়, লাগোয়া বাঁকুড়ার রাইপুর, সারেঙ্গা, রানিবাঁধ সহ একাধিক ব্লকে জায়গা দখল করেছে বিজেপি। পুরুলিয়াতে তৃণমূলের ৮১৪টি আসনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজেপি-র আসন সংখ্যা ৬৮৮। সেখানেও ৫০টির বেশি পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের সম্ভাবনা বিজেপি-র।
সর্বত্রই একই দুর্নীতির অভিযোগ।সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে আদিবাসী সমাজের সঙ্গে মাহাতো কুড়মি সমাজের মধ্যে বেড়ে চলা দূরত্বও বিজেপি-র রাস্তা চওড়া করেছে বলে দাবি একাধিক তৃণমূল নেতার। পুরুলিয়ার এক তৃণমূল নেতার দাবি, “পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে মূল চালিকাশক্তি মাহাতোরা। দীর্ঘদিন জঙ্গলমহলে রাজনীতি করা মুকুল রায় সঠিক সময়ে মাহাতো সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাশার বীজটা পুঁতে দিয়েছেন। আর সেই চালেই কিস্তিমাত করেছে বিজেপি।” গত এক বছরে পুরুলিয়াতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক অশান্তি যে রাজনৈতিক মেরুকরণ করেছে, তার ফায়দাও বিজেপি ঘরে তুলেছে,  মানছেন পুরুলিয়ার তৃণমূল নেতারা।
শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ, দুর্নীতি বা আদিবাসী সমাজের অসন্তোষ — কারণ যাই হোক না কেন, জঙ্গলমহলের অন্দরের এই ফল শাসক দলের কাছে অশনিসঙ্কেত। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় জঙ্গলমহল হাসলেও, তার গভীরে যে শাসকের জন্য এত ব্যথা লুকিয়ে ছিল, তা প্রকাশ্যে এল এ দিনের এই ফলে। আর এটাই যদি ইঙ্গিত হয়, তবে লোকসভা নির্বাচনে এই আসন ধরে রাখা যে কঠিন হবে, তা আগেভাগেই স্বীকার করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।
ঋণ স্বীকার – আনন্দবাজার পত্রিকা, সিজার মণ্ডল, ১৭ মে, ২০১৮।

Wednesday, May 16, 2018

দলিতদের পাশে দাড়াতে নতুন রাজনৈতিক দল প্রাত্তন বিচারপতি কারনানের।


দলিতদের পাশে দাড়াতে রাজনৈতিক দল গড়লেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রাত্তন প্রধানবিচারপতি সি এস কারনান।

প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গড়লেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সিএস কারনান৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আদালত অবমাননার মামলায় নজিরবিহীন ভাবে ছ’মাস প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে কাটাতে হয়েছে প্রাক্তন বিচারপতিকে৷ জেল থেকে মুক্তির পর বুধবার প্রথম কলকাতায় সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন কারনান৷ সেখানেই নতুন রাজনৈতিক দলের কথা ঘোষণা করেন তিনি৷
বন্দিমুক্তি কমিটির উদ্যোগে দেশজুড়ে দলিত-সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি কনভেনশনে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি৷ বিচারপতি থাকাকালীনও এ বিষয়ে একাধিক বার সরব হয়েছিলেন তিনি৷ দেশের বিচার-ব্যবস্থার ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি কারনান৷ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এর বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই জারি থাকবে৷ প্রাক্তন বিচারপতি বলেন, ‘আমরা অ্যান্টি কোরাপশন ডায়নামিক পার্টি (Anti Corruption Dynamic Party - ACDP) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করেছি৷ ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কাছে এই নতুন জাতীয় রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে৷ সেটা হলে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনেই অংশ নেব৷’
নতুন দলের উদ্দেশ্যও জানিয়ে দেন কারনান৷ তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের বিচার-ব্যবস্থার ভূমিকায় অসন্ত্তষ্ট৷ প্রশাসন ও বিচার-ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও সবার জন্য সমান হিসাবে দেখতে চাই৷’ নতুন রাজনৈতিক দলের তরফে দেশের ৫৪৩ টি লোকসভা কেন্দ্রেই মহিলা প্রার্থী দাঁড় করানোর কথা জানান কারনান৷ তিনি জানান, দলের তরফে তাঁকে একমাত্র পুরুষ প্রার্থী হিসাবে বারাণসী থেকে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল৷ তবে তিনি চান, ওই আসনেও কোনও মহিলাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন৷
বন্দিমুক্তি কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই কনভেনশনে দেশের সর্বত্র দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর যে ভাবে নির্যাতন চলছে, তার প্রতিবাদ জানানো হয়৷ ছত্রধর মাহাতো-সহ বেশ কয়েক জনের মুক্তির দাবিও তোলা হয়৷ কারনান অবশ্য সরাসরি এঁদের মুক্তির বিষয়ে কিছু বলেননি৷ তিনি বলেন, ‘বিচার-ব্যবস্থা ও রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করব, যাঁরা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং নিরপরাধ তাঁদের মুক্তির জন্য যেন উদ্যোগ নেওয়া হয়৷’ তাঁর বক্তব্যে বার বারই উঠে আসে বিচার-ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষের কথা৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে ভাবে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়, তারও সমালোচনা করেন তিনি৷
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ ই মে ২০১৮।

Tuesday, May 15, 2018

পাহারা দিয়ে স্ট্রং রুম অবধি ভোটবাক্স পৌঁছে দিল আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের সদস্যরা।


এ যেন জান কবুল লড়াই! ভোটের সময় মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। এর পর ভোট ব্যালট বাক্স পাহারা দিয়ে ‘রিসিভিং সেন্টারবেলপাহাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। সোমবার রাতে ভোট মিটতে দেখা গেল, ভোটকর্মীদের গাড়িগুলির পিছনে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের লোকজনের বাইকের ‘কনভয়’। বেলপাহাড়ির রিসিভিং সেন্টার পর্যন্ত গেল সেই ‘কনভয়’। ব্যালট বাক্সগুলি স্ট্রং রুমে ঢোকানো পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন মঞ্চের লোকজন। এক সেক্টর অফিসারের কথা।, “এতদিন ভোটের ডিউটি করছি, এমন কাণ্ড আগে কখনও দেখিনি।
কেন এই নজরদারি? আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতা ধর্মাল মান্ডি বলেন, “বঞ্চনা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোটাররা এ বার সমাজের ডাকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। আমাদের আশঙ্কা ছিল, প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঝপথে ব্যালট বাক্স বদলে দেওয়া হতে পারে। তাই এই বন্দোবস্ত।” তৃণমূলের বেলপাহাড়ি ব্লক কার্যকরী সভাপতি বিকাশ সিংহের কটাক্ষ, ‘‘ওরা (আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের সদস্যেরা) স্ট্রং রুমের বাইরে হাস্যকর ভাবে নজরদারি চালাচ্ছে। মঞ্চের মধ্যে সিপিএমের লোকজনও আছে। বাম আমলে ওরা মাঝ রাস্তায় ব্যালট বাক্স বদলে দিত। আমরা ওদের মতো নই।”
ভোটের দিনই ধর্মালবাবুর দাবি ছিল, ব্যালট বাক্স বদলে না দেওয়া হলে বেলপাহাড়ি থেকেই বদলের সূচনা হবে। নিজের দাবিতে অনড় তিনি। তাই শুধু নজরদারি নয়, কারচুপি রুখতে অন্য কৌশলও নিয়েছে আদিবাসী মঞ্চ। ধর্মালবাবু জানান, ভোটদানের সময় প্রতিটি ব্যালট বাক্সে সংকেতযুক্ত দশটাকা ও পাঁচটাকার নোটও ঢোকানো হয়েছে। গণনার সময় সেগুলি পাওয়া গেলে বোঝা যাবে ব্যালট বাক্স ‘অক্ষতআছে কি না।
শিমূলপাল অঞ্চলের বুড়িঝোর, বাঁশপাহাড়ি অঞ্চলের চাকাডোবা ও কাশমারের মতো বেশ কিছু বুথে ভোট হয়েছে কোথাও রাত দশটা কোথাও রাত ১১ টা পর্যন্ত। ভুলাভেদা অঞ্চলের শিয়াড়বিঁধা বুথে রাত পৌনে বারোটা পর্যন্ত ভোট হয়েছে। বাঁশপাহাড়ির এক ভোটকর্মী বলেন, “রাতে ফেরার সময় আমাদের গাড়ির পিছনে অন্তত গোটা দশেক বাইকে সওয়ার আদিবাসী সমাজের লোকজন ছিলেন।”
বুথ থেকে ‘রিসিভিং সেন্টারপর্যন্ত নজরদারির প্রসঙ্গে ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আর অর্জুন বলেন, “যাঁরা ভোট কর্মীদের গাড়িগুলিকে অনুসরণ করছিলেন, তাঁরা ঠিক কাজ করেননি। ব্যালট বাক্স সুরক্ষিত অবস্থায় রাখার সব রকম বন্দোবস্ত রয়েছে। আশঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চকে আশায় রেখেছে ভোটদানের হার। এক সময়ের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকার এক একটি বুথে নব্বই থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের দাবি, বেশি ভোট দানের হার থেকেই স্পষ্ট পরিবর্তন হচ্ছে। তবে আশা হারাতে নারাজ শাসকও। বিকাশবাবুর কথায়, ‘‘কয়েকটি বুথে সমস‍্যা আছে। তবে অধিকাংশ আসনে আমরা ভাল ফল করব।”
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, কিংশুক গুপ্ত, ১৬ ই মে, ২০১৮।

এবারের পঞ্চায়েত ভোটে প্রথমবার ভোট দিলেন ৮০ বছরের আদিবাসী বৃদ্ধা বেবি মুর্ম।


৮০ বছর বয়সে প্রথম ভোট দিলেন বেটি মুর্ম। এবছরই তার ভোটার তালিকায় প্রথম নাম উঠেছে। সোমবার সকাল ১১টায় ডাক্তার মারডির বাইকে চেপে বাড়ি থেকে পাশের হাটগাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নামলেন বেটি। নিজের হাতে ভোট দিয়ে চরম আনন্দ অশীতিপর এই ভোটারের। এ জীবনে নিজের হাতে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরে বেজায় খুশি তিনি। অন্যদিকে, ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতে তেঁতুলবাঁধি গ্রামে নতুন ভোটার হিসাবে বেটি মুর্মুকে ভোট দেওয়াতে পেরে খুশি প্রশাসনও।
বেটি মুর্মুর ৭৯ বসন্ত পেরিয়ে গেলেও নিজের হাতে ভোট দেওয়ার স্বপ্নপূরণ হয়নি। কারণ, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর ভাল করে বাংলা না জানা। এতদিন তাঁর নিজের তেমন কোনও পরিচয়পত্র ছিল না। ঝাড়খণ্ডে বিয়ে হওয়ার পর তিনি সেখানেই ছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর আবার ফিরেছেন নিজের ভিটেতে। তেঁতুলবাধি গ্রামে। বেটি মুর্মু বলেন, “ভাইপোদের দেখতাম ভোট দিতে যাচ্ছে। খোপে ঢুকে ছাপ দিচ্ছে। ভাবতাম এ জীবনে আর হয়ত এ সুযোগ হবে না। সোমবার নিজের হাতে ভোট দিলাম।বাঁহাতের তর্জনী তুলে ভোটের কালি দেখিয়ে বললেন, এ যেন তাঁর কাছে সম্মানের গহনা। পরপর দুটো ছাপ দিয়েছেন। নিজের কাঁপা হাতে ভাঁজ করেছেন। ঠিক ফেলেছেন ভোটের বাক্সে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি বলে জানালেন বেটি।
৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে পাথর শিল্পাঞ্চলের আঁকাবাঁকা পথের শেষে তেঁতুলবাধি গ্রাম। গ্রামে দুটি পাড়া। নামো পাড়ার বাসিন্দা বেটি মুর্মু। তাঁর ভাঙাচোরা ঘর। তিনি বাংলা বুঝতে পারেন। কিন্তু বলতে পারেন না। সকাল থেকেই ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। কিন্তু কাউকে পাচ্ছিলেন না। আদিবাসী গাঁওতার সদস্য ডাক্তার মারডি বিষয়টি জানতে পেরে নিজের বাইক নিয়ে আসেন। ৮০ বছরের বৃদ্ধা ভোট দেওয়ার আনন্দে ডাক্তারকে চেপে ধরে বাইকে চড়লেন। স্কুলে এসে তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে হল না। সবাই নতুন ভোটারকে পথ করে দিলেন। অশক্ত হাত। লাঠি ধরে চলা ফেরা। সেভাবেই ভোট দিলেন তিনি।
হাটগাছি এক নম্বর এলাকার তৃণমূল প্রার্থী সোমেল মুর্মু ও বিজেপির প্রার্থী মহিদাস সোরেন জানান, এবার যারাই জয় হোক, বেটি মুর্মুর হাতে এবার নতুন কার্ড তুলে দিতে পেরে তাঁরা খুশি। বেটির ভাইপো লবাই মুর্মু জানান, পিসি মারা যাওয়ার আগে নিজের ইচ্ছেপূরণ করে গেলেন।
সৌজন্য – সংবাদ প্রতিদিন, নন্দন দত্ত, ১৪ ই মে, ২০১৮।

পঞ্চায়েত ভোটে বেলপাহাড়িতে দাপট আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের।


এবারের পঞ্চায়েত ভোটে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়িতে পাত্তাই পেল না রাজ্যের শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেস। দাপট দেখাল আদিবাসী সমাজের নিজস্ব সংগঠন আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ। বেলপাহাড়ির বিভিন্ন বুথে যেখানে আদিবসী মঞ্চের বুথ ক্যাম্পে আদিবাসীদের উপচে পড়া ভিড়, সেখানে রাজ্যের শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেসের বুথ ক্যাম্পে মাছি তাড়ালেন তৃনমূল কংগ্রেস কর্মীরা।
পঞ্চায়েত ভোটের কয়েকদিন আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে জানিয়েছিলেন, বাঁশপাহাড়ির মতো জঙ্গলমহলের কিছু এলাকায় তাঁর দলকে প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন, সংরক্ষণের ফলে কয়েক জায়গায় তৃণমূল উপযুক্ত তফসিলি জাতি, জনজাতির প্রার্থী খুঁজে পায়নি।
গত সোমবার সকালে বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের কাঁকড়াঝোর, আমলাশোল, চাকাডোবাতে দেখা গেল, খাঁ-খাঁ করছে তৃণমূলের বুথ ক্যাম্প। অথচ কিছুটা দূরে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল প্রার্থীর ক্যাম্পে বুথ স্লিপ নেওয়ার জন্য ভোটারদের ভিড়। শিমূলপাল ও ভুলাভেদা-সহ বেলপাহাড়ি ব্লকের একদা মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা জুড়েই ছিল এক ছবি। বিজেপির বুথ ক্যাম্পও ছিল। তবে এলাকায় কার্যত ভোট নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল প্রার্থীদের লোক। প্রতিটি বুথের অদূরে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের বুথ ক্যাম্প ছিল। সেখানে উড়েছে সাঁওতাল, মুন্ডা ও ভূমিজ আদিবাসী সমাজের নিজস্ব আলাদা আলাদা পতাকা। প্রতিটি ক্যাম্পে ‘আদিবাসী সমাজে’-র নিয়ম মেনে পোঁতা ছিল শালগাছের ডাল।
আমলাশোলে অনাহারের কথা স্বীকার করে যিনি হই চই ফেলে দিয়েছিলেন সেই প্রাক্তন সিপিএম পঞ্চায়েত সদস্য কৈলাস মুড়াকেও পাওয়া গেল আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের বুথ ক্যাম্পে। তিনি বলেন, ‘‘আদিবাসী সমাজের নির্দল প্রার্থীদের জেতানোর জন্য সকলে মিলে চেষ্টা করছি।
ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া শিমূলপাল পঞ্চায়েতের ধবাকাচা প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথের কাছে তৃণমূলের প্রায় ফাঁকা বুথ ক্যাম্পে বসেছিলেন গুটিকয় দলীয় কর্মী। সেখানেই পাওয়া গেল গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী পরেশচন্দ্র হেমব্রমকে। তাঁর নালিশ, “সব আদিবাসী জনগোষ্ঠী একজোট হয়ে সামাজিক ফতোয়া দিয়েছে। সমাজের ভয়ে ভোটাররা নির্দল প্রার্থীর বুথ ক্যাম্পে যাচ্ছেন। আমাদের ভোটাররা চাপের মুখে ওই ক্যাম্পে গেলেও ভোটটা আমাদেরই দেবেন।তাঁর অভিযোগ, ‘‘প্রাক্তন জনগণের কমিটি ও প্রাক্তন মাওবাদীদের লোকজন মিলে আদিবাসী সমাজকে হাতিয়ার করে গ্রামে গ্রামে ভোটারদের ভয় দেখিয়ে নির্দল প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য কার্যত বাধ্য করছে।যদিও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের বুথ ক্যাম্পের কর্মী সুনীল হাঁসদা, নকুল সিংহ বললেন, ‘‘পাঁচ বছরে উন্নয়নের নামে পঞ্চায়েতে যে দুর্নীতি ও লুট হয়েছে, তাতে মানুষ বীতশ্রদ্ধ।” আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতা ধর্মাল মান্ডির দাবি, “ব্যালট বাক্স বদলে না দেওয়া হলে বেলপাহাড়ি থেকেই বদলের সূচনা হবে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, কিংশুক গুপ্ত, ১৫ মে, ২০১৮।

আদিবাসী মহিলাদের প্রতিরোধে গ্রামে ঢুকতেই পারল না তৃণমূলের বহিরাগত সমর্থকেরা।


প্রতিরোধের সামনের সারিতে আদিবাসী মহিলা বাহিনি, গ্রামে ঢুকতেই পারল না শাসকদল তৃণমূলের বহিরাগত সমর্থকেরা।

পঞ্চায়েত ভোটে বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে শাসকদলের নো এন্ট্রি! সৌজন্যে আদিবাসী ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মহিলারা৷ মহম্মদবাজারে প্রমীলাবাহিনীর প্রতিরোধে অনেক এলাকাতেই দাঁত ফোটাতে পারল না ঘাসফুল৷
বীরভূম-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত ঘেঁষা আদিবাসী গ্রাম টাংশুলি৷ শালের জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে ঢোকার মুখে কয়েকটি গাছে ঝুলতে দেখা গেল তৃণমূলের পতাকা৷ কিন্তু ব্যস, ওই পর্যন্তই! এর পর থেকে একনাগাড়ে বিজেপির পতাকা৷ কারও কারও বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেওয়া কাগজের পোস্টার৷ ফুলমণি অবশ্য চেনেন না কাগজের লোকটাকে৷ পোস্টারে নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই, জবাব এল, ‘উ কে বটে জানি না কো’৷ তবে ওই পোস্টারেই থাকা পদ্মফুল অবশ্য খুব চিনেছেন ফুলমণি৷ পদ্মফুল দেখিয়ে বললেন, ‘তব্যে পদ্মফুলটোতে ছাপ দিতে বলেছে৷’
সকাল থেকে ঘরে ঘরে ঘুরছেন কালোমণি৷ গাঁয়ের মেয়ে-বৌদের জড়ো করেছেন স্কুলে লাইন দেওয়ানোর জন্য৷ নিজেই ঠিক করছেন লাইন৷ তাঁর কথায়, ‘রাতে তৃণমূলওয়ালারা এসেছিল৷ গাঁয়ের অনেককেই টাকার লোভ দেখিয়েছে৷ অনেকের ঘরের দেওয়ালে ছবি লাগাতে গিয়েছিল৷ কিন্তু গাঁয়ের সবাই তেড়ে গিয়েছে৷ যে কঘর তৃণমূল করে, তাঁদের দেওয়ালে লাগিয়েছে৷’
টাংশুলি প্রাথমিক বিদ্যালয় বুথে সকাল থেকে মহিলাদের লম্বা লাইন৷ গাঁয়ে আজ কেউ কাজে যায়নি৷ উল্টে নিজের ভোট দিয়ে অন্য মেয়ে-বৌদের ডেকে এনেছেন ফুলমণি-কালোমণি, জবাব, বুধি, মালতীরা৷ গাঁয়ে আজ ভাত রাঁধা হয়নি৷ দিনের বেলা মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছেন ওঁরা৷ ভোট শেষ হলে এক্কেবারে রাতে ভাত রাঁধা হবে৷ পাশের গ্রাম কদমহিরের ত্রিসীমানায় নেই তৃণমূলের পতাকা৷ গাঁয়ের সবাই এককাট্টা৷ বাগাল মার্ডির কথায়, ‘ভোটপ্রচারের সময় আসতে পারে নাই৷ শেষ রাতে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু জনকে টাকাপয়সা দিতে গিয়েছে৷’
চারি দিকে শুধু বিজেপির পোস্টার আর পতাকা৷ গাঁয়ে ঢোকার মুখে কদমহির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গাছতলায় বসে গাঁয়ের লোক৷ দুয়ারে শিকল তুলে গাঁয়ের প্রবেশপথে পাহারা দিচ্ছেন যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে৷ সেখানেই দাঁড়িয়েছিলেন বুদি হেমব্রম, সুমি মার্ডিরা৷ তাঁদের একরোখা মন্তব্য, ‘গাঁয়ে আজ যদি বাইরের কেউ আজ আসত, তাহলে ওদের মেরে এলাকাছাড়া করতাম৷’
শুধু টাংশুলিই নয়, আশপাশের ফুলবেড়িয়া, শিউলি, পাহাড়ির মতো আরও অনেক গ্রামেই দেখা গিয়েছে এই চিত্র৷ শিউলি-পাহাড়ির বাসিন্দা বুধন হেমব্রম বলেন, ‘শাসকদল অস্বস্তিতে আছে৷ ওরা গাঁয়ের জন্য কিছু করে নাই৷ কোন মুখে আসবে ? এলেই এলাকাছাড়া করবে গাঁয়ের মানুষ৷’
মহম্মদবাজারের চরিচা অঞ্চলের নিমদাসপুর, দাসপুর এলাকায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে এতটাই ক্ষোভ যে, ভোট প্রচার পর্বে হাজার চেষ্টাতেও তা মেরামত হয়নি৷ তারই প্রমাণ মিলল এ দিন গ্রামে ঢুকে৷ শাসকদলের পতাকার কোনও অস্তিত্বই নেই এখানে৷ শুধু বিরোধীদের পতাকা চার দিকে৷ ক্যাম্প অফিসে কয়েক জন তৃণমূল কর্মীর দেখা মিললেও গাঁয়ের লোক তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়েছে৷ গ্রামের বাসিন্দা সূবল মার্ডি বলেন, ‘গাঁয়ের মানুষের খুব ক্ষোভ তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ তাই কেও ওদের কাছে যাচ্ছে না৷’
একই অবস্থা বীরভূমের পাথর বলয় পাঁচামি ভাঁড়কাটা গ্রামে৷ ভোটারদের প্রভাবতি করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার নেতা রবীন সোরেন৷ তাঁর কথায়, আমরা এ বার ভোটে লড়াই করিনি৷ আবার নির্দিষ্ট কোনও দলকে ভোটও দিতে বলিনি৷ যার যেখানে ইচ্ছা, ভোট দিন৷ তবে যেহেতু আদিবাসীরা বহু গ্রামে বঞ্চিত, তাই তাঁরা এককাট্টা এ বার৷ তবে বহু প্রলোভন দেওয়া হয়েছে ওদের৷’
বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলেন, ‘বনবাসী ভাইবোনেরা যে ভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, তাতে আমরা দেখেছি, ওরা এককাট্টা হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন৷ তবে ওঁরা অনেক প্রলোভন দেখিয়েছে৷’
তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তাপস সিনহা বলেন, ‘বেশ কিছু আদিবাসী গ্রামে আমাদেরই নিচুতলার নেতাকর্মীদের আচরণে প্রচারে সমস্যা হয়েছিল৷ তবে আমরা তা সামলে ফেলেছি৷ এখনও টাংশুলি ও কদমহির মতো গ্রামে একটু সমস্যা আছে৷ তবে জিতে যাব মনে হয়৷’
সৌজন্য – এইসময়, হেমাভ সেনগুন্ত, ১৫ ই মে, ২০১৮।

তৃণমূলের সাথে টক্কর নিয়ে ভোট করাল বিজেপি ও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ।


জঙ্গলমহলের পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূলের সাথে টক্কর নিয়ে ভোট করাল বিজেপি ও আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ।

শুধু কয়েকটা পতাকা লাগিয়ে বা দেওয়াল লিখে নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে কার্যত ময়দানে নেমে শাসকদলের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করল বিজেপি৷ পাশাপাশি জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় শাসক তৃণমূলকে কোণঠাসা করে দিয়ে দাপটে ভোট করে গেল আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চও৷ বিজেপিকে নির্বাচনের দিন জঙ্গলমহলে খুঁজেই পাওয়া যাবে না বলে দাবি করেছিল শাসকদল৷ আর এ দিন তৃণমূলের প্রার্থী তথা জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরা এ দিন বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁকে হেনস্থা করার অভিযোগ তুললেন৷ তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সমর্থনে বিজেপি কিছু জায়গায় দাপাদাপি করেছে৷ তবে ফলাফলে এর প্রভাব পড়বে না৷’
বেলপাহাড়ির আমলাশোল, কাঁকড়াঝোরে ভোটের দিন তৃণমূলের টিকিও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ শাসকদলের বুথ এজেন্ট তো দূরের কথা, কোনও লোকজনকেই দেখা যায়নি৷ আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতারাই কার্যত ভোট করান ওই এলাকায়৷ ঝাড়খণ্ড সীমানায় বেলপাহাড়ির পাহাড় ঘেরা প্রত্যন্ত এলাকায় ভোটারদের লম্বা লাইন ছিল সকাল থেকে৷ আদিবাসী মঞ্চের নেতারা দূরে গাছের তলায় ত্রিপল বিছিয়ে বুথ স্লিপ দেওয়া থেকে শুরু করে ভোটারদের মুড়ি-ছোলা-চানাচুর হাতে হাতে ধরিয়ে দেন৷ ধোবাকাচায় তৃণমূলের ক্যাম্প থাকলেও, সেখানে প্রার্থী ছাড়া মাত্র দুজন বসেছিলেন৷ উল্টোদিকে, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের ক্যাম্পে ভিড় থিকথিক করছে৷
ধোবাকাচার তৃণমূল প্রার্থী পরেশচন্দ্র হেমব্রমের অভিযোগ, ‘ওরা সমাজের নাম করে ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছে৷ মাওবাদী-জনসাধারণ কমিটির যে সব নেতা জামিনে মুক্ত, তারাই এখন সমাজের লিডার৷’ আবার বুড়িঝোরে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নির্দল প্রার্থী জলেশ্বর সিং এতটাই আত্মবিশ্বাসী, যে সাফ বলছেন, ‘জিতব তো অবশ্যই, আমি সমাজের পক্ষ থেকে প্রধানও হব৷ তৃণমূলের নেতারা মানুষের জন্য কিছু করেনি, নিজেরা সব খেয়েছে৷’ কাঁকড়াঝোরের আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতা ধর্মাল মান্ডি বলেন, ‘কোথাও দশ টাকা, আবার কোথাও সাদা কাগজ আমরা ঢুকিয়ে দিয়েছি বাক্সের মধ্যে৷ গণনার দিন বাক্স খোলার সময়ে যদি ওই টাকা বা সাদা কাগজ না পাওয়া যায় তা হলে বুঝব ভোটের বাক্স বদল করেছে৷’
বেলপাহাড়ির ভুলাভেদার কেচন্দা বুথে ব্যালট বাক্স ছুড়ে তৃণমূলের এজেন্ট চিরঞ্জীব দত্তের মাথা ফাটানোর অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে৷ মেদিনীপুর সদর, শালবনি এবং গড়বেতা ২-এর মতো একদা মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের ব্লকে লড়াই করতে দেখা গেল বিজেপিকে৷ মুখ টিপে শালবনির এক তৃণমূল নেতা মানছেন, ‘শাল-পিয়ালের জঙ্গলে পদ্ম ফুটে যাবে মনে হচ্ছে!’
শালবনি ব্লকের পিড়াকাটায় ঢোকার আগে ভাদুতলা-লালগড় রাজ্য সড়কের মাঝ বরাবর রাস্তায় বিজেপি কর্মী, সমর্থকরা পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়েছে৷ পিড়াকাটা হাইস্কুলে তৃণমূল নেতা কর্মীদের জমায়েত করা নিয়ে সরব হয় বিজেপি কর্মী, সমর্থকরা৷ জয়পুরের দিকে কিছুটা এগোতেই শাসকদলের পাশাপাশি সমান বুথ ক্যাম্প চোখে পড়ল বিজেপির৷ গড়বেতা-২ ব্লক বা গোয়ালতোড়েও চোখে পড়েছে বিজেপি কর্মী, সমর্থকদের বুথ পাহারা৷ তিনটি ব্লকের পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে সিংহভাগ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি৷ গোয়ালতোড় লাগোয়া গড়বেতা ৩ ব্লকের সেকাশোলে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ করেছেন বিদায়ী সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরা৷
গোটা গোয়ালতোড় জুড়ে শাসকদলের সঙ্গে রীতিমতো টেক্কা দিয়ে পোস্টার, দেওয়াল লিখন করেছে বিজেপি৷ ভোটের আগে পরে তৃণমূল বুথ ক্যাম্প থেকে ভোটারদের যেমন ছোলা-মুড়ি দেওয়া হয়েছে, তেমনই বিজেপিও পাল্টা মুড়ি-পেঁয়াজি দিয়েছে৷ কপালে তিলক, গলায় গেরুয়া গামছা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বিজেপি কর্মীরা৷ নয়াগ্রাম ব্লকের বিভিন্ন বুথে সকালের দিকে বিজেপির বুথ এজেন্টদের বসতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু বেলা গড়াতেই চিত্রটা একেবারে পাল্টে যায়৷ কলমাপুকুরিয়া, ছোটঝরিয়া, খাসজঙ্গলের বুথগুলিতে বিজেপি বাইরের লোক এনে হামলা চালায়৷ খাসজঙ্গল বুথের তৃণমূলের এজেন্ট জগদীশ মাহাতোকে বুথের মধ্যে ঢুকে অপহরণ করার অভিযোগ উঠেছে৷ ছোটঝরিয়ায় তৃণমূলের এজেন্ট শশাঙ্ক বেরা বলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে এখানে ভোট হচ্ছে, কোনও গন্ডগোল হয়নি৷ আজকে বিজেপি বাইরের লোক এনে হামলা চালাল৷’
ঝাড়গ্রামের আমলাচটি বুথে সাতসকালে লাইনে দাড়িয়ে ভোট দেন অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী চূড়ামণি মাহাতো৷ লালগড়, জামবনি, সাঁকরাইল, গোপীবল্লভপুর এলাকায় ভোট উৎসবের মেজাজে হয়েছে৷ তৃণমূল-বিজেপি উভয় দলের পক্ষ থেকে মুড়ি-চানাচুর-চপ বিলি করা হয়েছে ভোটারদের৷ গোপীবল্লভপুর-২ নম্বর ব্লকের কুলিয়ানা জুনিয়ার হাইস্কুলে ভোট দিতে আসার কথা ছিল বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের৷ যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ভোট দিতে আসেননি৷ কুলিয়ানা বুথে বিজেপির এজেন্ট তথা দিলীপ ঘোষের ভাই সুকেশ বলেন, ‘তৃণমূল গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টায় ছিল৷ আমরা রটিয়ে দিয়েছিলাম দিলীপদা ভোট দিতে আসছে, ওরা আর গণ্ডগোল করতে সাহস করেনি৷’৷
সৌজন্য – এইসময়, সমীর মণ্ডল, অরূপকুমার পাল, ১৫ ই মে, ২০১৮।

Monday, May 14, 2018

আদিবাসী সমর্থকের মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি বিজেপির।


আদিবাসী বলেই কি সম্ভব ? তৃনমূল কংগ্রেসের দেখানো পথে হেঁটেই আদিবাসী সমর্থকের মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি বিজেপির।

প্রশ্ন এটাই যে আদিবাসী বলে কি মৃতদেহেরও সন্মান থাকবে না? মৃত্যুর পরেও কি আদিবাসীকে রাজনীতির পুতুল হতে হবে? আর রাজনীতির মায়াজালে অন্ধ হয়ে আদিবাসী পরিবার অন্ধ হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের কথা অনুসরণ করবে? এ কোথায় চলেছে আদিবাসী সমাজ? এ কেমন উন্নয়ন হয়েছে আদিবাসী সমাজের?
পথ দেখিয়েছিল তৃনমূল কংগ্রেস। জঙ্গল মহল অশান্তির সময় হার্মাদ বাহিনীর হামলায় লালগড়ে নিহত আদিবাসীর মৃতদেহ নিয়ে খোদ রাইটার্স অভিযান হয়েছিল। সেই সময় তৃনমূল কংগ্রেসের আদিবাসী নেতারা বলেছিলেন যে মৃত আদিবাসীর নাকি সন্মান প্রাপ্তি হয়েছে। জীবিত অবস্থায় না হলেও মৃত অবস্থায় তিনি রাইটার্সে পৌঁছেছিলেন। আর আজ তৃনমূল কংগ্রেসের দেখানো পথেই হাঁটল বিজেপি। সোমবার পঞ্চায়েত ভোটের দিনে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ির বারিদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথের সামনে বিজেপি তাঁর আদিবাসী কর্মীর মৃতদেহ রেখে বিক্ষোভ দেখিয়ে সহানুভূতি ভোট আদায়ের অপচেষ্টা চালাল। ধিক এই রাজনীতি। রাজনীতি হোক, কিন্তু সন্মান রেখে। অন্তত মৃতদেহের সন্মান রেখে।
১৪ ই মে, ২০১৮ সোমবার সকাল ৭টায় পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ির বারিদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ভোটাররা দেখলেন, ভোটগ্রহণকেন্দ্রের সামনে রয়েছে মৃতদেহ। সে দেহ ঘিরে রয়েছে অনেকে। হাতে লাঠিসোটা।
প্রচারের শেষ দিনে মারধরে জখম হয়েছিলেন বিজেপি সমর্থক মনু হাঁসদা। রবিবার কটকের হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর পরই নিহত কোন দলের সমর্থক, তা নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক চাপানউতোর। এর জের গ়ড়াল সোমবারও। এই দিন ভোটগ্রহণকেন্দ্রের সামনে মনু হাঁসদার দেহ রেখে বিক্ষোভ দেখালেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। সঙ্গে ছিলেন নিহতের পরিবারের সদস্যেরা। বিক্ষোভের জেরে প্রথমে শুরুই হয়নি ভোট। প্রায় একঘণ্টা পর পুলিশের হস্তক্ষেপে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণকেন্দ্রের বাইরেই পড়েছিল দেহ। ওই অবস্থাতেই নিহতের পরিবারের সদস্যেরা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করলেন। তারপর দেহ নিয়ে গেলেন অন্তেষ্টির উদ্দেশ্যে।
ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের সামনে মৃতদেহ নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোয় বিজেপির বিরুদ্ধে দেহ নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ করেছে তৃণমূল। কেশিয়াড়ি ব্লক তৃণমূলের সভাপতি জগদীশ দাস বলেন, ‘‘মৃতদেহ না পুড়িয়ে নাটক করছে বিজেপি। ভয়ের সঞ্চার করে ভোট বন্ধ করে দেয় কিছুক্ষণ। আমরা পুলিশে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম।’’ বিজেপির উত্তর মণ্ডলের সভাপতি জগন্নাথ বসু কথায়, ‘‘প্রতিহিংসার রাজনীতি আমরা করি না। দেহ নিয়ে রাজনীতিও করি না। স্থানীয় আদিবাসীরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হওয়া মনুকে নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তবে ভোট বন্ধ থাকার কোনও ঘটনা ঘটেনি।” বারিদা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বাণেশ্বর মাইতি অবশ্য বলেন, ‘‘এসে দেখি ভোটকেন্দ্রের সামনে দেহ। প্রায় একঘণ্টা পর ভোট দিতে পেরেছি।”
বারিদা গ্রাম পঞ্চায়েতের বিজেপি প্রার্থী সুলোচনা মাহাতো এবং তাঁর স্বামী এ দিন ভোট শুরুর কিছুটা আগেই হাজির হয়েছিলেন ভোটগ্রহণকেন্দ্রে। তাঁদের অভিযোগ, তৃণমূলের কয়েকজন বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের মারধর করে। অভিযোগ বসতে দেওয়া হয়নি পোলিং এজেন্টদের। গ্রামে ঘিরে এ কথা জানান সুলোচনাদেবী। এরপরই মৃতদেহ নিয়ে বিজেপি সমর্থকেরা হাজির হন ভোটগ্রহণকেন্দ্রে। বিক্ষোভে সামিল বিজেপির মহিলা সমর্থকেরা বলেন, ‘‘অবিলম্বে মনু খুনে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে। অপরাধীরা বহাল তবিয়তে ঘুরছে। তাদের ধরার দাবিতে আমাদের বিক্ষোভ।” নিহতের ছেলে কার্তিকও বলেন, ‘‘বাবার খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতেই মৃতদেহ রেখে বিক্ষোভ দেখিয়েছি।”
বিজেপির পোলিং এজেন্টকে বসতে না দেওয়া, তাদের কর্মীদের মারধরের অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল। দেহ রাজনীতি নিয়েই বারবার সরব হয়েছে তারা।
নিহতের পরিবার জানিয়েছে, রবিবার রাত ১০টা নাগাদ কটক থেকে ফেরে দেহ। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় সকালে ভোট দেওয়ার পর দেহ সৎকার করা হবে। তবে সিদ্ধান্ত বদলে যায় অচিরেই। শ্মশান নয়। দেহ পৌঁছয় ভোটগ্রহণকেন্দ্রে।
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, বিশ্বসিন্ধু দে, ১৫ মে, ২০১৮।

Tuesday, May 8, 2018

জঙ্গলমহলে আদিবাসী উন্নয়নের নজির।


স্ত্রীর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে সৎকারের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে ৪ দিন লাগল আদিম আদিবাসী শবর যুবকের।

কাঁধে স্ত্রীর দেহ নিয়ে ১২ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন উড়িষ্যার দানা মাঝি। সেই ছবি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল৷ কিন্তু গরিব আদিবাসীদের জন্য যে ছবিটা পাল্টায়নি, তার প্রমাণ মিলল এই বাংলাতেই৷ গাড়ি ভাড়া করার টাকা নেই বলে বেলপাহাড়ির আদিম আদিবাসী শবর জাতির এক যুবক তাঁর স্ত্রীর দেহ চার দিন ফেলে রাখতে বাধ্য হলেন হাসপাতালের মর্গে৷ কোন সরকারী আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধির সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত এক আদিবাসী প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ১,৮০০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে দেওয়ায় ঝাড়গ্রামের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর দেহ নিয়ে বেলপাহাড়ির প্রত্যন্ত ধোবাকচা গ্রামে পৌঁছলেন আদিম আদিবাসী কানাই শবর৷ রাজ্য সরকারের সমব্যাথী প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনায় প্রশাসনিক গাফিলতিই সামনে এল৷
লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির ঝাড়গ্রাম জেলা সভাপতি খগেন্দ্রনাথ মান্ডি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি হাসপাতালে গিয়ে সুপারকে বলেছিলাম, একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিন, যাতে আদিম আদিবাসী কানাই শবর স্ত্রীর দেহ বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন৷ সুপার বলেছিলেন, দেহ পাঠানোর কোনও সরকারি ব্যবস্থা নেই৷ সেখানে তখন ঝাড়গ্রামের এসডিপিও দীপক সরকারও ছিলেন৷ তাঁকেও বললাম৷ কিন্তু গরিবের কথা কে শোনে? আমি সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। সংগঠনের সদস্যরা এই ঘটনায় কেউ জড়াতে চাননি। কানাই যাতে স্ত্রীর দেহ নিয়ে বাড়ি যেতে পারেন সে জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে বলেছিলাম ’
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা থেকে পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক, সকলের মন্তব্যেই স্পষ্ট, গরিব বলেই কেউ কানাই শবরের কথায় কান দেননি৷ বেলপাহাড়ির তৃণমূল বিধায়ক খগেন্দ্রনাথ হেমব্রম বলেন, ‘আমি ঝাড়গ্রামের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে বলেছিলাম৷ উনি বলেছিলেন, ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে বলে দেবেন?’ সুপার মলয়কুমার আদক ফোন না ধরায় তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি৷
মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অশ্বিনীকুমার মাঝির সাফাই, ‘এমএলএ বলায় আমি হাসপাতাল সুপারকে জানিয়েছিলাম৷ উনি বললেন, ‘মৃতের পরিবার গাড়ি ভাড়া করলে আমরা টাকা দিয়ে দেব৷ আমরা কোথায় গাড়ি খুঁজবো?’ তার পর আর খোঁজ নিইনি৷’
শিমূলপালের পঞ্চায়েত প্রধান লীলাবতী হাঁসদা বলেন, ‘ভোটের জন্য এখন অনেক সমস্যা৷ আমার কাছে ওঁরা আসেননি৷’ কানাই শবর কিন্তু বলেন, ‘আমার পরিবার প্রধানের কাছে গিয়েছিল৷ দেহ আনতে উনি কোনও সাহায্য করেননি৷’
কানাই শবরের মুশকিল আসান যিনি করলেন, সেই শ্রীকান্ত মুর্মু কিন্তু তাঁর আত্মীয়ও নন, সরকারি কর্তাও নন৷ ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা একজন শিক্ষক মাত্র৷ শ্রীকান্ত বলেন, ‘ওদলচুয়ার এক শিক্ষকের কাছে ঘটনাটি শুনে আজ হাসপাতালে এসে গাড়ি ভাড়া করে দিই৷’
ওদলচুলা থেকে ঝাড়গ্রাম এর দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার৷ সেখানে খবর পৌঁছতে পারে৷ ঝাড়গ্রামের সরকারি কর্তাদের কানে খবর পৌঁছয়নি৷
বেলপাহাড়ির ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক উত্তম মান্ডি কিন্তু ঘটনাটি জানেনই না৷ তিনি বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখব৷’
বেলপাহাড়ির শিমূলপাল পঞ্চায়েতের ধবাকাচার বাসিন্দা কানাই শবরের তরুণী স্ত্রী সুজিতা শবর (১৯) বাড়িতে রান্না করার সময় গত ২৫ এপ্রিল, ২০১৮ অগ্নিদগ্ধ হন। খাটিয়ায় চাপিয়ে কাঁধে করেই সুজিতাকে ওদলচুয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকেই অ্যাম্বুল্যান্সে সুজিতাকে আনা হয় ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। তাঁর স্বামী কানাই দিনমজুর। যৎসামান্য রোজগার। দুবেলা খাবারের সংস্থান করতেই টাকা ফুরিয়ে যায় তাঁর।
ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল সূত্রের খবর, গত ২ মে সকালে সুজিতার মৃত্যু হয়। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে পুলিশ। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পরে দেহ ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশ মর্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। স্ত্রীর মৃতদেহ পেতে এর পর হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে ঘুরতে থাকেন কানাই। তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে তাঁকে বলা হয়েছিল, মর্গের বিষয়টি প্রশাসন দেখে। শবর সংগঠনের নেতাদের দ্বারস্থ হন কানাই। কিন্তু আগুনে পোড়া ঘটনায় জড়াতে চাননি কেউই। পুলিশ জানিয়ে দেয়, বেলপাহাড়ির কদলবনি গ্রাম থেকে সুজিতার বাপের বাড়ির তরফে কেউ এলে মৃতদেহ ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো টাকাও ছিল না কানাইয়ের কাছে। শেষে খবর পেয়ে শুক্রবার সুজাতার দাদা বাবুলাল শবর লিখিত আবেদন করায় কানাই দেহ পেয়ে যান।
কিন্তু দেহ নিয়ে যাবেন কী ভাবে? টাকা নেই তো! তাই হাসপাতাল চত্বরেই পড়েছিল দেহ। অবশেষে বেলপাহাড়ির লালজল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীকান্ত মুর্মু বিষয়টি জানতে পেরে রবিবার এগিয়ে আসেন। আরও কয়েক জন সহৃদয় ঝাড়গ্রাম শহরবাসীর উদ্যোগে গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া হয়। স্ত্রীর দেহ নিয়ে ফিরে যান কানাই। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা গরিব মানুষ। কী ভাবে দেহ পেতে হয়, সেটা জানতেই তিন দিন লাগল।”
আদিম আদিবাসী শবরদের জন্য সরকারি স্তরে নানা ধরনের সহযোগিতার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে ‘সমব্যথীপ্রকল্প। তা হলে? ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসক (সাধারণ) নকুলচন্দ্র মাহাতো বলেন, “ কেউ ওই ঘটনার কথা আমাকে জানাননি। পরিবারটিকে সাহায্যের ব্যবস্থা করা হবে।” বেলপাহাড়ির বিডিও সন্তু তরফদারের বক্তব্য, “ওই মহিলার পারলৌকিক কাজের জন্য সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে।
সৌজন্য – এই সময় ও আনন্দবাজার পত্রিকা, ০৭ ই মে ২০১৮।