২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকে, তামিলনাড়ুতে,
অন্ধ্রপ্রদেশে, মহারাষ্ট্র জুড়ে রাবণবধ
বা রাবণপোড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করছে আদিবাসী দলিত বহুজন সংগঠন ‘ভীম দল’। দশেরার অনুষ্ঠান নয়,
রাবণবধ বন্ধ হোক, এটাই মূল
বক্তব্য। সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জমা পড়ে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য। তাতে কারণ
হিসেবে বলা হয় আদিবাসী বহুজন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করার কথা। অসংখ্য
আদিবাসী জনজাতির (মূলত দক্ষিণ ভারত আর মহারাষ্ট্রে) আরাধ্য দেবতা রাবণ। কর্নাটকের
বহু মন্দিরে শিবলিঙ্গের পাশাপাশি উপাসনা করা হয় দশানন রাবণমূর্তিকেও। তাই
এসসি/এসটি অ্যাক্টের অধীনে দায়ের হয় আর্জি। আর্জি খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
সংবিধানের ২৬ ধারার আড়ালে জানিয়ে দেয় তারা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
কারণ ২৬ ধারা অনুসারে,
কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ সংবিধান
বহির্ভূত। শবরীমালা রায়ের মতো ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রে ঘটে না, রাবণবধের মামলার ক্ষেত্রেও ঘটেনি।
রাবণবধ বা রাবণপোড়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনাও শুরু হয় বহু দিন আগে।
১৯৯১ সাল নাগাদ,
রাম জন্মভূমি বিবাদের কাছাকাছি সময় রাবণবধের বিরোধিতা এবং
রাবণ আরাধনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। স্থান: পারাসওয়ারি, গড়চিরৌলি,
অমরাবতী। রাজ্য: মহারাষ্ট্র। শুধু মহারাষ্ট্রে নয়, কর্নাটক,
তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলেই আদিবাসী গোন্ড উপজাতির বসবাস, যাদের আরাধ্য দেবতা রাবণ। শুধু আরাধ্য দেবতাই নয়, তাদের নামের উপাধিতেও ‘রাবণ’
যুক্ত থাকে। তারা তাদের এই প্রথা নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে
বিযুক্ত ছিল,
কিছু সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া।
১৯৯১ সাল,
রাম-রাজনীতির উন্মেষ ও গোন্ড উপজাতির সঙ্গে সংঘাত। ‘গোন্ডোয়ানা গোন্ড সংস্কৃতি বাঁচাও সমিতি’ (জিজিবিএস)
কেন্দ্রের ধর্মীয় সম্মেলন ‘রাবণ বিজয়’-এ (নাগপুরে),
সরাসরি আক্রমণ করে আরএসএস। প্রতিবাদে গড়চিরৌলি অঞ্চলের
অধিবাসীরা আন্দোলন করে। এমনকি নিজেদের নামে কোথাও ‘রাম’
শব্দাংশের উল্লেখ থাকলে তার পরিবর্তন করে ফেলেন তৎক্ষণাৎ।
যেমন মোতি ‘রাম’
কানগালের নাম হয়ে যায় মোতি‘রাবণ’
কানগালে। কানগালে, মণিরাবণ দুগার
মতো বহু মানুষ আজও চেষ্টা করছেন গোন্ড সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার।
পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে ধর্মীয় জয় পাওয়ার জন্য আরএসএস শুরু করে অসংখ্য ‘একল বিদ্যালয়’। রাবণ উপাসনার প্রথাকে ত্যাগ করে, রামকে দেবতা রূপে
গ্রহণ করতে হবে,
এমন বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা, যেখানে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নামে নিয়ে আসা হয় আদিবাসী গোন্ড উপজাতির
কিশোরদের। এখন গড়চিরৌলিতে প্রায় ১৫০টা একল বিদ্যালয় আছে, এবং গোন্ড ‘ঘোটুল’
বিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা প্রায় শূন্য। এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত
আন্দোলন করে চলেছেন অনেকে,
যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিরা সাথিদার, যাঁকে সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে ২০১৬-র ‘কোর্ট’
চলচ্চিত্রে। প্রায় চব্বিশ বছর ধরে ‘রাবণ উৎসব’
আয়োজন করছেন তিনি। তাঁর ছেলের নামও রাবণ। এই আন্দোলন মূলত
অহিংস, নানা অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কোনও ধ্বংসের পথে যায় না। তাই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এই আন্দোলনের খবর
স্থান পায় না।
রাবণ এক প্রতীক। অশুভ শক্তির বিনাশের নয় — প্রতিবাদের, এক বিকল্প শক্তির প্রতীক। যেমন ‘ভীম দল’-এর চন্দ্রশেখর,
যেমন মোতিরাবণ কানগালে, যেমনটা বিরা
সাথিদার। আরও দলিত উপজাতির মুখ, যাঁরা আর্য আগ্রাসনের
সামনে মাথা তুলতে চাইছেন।
সৌজন্য
স্বীকার – আনন্দবাজার পত্রিকা, ঈশা দাশগুপ্ত, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮।
No comments:
Post a Comment