Wednesday, October 31, 2018

আদিবাসীদের জমি দখল করে সর্দার প্যাটেলের মূর্তি নির্মাণের তীব্র প্রতিবাদে গুজরাটের আদিবাসীরা।


গুজরাটে আদিবাসীদের জমি দখল করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি স্থাপন নিয়ে আদিবাসীদের তীব্র ক্ষোভের মুখে বিজেপি সরকার, ছিঁড়ে ফেলা হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোস্টার।

৩১ অক্টোবর, ২০১৮ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৪৩ তম জন্মদিন৷ এদিনই গুজরাটের নর্মদা জেলায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মূর্তি ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’র উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ উপস্থিত থাকবেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিও৷ প্রথম থেকেই এই মূর্তি নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছেন ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা৷ উদ্বোধনের আগে সেই আন্দোলনের তেজ আরও প্রবল করার ইঙ্গিত দিল আদিবাসী সমাজ৷ ছেঁড়া হল প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর সমস্ত পোস্টার৷
জানা গিয়েছে, প্রায় নব্বই শতাংশ পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়৷ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, আবার নতুন করে পোস্টার লাগাতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের৷ বসানো হয়েছে পুলিশি প্রহরা৷ এলাকায় টহল দিচ্ছে বিশাল পুলিশবাহিনী৷ স্থানীয় এক আদিবাসী নেতা জানান, এই ঘটনাই প্রমাণ করে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের উপর কতটা বিক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে আদিবাসী সমাজ৷ এই মূর্তি নির্মাণের ফলে আদিবাসীদের জীবিকা বিপন্ন হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি৷ এই আদিবাসী নেতার দাবি, ভাদোদরা থেকে একশো কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটা অঞ্চলে এই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছে বিজেপি সরকার৷ এই ফলে চরম বিপদের মুখে পড়েছে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় ৭৫ হাজার আদিবাসীর জীবন৷
ওই আদিবাসী নেতার কটাক্ষ, বিশ্বে এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রীর পোস্টার রক্ষার্থে পুলিশকে পাহারায় বসতে হয়েছে৷ তিনি জানান, শুরু থেকেই নর্মদা জেলার আদিবাসীরা এই মূর্তি নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিল৷ তবে এবার রাজ্যের সমগ্র আদিবাসী সমাজ ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’ প্রকল্পের বিরোধী৷ সূত্রের খবর, ৩১ অক্টোবর, ২০১৮ রাজ্যেজুড়ে বনধ পালনও করতে পারে ছোট-বড় শ’খানেক আদিবাসী সম্প্রদায়৷ রয়েছে উপবাসের পরিকল্পনাও৷ প্রভাব পড়তে পারে ন’টি জেলার ৭৫টি গ্রামে৷ আদিবাসী সমাজের একাংশের দাবি, গুজরাটের মহান সন্তান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তির বিরোধিতা করছেন না তাঁরা৷ কিন্তু তাঁদের জীবন ও জীবিকা হাতছাড়া হওয়ায় সরকার বিরোধী ক্ষোভ জমেছে তাঁদের মনে৷
গুজরাটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হোর্ডিং পাহারা দিচ্ছে রাজ্য পুলিশ! পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেওয়া ব্যানার প্রহরায় মোতায়েন পুলিশকর্মীরা। শুধু তাই নয়, আদিবাসীদের ক্ষোভ থেকে হোর্ডিং বাঁচাতে ছবিতে বিরাট আকারের বিরসা মুন্ডার ছবি দেওয়া হয়েছে। তার নিচে প্রধানমন্ত্রীকে বসানো হয়েছে। হই হুল্লোড় করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল মূর্তি উদ্বোধনের বন্দোবস্ত করলেও স্থানীয় আদিবাসীদের পাশাপাশি কৃষকদের ক্ষোভের মুখেও পড়তে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর বাহিনীকে।
নর্মদা বাঁধের কাছেই দাঁড়িয়ে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বিশালাকার মূর্তি। ১৮২ মিটার উচ্চতার এই মূর্তি বুধবার ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৮ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার আগে ব্যানার, হোর্ডিং, পোস্টারে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা রাজ্য। বাদ যায়নি নর্মদা জেলাও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই হোর্ডিংয়ে রয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানির ছবিও। সম্প্রতি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রী ফলাও করে এর প্রচার করেছেন। উদাহরণ দিয়ে দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন দুনিয়ার সবথেকে বড় মূর্তি হয়েছে এটিই। ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে এমন একটি মূর্তি নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন প্রধানমন্ত্রী এটিকে বিরাট সাফল্য হিসাবে দেখাতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
যদিও ভিটে মাটি হারানো আদিবাসীরা এইসব কথায় ভুলছেন না। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের এই মূর্তি নির্মাণের জন্য আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেয় রাজ্যের বিজেপি সরকার। মেলেনি পর্যাপ্ত পুনর্বাসনও। কমপক্ষে ৭৫ হাজার আদিবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, হারিয়েছেন জমি। ঘটা করে সেই মূর্তি উদ্বোধনের ব্যবস্থা করা হলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আদিবাসীরা। জেলাজুড়ে অধিকাংশ হোর্ডিংয়ে কালো কালি লাগিয়েছেন বা ছিঁড়ে ফেলেছেন তাঁরা, অভিযোগ এমনই। এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গিয়েছে, ৯০ শতাংশ পোস্টার-হোর্ডিংই হয় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে নয়ত কালো কালি লেপে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ আদিবাসীরা। সংলগ্ন ২২টি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানরা একটি চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় লিখেছেন, ‘এই জঙ্গল, নদী, ঝরনা, জিম এবং কৃষি আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম সমর্থন দিয়ে চলেছে। আমরা এর উপরে ভিত্তি করেই বেঁচে আছি। কিন্তু সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া হলো এবং উৎসব করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আপনার মনে হচ্ছে না এটা কারোর মৃত্যুতে উৎসব করা হচ্ছে? আমাদের তেমনই মনে হচ্ছে।’ এইরকম একটি এলাকার গ্রামগুলিতে এখনও স্কুল, হাসপাতাল,পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। অথচ ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে অর্থহীন মূর্তি তৈরি করা হলো। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সর্দার প্যাটেল যদি প্রাকৃতিক সম্পদের এই ব্যাপক ধ্বংস এবং আমাদের উপর এই অবিচার দেখতেন, তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। আমরা যখন এই সব কথা বলতে গেছি, তখন আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ চিঠিতে স্পষ্ট করে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছে, আমাদের এখানে আপনি অনাহূত অতিথি। বুধবার বন্‌ধ ডেকেছে ছোট-বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ১০০টি আদিবাসী সংগঠন। বনসকণ্ঠ থেকে ডাঙ, ৯টি জেলায় হবে বন্‌ধ। ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’র উন্মোচনের দিনে ডাকা এই বন্‌ধ স্কুল, কলেজ, অফিস বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এই প্রকল্পের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত ৭২টি গ্রামের কোনও বাড়িতে রান্না হবে না বলেও জানিয়েছেন এই আদিবাসী নেতা। প্রথা অনুযায়ী, আদিবাসীদের গ্রামে কারও মৃত্যু হলে শোক জানিয়ে বন্ধ থাকে রান্না। ক্ষুব্ধ আদিবাসীরা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার পর তড়িঘড়ি ফের নতুন পোস্টার বানিয়ে ফেলেছেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব। কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে বিরসা মুন্ডার ছবি দিয়ে এবার বানানো হয়েছে হোর্ডিং। যাতে আর আদিবাসীরা তা নষ্ট করতে না পারেন এবং পাহারায় রয়েছে পুলিশকর্মীরা।
এদিকে, সংখেদায় ১১ বছর আগে ছিল ‘সর্দার সুগার মিল’। চিনি কলেরই বোর্ড সদস্যদের আর্থিক গন্ডগোলের জেরে বন্ধ হয়ে যায় সেটি। সেই সময় থেকে ছোটা উদেপুর, পঞ্চমহল, ভদোদরা এবং নর্মদা — এই চার জেলার ১৫০০ কৃষক নিজেদের বকেয়া পাওনার জন্য দিন গুনছেন। এই সমস্ত কৃষক প্রায় ২ লক্ষ ৬২ হাজার টন আখ বিক্রি করেছিলেন ওই চিনিকলে। ১২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে তাঁদের। বহুবার সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েও মেলেনি অর্থ। এবার তাঁরাও নামছেন প্রতিবাদে। বুধবার, মূর্তি উদ্বোধনের দিন জলে ডুবে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছেন এই কৃষকরা। ‘এই মূর্তি আমাদের কাছে কিছুই নয়। সরকারের ঔদাসীন্যে কৃষকরা এখনও দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ‘১১ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছি’ ক্ষোভ-হতাশা মিলিয়ে বলেছেন কৌশিক প্যাটেল। তিনি ৩৮৯.৭৩ টন আখ বিক্রি করেছিলেন চিনিকলে। পাবেন ২ লক্ষ ১৮ হাজার টাকা। প্রসঙ্গত, বুধবার পালটা ‘একতা যাত্রা’র আয়োজন করেছে রাজ্যের বিজেপি সরকার।
সৌজন্য – সংবাদ প্রতিদিন (২৮/১০/২০১৮), টিডিএন বাংলা (৩০/১০/২০১৮)

Monday, October 29, 2018

মাওবাদীদের হাতে নিহত ও নিখোঁজদের পরিবারের চাকরির দাবিতে থালা হাতে ঝাড়গ্রামে পথ অবরোধ।


মাওবাদী হানায় নিহত ও নিখোঁজদের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া সহ ১০ দফা দাবিতে ফের আন্দোলনে নামলেন তাঁদের পরিবারের লোকজন। গত সোমবার ২৯/১০/২০১৮ ঝাড়গ্রাম শহরের পাঁচমাথা মোড়ে ও জেলাশাসকের অফিসের সামনে তাঁরা অবস্থান বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি, যারা বন্দুক ধরেছে, তারা চাকরি পেয়েছে। আর যারা খুন হল, তাদের পরিবারের কেউ চাকরি পেল না। মাওবাদী হানায় নিহত ও নিখোঁজ পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের মৃত ঘোষণা করতে হবে। এই দাবিতে এদিন খালি থালা হাতে ঝাড়গ্রাম শহরে মিছিল ও পাঁচমাথা মোড়ে পথ অবরোধও করেন তাঁরা। অবরোধের পর জেলাশাসকের অফিস যাওয়ার পথে পুলিসের প্রথম ব্যারিকেড ভেঙে দেন তাঁরা। দ্বিতীয় ব্যারিকেড ভাঙার সময় মহিলাদের সঙ্গে পুলিসের ধস্তাধস্তি হয়। পরে জেলাশাসকের অফিসের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ করেন তাঁরা।
এদিন সকালে শহরে হাতে প্ল্যাকার্ড ও ফ্লেক্স ও ফেস্টুন নিয়ে মিছিল শুরু হয়। ওই মিছিলে নিহত ও নিখোঁজ পরিবারের কয়েকশো সদস্য ছিলেন। তবে অধিকাংশই ছিলেন মহিলারা। অনেক মহিলা সাদা শাড়ি পরে মিছিলে হাঁটেন। পাঁচমাথা মোড়ে ২০ মিনিট পথ অবরোধ করেন। সেখানে মহিলারা খালি থালা নিয়ে বসে পড়েন। একটি স্মরণসভাও হয়। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবরোধের জেরে যানজট তৈরি হয়।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই এই ইস্যুতে তাঁরা শহিদ ও নিখোঁজ পরিবারের যৌথমঞ্চ গঠন করেছেন। জানা গিয়েছে, ঝাড়গ্রাম জেলায় মাওবাদীদের হাতে ৪১৫ জন নিহত হয়েছেন। ৭৮ জন নিখোঁজ রয়েছেন। প্রায় ১০০ জন আহত রয়েছেন। পরিবারের অভিযোগ, ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মাওবাদীদের হাতে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই কিছু পাননি। অথচ যেসব মাওবাদী খুন করেছে, তারা এখন চাকরি পেয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। গত জুন মাসে ঝাড়গ্রামে মিছিল করে এই মঞ্চ জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিল। কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি বলে অভিযোগ।
শহিদ ও নিখোঁজ পরিবারের যৌথমঞ্চের সম্পাদক শুভঙ্কর মণ্ডল বলেন, ২০১২ সালে মুখ্যমন্ত্রী বেলপাহাড়িতে জানিয়েছিলেন মাওবাদী হানায় যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। চাকরি না পেলে শেষ পর্যন্ত আমাদের বন্দুক ধরতে হবে। এক মাসের মধ্যে সুরাহা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হবে।
ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আয়েষা রানি এ বলেন, আমরা সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি দেখছি। আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। আমরা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিখোঁজদের ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
সৌজন্য – বর্তমান পত্রিকা, ৩০/১০/২০১৮।

বাঁকুড়া জেলার রাণীবাঁধে করম পুজোয় মাতলেন আদিবাসী ও কুড়মি সম্প্রদায়।


গত বৃহস্পতিবার ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধে আদিবাসী ও কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষজন করম পুজোয় মাতলেন। রানিবাঁধের অম্বিকানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের চিরকুনকানালি গ্রামে আদিবাসী ও কুড়মি সম্প্রদায়ের এই বিশেষ পরব অনুষ্ঠিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে চিরকুনকানালি গ্রাম ছাড়াও পাশাপাশি ভালুকা, বুড়িশোল, বাগডুবি, মৌকানালি সহ বেশকিছু গ্রামের বাসিন্দারা অংশ নেন। এদিন দুপুর ১২টা থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশেষ করম নৃত্যের মাধ্যমে এবং পুজো করে শস্যের দেবতা অর্থাৎ লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়।
কুড়মি, সাঁওতাল, লোধা, ভূমিজ সহ বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতি ও উপজাতির মানুষজন শস্যের দেবতার আহ্বানে মেতে ওঠেন। তাঁদের কথায়, যাতে কারও ঘরে কখনও খাবারের অভাব না থাকে সেই কারণেই শস্যের উপাসনা করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সদস্য চিত্ত মাহাত বলেন, যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহু আগে থেকেই এই অনুষ্ঠান আদিবাসী জনজাতিগুলির মধ্যে চলে আসছে। যাতে কোনওদিন খাদ্যের অভাব না হয় সেই জন্যই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শস্যের দেবতাকে সন্তুষ্ট করা হয়।
বৃহস্পতিবার রানিবাঁধের ওই গ্রামটিতে অনুষ্ঠান ঘিরে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি গ্রামগুলি থেকে কাতারে কাতারে মানুষজন এসে ভিড় জমিয়েছিলেন। সেখানে পুজো শুরুর আগে ধামসা মাদলের তালে তালে বহু আদিবাসী মানুষজন করম নৃত্যে মেতে ওঠেন। অম্বিকানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান অঞ্জলি বাস্কে বলেন, করম পরব আমাদের দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা সংস্কৃতিকে পরম্পরাগত ভাবে ধরে রেখেছি।
সৌজন্য স্বীকার – বর্তমান পত্রিকা।

রাবণবধ বা রাবণপোড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে আদিবাসী দলিত সম্প্রদায়।

২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকে, তামিলনাড়ুতে, অন্ধ্রপ্রদেশে, মহারাষ্ট্র জুড়ে রাবণবধ বা রাবণপোড়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করছে আদিবাসী দলিত বহুজন সংগঠন ভীম দলদশেরার অনুষ্ঠান নয়, রাবণবধ বন্ধ হোক, এটাই মূল বক্তব্য। সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জমা পড়ে এই প্রথা বন্ধ করার জন্য। তাতে কারণ হিসেবে বলা হয় আদিবাসী বহুজন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে আঘাত করার কথা। অসংখ্য আদিবাসী জনজাতির (মূলত দক্ষিণ ভারত আর মহারাষ্ট্রে) আরাধ্য দেবতা রাবণ। কর্নাটকের বহু মন্দিরে শিবলিঙ্গের পাশাপাশি উপাসনা করা হয় দশানন রাবণমূর্তিকেও। তাই এসসি/এসটি অ্যাক্টের অধীনে দায়ের হয় আর্জি। আর্জি খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধানের ২৬ ধারার আড়ালে জানিয়ে দেয় তারা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কারণ ২৬ ধারা অনুসারে, কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ সংবিধান বহির্ভূত। শবরীমালা রায়ের মতো ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রে ঘটে না, রাবণবধের মামলার ক্ষেত্রেও ঘটেনি।
রাবণবধ বা রাবণপোড়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনাও শুরু হয় বহু দিন আগে। ১৯৯১ সাল নাগাদ, রাম জন্মভূমি বিবাদের কাছাকাছি সময় রাবণবধের বিরোধিতা এবং রাবণ আরাধনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। স্থান: পারাসওয়ারি, গড়চিরৌলি, অমরাবতী। রাজ্য: মহারাষ্ট্র। শুধু মহারাষ্ট্রে নয়, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চলেই আদিবাসী গোন্ড উপজাতির বসবাস, যাদের আরাধ্য দেবতা রাবণ। শুধু আরাধ্য দেবতাই নয়, তাদের নামের উপাধিতেও রাবণযুক্ত থাকে। তারা তাদের এই প্রথা নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে বিযুক্ত ছিল, কিছু সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া।
১৯৯১ সাল, রাম-রাজনীতির উন্মেষ ও গোন্ড উপজাতির সঙ্গে সংঘাত। গোন্ডোয়ানা গোন্ড সংস্কৃতি বাঁচাও সমিতি’ (জিজিবিএস) কেন্দ্রের ধর্মীয় সম্মেলন রাবণ বিজয়’-এ (নাগপুরে), সরাসরি আক্রমণ করে আরএসএস। প্রতিবাদে গড়চিরৌলি অঞ্চলের অধিবাসীরা আন্দোলন করে। এমনকি নিজেদের নামে কোথাও রামশব্দাংশের উল্লেখ থাকলে তার পরিবর্তন করে ফেলেন তৎক্ষণাৎ। যেমন মোতি রামকানগালের নাম হয়ে যায় মোতিরাবণকানগালে। কানগালে, মণিরাবণ দুগার মতো বহু মানুষ আজও চেষ্টা করছেন গোন্ড সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার।
পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে ধর্মীয় জয় পাওয়ার জন্য আরএসএস শুরু করে অসংখ্য একল বিদ্যালয়রাবণ উপাসনার প্রথাকে ত্যাগ করে, রামকে দেবতা রূপে গ্রহণ করতে হবে, এমন বাধ্যতামূলক শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা, যেখানে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার নামে নিয়ে আসা হয় আদিবাসী গোন্ড উপজাতির কিশোরদের। এখন গড়চিরৌলিতে প্রায় ১৫০টা একল বিদ্যালয় আছে, এবং গোন্ড ঘোটুলবিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা প্রায় শূন্য। এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন করে চলেছেন অনেকে, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিরা সাথিদার, যাঁকে সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে ২০১৬-র কোর্টচলচ্চিত্রে। প্রায় চব্বিশ বছর ধরে রাবণ উৎসবআয়োজন করছেন তিনি। তাঁর ছেলের নামও রাবণ। এই আন্দোলন মূলত অহিংস, নানা অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কোনও ধ্বংসের পথে যায় না। তাই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় এই আন্দোলনের খবর স্থান পায় না।
রাবণ এক প্রতীক। অশুভ শক্তির বিনাশের নয় প্রতিবাদের, এক বিকল্প শক্তির প্রতীক। যেমন ভীম দল’-এর চন্দ্রশেখর, যেমন মোতিরাবণ কানগালে, যেমনটা বিরা সাথিদার। আরও দলিত উপজাতির মুখ, যাঁরা আর্য আগ্রাসনের সামনে মাথা তুলতে চাইছেন।
সৌজন্য স্বীকার – আনন্দবাজার পত্রিকা, ঈশা দাশগুপ্ত, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮। 

Friday, October 19, 2018

মহিষাসুর ও হুদুড় দুর্গা কি একেই ব্যক্তি ?





প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে, কলকাতা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে পশ্চিমবাংলার বুকে দুর্গাপুজোকে ঘিরেই এক অন্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। পুরুলিয়া জেলার এক অখ্যাত গ্রামে আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে, নিজেদের আত্মপরিচয় তুলে ধরতে, নিজেদের মর্যাদাকে মান্যতা দিতে এই দেশের ভূমিপূত্র খেরওয়াল আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠান “দিশম খেরওয়াল বীর কালচার কমিটি”-র পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় হুদুড় দুর্গা (মহিষাসুর) স্মরণ দিবস। ২০১১ সাল সেটা। সোনাইজুড়ি গ্রামে (কাশীপুর থানার অন্তর্গত) এক তরুণ অজিতপ্রসাদ হেমব্রম এবং তাঁর সহকারী চারিয়ান মাহাতোর উদ্যোগে ঘটে এই পুজো। নিজেদের সংস্কৃতির মৌখিক উপাদানকে সংগ্রহ করেই চারিয়ান মাহাতোর কলম থেকে শহিদ স্মরণ দিবসকে উপলক্ষ করে একটি তীক্ষ্ণ রচনা বেরিয়ে আসে স্থানীয় একটি পত্রিকায়। সে লেখার নাম ছিল হুদুড় দুর্গা
কাজটা সহজ ছিল না। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনেক চাপ, এমনকি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়েছিল এই দুই তরুণকে। আশ্চর্য নয়, সোনাইজুড়িতে সে দিন যে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল তা আজ ঢুকে পড়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও। তার ঢেউ থেকে বাদ যায়নি সংসদও। গত বছর সংসদে মহিষাসুরবিতর্কের কথা কম বেশি সকলেই আমরা শুনেছি।
কে এই হুদুড় দুর্গা’? কী জন্যই বা এই হুদুড় দুর্গা স্মরণ দিবসের আয়োজন? কেন হঠাৎ করে এর প্রচার বা প্রসার? এত তাড়াতাড়ি এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লই বা কেন?
আসলে হুদুড়কথার অর্থ বজ্রের মতো তেজ বা শক্তি যার।আর দুর্গার অর্থ? ‘দুর্গ রক্ষা করেন যিনি। এই দেশের ভূমিপূত্রদের কাছে হুদুড় দুর্গা এক জনপ্রিয় শাসক, প্রজাদের রক্ষাকর্তা, তাদের কল্যান চিন্তক। অনেকেই তাকে আবার মহিষাসুর বলে চিহ্নিত করেন। যে অসুরের বিনাশ চান আমাদের উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। আমরা অনেকেই জানি না যে অসুরনামে বাস্তবে এক উপজাতি আমাদের ‍দেশে এখনও আছে। তারা এখনও ঝাড়খণ্ডের কিছু অঞ্চলে এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা। মহীশূরের বিভিন্ন জায়গাতেও শহর থেকে দূরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বসবাস করে তারা। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই অসুর জাতির সদস্য সংখ্যা ৪০০০-এর কিছু বেশি। এমনকি আলিপুরদুয়ারে একটা আস্ত গ্রামের নামই অসুর গ্রাম। অতি আশ্চর্য এবং একই সঙ্গে দুঃখের বিষয়, ‍বিখ্যাত মণ্ডল কমিশন রিপোর্টে প্রকাশিত যে তফশিলি জনজাতিদের তালিকা আছে, তার প্রথম জনজাতিই অসুর’, অথচ এ কথা এত কম লোক জানেন।
লোককথা অনুসারে, এই অসুর জাতি তাদের মহান রাজা মহিষাসুরবা ঘোরাসুর -এর‍ অন্যায় নিধন মেনে নিতে পারেনি। নিরীহ আদিম অধিবাসীদের উপর বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ নেমে আসে। আদিবাসীদের বসবাস করার জায়গা ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করা চাষের জমি তারা দখল ক‍রে নিতে এসেছিল। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বহিরাগত আর্যশক্তি দৈহিক দিক থেকে বলীয়ান না হলেও বুদ্ধির দিক থেকে ছিল অনেক বেশি উন্নত। তাই বার বার যুদ্ধ করেও যখন তারা আদিম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারল না, তখন কূটকৌশল প্রয়োগ করে তারা জয়লাভ করে। বীরের যুদ্ধ থেকে সরে এসে তারা ভূমিপুত্রদের দুর্বল জায়গাটি অবশেষে খুঁজে বার করে। দেখে যে, আদিম জাতির সমাজে মহিলাদের স্থান অনেক উপরে; তারা সম্মাননীয়া, তারা পূজিতা। (আজকের দিনেও খেড়ওয়াল আদিবাসী যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা বা ওরাওঁ জনজাতিদের মধ্যে পণপ্রথা প্রচলিত নেইতাদের বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে গিয়ে নিজেরাই রান্না করে খায়।) আর্যরা তাই মহান বীর মহিষাসুর বা ঘোরাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক নারীকে প্রেরণ করেছিল। তারা ভাল ভাবেই জানত, আদিম জনজাতিদের প্রথা অনুযায়ী মহিষাসুর কখনওই নারী বা শিশুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। সুযোগ বুঝে তাই সেই নারীকে কান্ডারি করে অনার্যদের মহান নেতা মহিষাসুর এবং এখানকার ভূমিপূত্রদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে তারা। এই রকম অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক দিন ভূমিপুত্র আদিবাসী খেড়ওয়ালরা তাদের ক্ষমতা হারায়, যে দুঃখ আজও তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালি উচ্চবর্ণীয় নাগরিক সমাজ যখন দুর্গাপূজায় মেতে থাকে, অসুরদের বিনাশ চায়, আলিপুরদুয়ারে অসুর প্রজাতির লোকেরা নিজেদের কুঠুরিতে আবদ্ধ রাখে পূজার কয়েকটা দিন।
অন্য দিক দিয়ে ভাবতে গেলে বোঝা যায়, যে মহিষাসুর ওতপ্রোত ভাবে মহিষের সঙ্গে জড়িত (মহিষকেই মহিষাসুরের বাহন হিসেবে দেখানো হয়), গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্য জাতির কাছে সে খুব আপন হবেই। তাই দুর্গাপূজার পনেরো দিন পরেই আদিম অধিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পূজা বা বন্দনা হয়। ভাবতে অসুবিধা হয় না, কেন গ্রামবাংলাতে আদিবাসীদের কাছে মহিষাসুর নায়ক হতে পারেন।
উল্টো দিকে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ বা আর্য সমাজে অসুর জাতি মানেই‍ অ-সভ্যজাতি। অভিনব বাংলা অভিধানে সাঁওতালশব্দের অর্থও এই ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে সাঁওতাল পরগনার আদিম অধিবাসী; অসভ্য জাতিবিশেষ। যে দুর্গাকে কেন্দ্র করে এত ধুমধাম, তিনিই বা কে? অসভ্য জাতি বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদের সমাজে দুর্গা নামে কোনও মহিলা নেই। দুর্গাকে তারা পুংলিঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করে, এবং তাদের ছেলেদের নামকরণ করা হয় দুর্গা নামে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই জাতির লোকেরা তাদের নায়ক মহিষাসুরকেই হুদুড় দুর্গাবলে ডাকে।
এই যে বিচিত্র ঐতিহ্য আমাদের রাজ্যেরই সংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ কি কোনও দিন তার কথা শুনতে চায়? না। এই সব সংস্কৃতিকে দমিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা চলছে সেই আদিকাল থেকেই। বৈচিত্রের মধ্যে একতাইত্যাদি আমরা মুখে বলি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচিত্রতার ধারা আমরা রক্ষা করে চলি না, এমনকি তাদের ন্যূনতম সম্মানও রক্ষা করি না। কে বলতে পারে এই বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা বা তাদের কথা না-শোনার ফলেই উল্টো দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, হিংসাবাদী ইত্যাদির উত্থান হয়নি? ছত্তীসগঢ়ে তো আজও মাওবাদী দমনের নামে চলে আসছে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন।
নাগরিক সমাজ যখন তাদের শারদীয়া পূজায় আনন্দে মাতে, তখন তাই দুর্গার এই অন্য ঐতিহ্যটিও স্মরণে রাখা জরুরি। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে জয়ধ্বনি দিয়ে, এবং তাকে উপলক্ষ করে অসুরনামক একটা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বুকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ না করাটা জরুরি। আদিম অধিবাসীরা হয়তো বলবেন, আপনাদের শারদীয়ার আনন্দ আমরা কেড়ে নিতে চাই না, কেবল পদতল থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক আমাদের মহান নেতা মহিষাসুরকে। প্রসঙ্গত, আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত খেড়ওয়াল আদিবাসীর (মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতি) পুরুষরা সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে দাঁশাই নাচ’-এর ‍মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস করে। তাদের হায় রে! হায় রে!আর্তনাদে, তাদের মহান নায়কের বীরগাথার মধ্যেই হয়তো প্রকাশিত হয় মানুষ হিসেবে তাদের নিজেদের সুগভীর বঞ্চনা ও অবহেলার ক্ষোভ!
গণতান্ত্রিক দেশে যে আজও আদিবাসী মানুষ তাদের নিজেদের সংস্কৃতির মর্যাদা না পেয়ে ক্ষুব্ধ, এ আমাদের দেশেরই লজ্জা। সংবিধানিক অধিকার তাদেরও জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু মানবিক মর্যাদা তারা এখনও পায়নি, এই এক মহিষাসুর বৃত্তান্ত থেকেই তা বোঝা সম্ভব। আমরা যেখানে সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে থাকার গর্বে আটখানা, সেখানে আমরা কি পারি না, আমাদের পার্বণের নামে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আঘাত না করতে? তাদের কোনও ভাবে অপমান বা অসম্মান না করতে? যদি পারতাম, আমাদের পার্বণই হয়তো শুদ্ধতর হতে পারত। আরও শুভও হতে পারত।
আজও মহিষ রাজার এলাকা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের লাতেহার জেলার নেতারহাট শহর সংলগ্ন গ্রাম ঝোবিপাট, বরপাট, চারুয়াপাটে মহিষাসুর দেবতা জ্ঞানে পূজিত হন। এই লাল মাটির জঙ্গলে বসবাস অসুর সম্প্রদায়ের। এই সব গ্রামগুলিতে বসবাস অনিল অসুর, ললিত অসুর, সুষমা অসুরদের বাস। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে অনেকের ঘরেই আলো জ্বলে না, গায়ে নতুন কাপড় ওঠে না। তাঁদের পূর্বপুরুষ মহিষ রাজাকে দুর্গা নামে বহিরাগত এক সুন্দরী রমণী ছলাকলায় ভুলিয়ে হত্যা করেছিল। শারদীয়া উৎসবের দিনগুলি তাই তাঁদের কাছে অশৌচ পালনের দিন।
ঠিক কী ছিলেন এই মহিষ রাজা? স্বর্গ-মর্ত তছনছ করে দেওয়া এক ভয়ংকর অসুর, যাঁর হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু সব দেবতাকে নিজের শক্তি দিয়ে ডাকতে হল মহামায়াকে? না কি প্রজাপালক এক নৃপতি, যাঁকে নারীর মোহিনী মায়ায় বশ হয়ে শেষ অবধি মৃত্যু বরণ করতে হল? অসুরই বা কারা? দেবতাদের স্বর্গরাজ্য বা মুনিঋষিদের তপোবনে সন্ত্রাসের হানা দেয় যারা?
কিন্তু ঋগ্বেদ তো উলটো কথাই বলছে। মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্র সব বৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সবিতৃ বা সূর্যদেবও সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।ঋগ্বেদই জানিয়ে দিল, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়। শক্তিমান এক পুরুষ।
এই ক্ষমতাশালী অসুর-পুরুষ আসলে বিশ্বস্রষ্টা। পার্সি ধর্মের জেন্দ আবেস্তার একমাত্র ঈশ্বর: আহুর মজদা। ম্যাক্সমুলার থেকে মনিয়ের উইলিয়াম্স, অনেকেই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, আহুর এবং বৈদিক সংস্কৃতির অসুর অনেকটা এক। খ্রিস্টের জন্মের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ইরাকের কাছে যে আসিরীয় সভ্যতা ছিল, সেখানেও ছিলেন এই আহুর মজদা। আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের এক শিলালিপিতে কিউনিফর্ম সংকেতে রয়েছে আসুর মজদার উল্লেখ।
শিলালিপিটা এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে আসুরবানিপাল আসিরিয়ার রাজা হয়েছিলেন। শিলাপটে তাঁর সিংহ শিকারের কিছু ছবিও রয়েছে। মহিষ রাজার খোঁজে এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বে সিংহশিকারী এক নৃপতিকে পাওয়া গেল। ভাষাতত্ত্বের খেলায় প্রাচীন আসিরিয়া, অসুর এবং আহুর একদেহে হল লীন।
অসুরেরাও দেবতা। প্রমাণ: রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। সেখানে দেবতা ও অসুর দুপক্ষই প্রজাপতির পুত্র, বৈমাত্রেয় ভাই। ইন্দ্রের শ্বশুরমশাই পুলোমা এক অসুর। ভক্ত প্রহ্লাদও হিরণ্যকশিপু নামে এক অসুরের পুত্র। কশ্যপ ঋষির ছেলে ময় দানব হয়েও দেবতাদের অলকাপুরী নির্মাণ করে। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদও বানায়। তার বউ এক অপ্সরা, নাম হেমা। দেবাসুরের সংগ্রাম তাই শুধুই যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীসংঘর্ষের কাহিনি নয়। সকলেই আত্মীয়, তাদের মধ্যে বিয়ে-থাও হয়।
মহিষ রাজার খোঁজে বেরিয়ে সেই শক্তিমান অসুর পুরুষকে পাওয়া যায় মহীশূরের চামুণ্ডি পাহাড়ে। মহিষাসুর আর তাঁর দুই সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে এই পাহাড়েই বধ করেছিলেন দুর্গা। মহিষাসুর থেকেই কালে কালে অপভ্রংশে মহীশূর নাম। চামুণ্ডি মন্দিরের প্রবেশচত্বরেই বিশাল মূর্তি। গোঁফ ও গালপাট্টাসহ রাজার মতো দাঁড়িয়ে, এক হাতে খড়্গ, আর এক হাতে সাপ। মহিষাসুর মানেই সিংহের আক্রমণে ত্রস্ত, দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ কোনও মহিষরূপী দানব নয়।
খুঁজতে খুঁজতে মহিষ রাজার বর্তমান উত্তরাধিকারীদের পাওয়া যাবে এই পশ্চিমবাংলায়ও। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের ক্যারন চা বাগানে। বাগানের শেষ প্রান্তের কারি লাইনে রয়েছে ৪৫টি অসুর পরিবার। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা খুড়ো অসুর জানালেন, ‘দুর্গাপুজোয় আমরা যোগ দিই না, কারণ সেখানে মহিষাসুরকে হত্যা করা হয়েছিল। সে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিল।
এই অসুরেরা সকলেই ঝুপড়িতে থাকেন। মহিলারা বাগানে চা-পাতা তোলেন, পুরুষেরা বেশির ভাগ সময় দিনমজুরের কাজে ভুটান চলে যান। সেখানে দৈনিক আড়াইশো টাকা মজুরি। কেউ আবার ভুটান থেকে আসা বস্তায় বাঁধা কাঁচা সুপারি গাড়িতে তোলার কাজ করেন। মেটেলি আর মালবাজারের চা-বাগানে আরও কয়েক ঘর অসুর আছেন। সেখানেই ওঁরা নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক পাতান।
কিন্তু ধর্ম? ১৮৮০ সালে ক্যারন চা-বাগানের পত্তন। সেই সময় রাঁচি ও ছোটনাগপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুলির কাজে নিয়ে আসা হয় ওঁদের। আগে জঙ্গলে শিকারও করতেন, নিজেদের হিন্দু এবং শিবের উপাসক বলে পরিচয় দিতেন। মহিষাসুরের উত্তরাধিকারী আদিবাসী অসুর এবং শিবপুজো করা কিরাতদের একাকার হওয়াতেই ভারতীয় ঐতিহ্য।
চা বাগানের ১০১টি অসুর-ঘরের মধ্যে ৯০টিই আজ খ্রিস্টান। ৮০ বছরের বর্গী অসুরের ছেলে ও নাতিরা যেমন! আমি নতুন জীবনে গিয়ে হয়তো মানাতে পারব না। ছেলেপুলেরা বাগানে পাতা তোলে, আমিও আজীবন ওই কাজটাই করেছি। নতুন ধর্ম যদি ওদের একটু ভাল রাখে!
চা বাগানের শেড ট্রিতে বসে বর্গী বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় দুর্গাপুজোটা খুব খারাপ লাগত। চার দিকে হইচই, কিন্তু মা আমাদের ঘরের বাইরে বেরোতে দিত না। বলত, বেরোলেই অলুক্ষুণে কিছু ঘটবে। পরে দেখলাম, বন্ধুবান্ধবরাও আমার পদবি নিয়ে ঠাট্টা করে। এখন আমরা আর কিছু লুকোই না। বছরে দুবার, ফাল্গুন মাসে আর দশেরায় আমরা অসুরবাবার পুজো করি।বর্গীর পাশের বাড়ির তরুণী ললিতা অসুর শুনতে শুনতে পালটা ঝাঁজি মেরে উঠল, ‘আ মোলো! আমি মহিষাসুরের বংশধর হতে যাব কেন? আমাদের এখানে তো অনেকে টোপো, কাজুর এ সব পদবিও নিয়েছে গো!
মহল্লার একমাত্র অনসুর বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জগন্নাথ মাহাতো। সবাই ডাকে মাস্টারজি বলে। তাঁর আক্ষেপ, ‘ওরা আজকাল অনেক বদলে গিয়েছে। আগে শিকার করে অনেক মাংসই খেত, এখন রান্নার ধরনধারনও তেল-হলুদ-সর্ষেবাটা দিয়ে আমাদের মতোই।
শুধুই রন্ধন এবং ধর্মসংস্কৃতি নয়। একশো-দেড়শো বছর ধরে বিভিন্ন চা-বাগান ও খাদানের কুলি লাইনে হতদরিদ্র অভিবাসী হতে হতে অসুরেরা হারিয়েছেন নিজস্ব ভাষা। ১৮৭২ সালের জনগণনায় ১৮টি জনজাতির কথা বলা হয়। সবচেয়ে বেশি লোক ছিলেন অসুরদের মধ্যে। ১৭৪ বছর পর সেই অসুরেরা আজ ঝাড়খণ্ডের এক আদিম জনজাতি প্রিমিটিভ ট্রাইব। তাঁদের বেশির ভাগ সময় মুণ্ডাদের মধ্যে গণনা করা হয়েছে, আসুরি ভাষাকে মুণ্ডারি উপভাষার মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তিন বছর আগেও গণেশ দাভি-র পিপ্‌লস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়াহুঁশিয়ারি দিয়েছিল, আসুরি সহ ভারতের প্রায় দেড়শোটি ভাষা ধ্বংসের মুখে। মহিষ রাজাকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ট্র্যাজেডি ক্রমে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। অবহেলায় কী ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই দেশের আদি বাসিন্দা আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা, গান, উপকথার মৌখিক সংস্কৃতি।
পশ্চিমবঙ্গও এ ব্যাপারে সমান দায়ী। ২০১৫ সালে পুরুলিয়ায় যখন চরণ মাহাতো, সুষেণজিৎ বৈরাগীরা মহিষাসুর দিবসপালন করছিলেন, পুজো মণ্ডপে এসে স্থানীয় পুলিশ অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলে। সুষেণের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, ‘প্রিয়জন মারা গেলে আজকাল পুলিশের থেকে অশৌচেরও অনুমতি নিতে হয়?’ পুলিশ কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। সিধু-কানুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় করলেই হয় না, আদিবাসীদের বিপন্ন সংস্কৃতির কথাও বুঝতে হয়।
সেই সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছিলেন রাঁচির সমাজকর্মী, ‘ঝাড়খণ্ডী ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি আখড়ার বন্দনা টেটে, ‘শুধু অসুর নয়, সাঁওতাল এবং পোকরুদের উপকথাতেও মহিষ রাজা এবং দুর্গা তাকে কী ভাবে মোহিনী রূপে ভুলিয়ে ভালিয়ে বধ করলেন, সেই গল্প পাবেন।এই আখড়া বা পরিষদের তরুণী সুষমা অসুরই আসুরি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত কবি। দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ল্যাংগোয়েজ ফেস্টিভ্যালে তাঁর কবিতার বই অসুর সিরিংনিয়ে গিয়েছিলেন: খেতো মে যব হুল চলাওগে/ তব ধান বোয়েগে/ নহি তো ঘাস আ জায়েগা।রাঁচি, নেতারহাটের মালভূমিতে রোজকার হতদরিদ্র জীবন নিয়ে একটি মেয়ের কবিতা। সুষমারা সম্প্রতি ফেসবুকে অসুর আদিবাসী ডকুমেন্টেশন ইনিশিয়েটিভনামে একটি ওয়েব পেজও খুলেছেন। মহিষ রাজার উত্তর প্রজন্মে ক্লাস টুয়েল্ভ পাশ এক মেয়ে কবিতা লিখে, সংগঠন তৈরি করে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। একুশ শতকের দশভুজা।
সুষমা নিজে শাখুয়াপানি গ্রামের মেয়ে, বলছিলেন, দুর্গাপুজো বা নবরাত্রিতে তাঁরা যে অশৌচ পালন করেন, তাকে মহিষাসুর দশা বলে। দীপাবলিকে তাঁরা বলেন সোহরাই (বা সহরায়), ওই সময় নাভিতে, বুকে ও নাকে করঞ্জী ফুলের তেল লাগান। ওই তিন জায়গাতেই আমাদের পূর্বপুরুষ ত্রিশূলবিদ্ধ হয়েছিলেন, রক্ত ঝরেছিল।মাংস বা হাঁড়িয়ার পাশাপাশি সুষমারা ওই সময়ে শশাও খান। শশা নাকি মহিষ রাজাকে খুন করা সেই ছলনাময়ীর হৃদয়ের প্রতীক। গ্রামের লোকেরা গরুর দুধ খায় না, ‘আমরা চাই বাছুরেরা বরং মায়ের দুধ খেয়ে তাগড়াই হয়ে উঠুক, যাতে তাদের জোতের কাজে লাগানো যায়।
জোত আর কোথায়? গ্রামের বেশির ভাগ লোক এখন বক্সাইটের খাদানে কাজ করেন। এ গ্রামে একটাই প্রাথমিক বিদ্যালয়। নেই কোনও হাসপাতাল। বছর কয়েক আগে সুষমার বাবা অসুস্থ হলে তাঁকে দুঘণ্টা দূরে লোহারদাগা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার নেই। আরও দুই ঘণ্টা দূরে গুমলায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই মৃত্যু। অসুরনিধনের গল্প ফুরোয়নি।
গুমলার গুরুত্ব শুধু বড় হাসপাতালে নয়। ঝোবিপাট গ্রামের ললিত অসুর, সুখনা অসুরেরা বলছিলেন তাঁদের আসুরি উপকথা। সেখানে মহিষাসুর এলাকার রাজা। দেবতাদের সঙ্গে তার বিশেষ বনে না। দেবতারা তাদের বন্ধু দুর্গার শরণাপন্ন হয়। তারা জানত, রূপযৌবন আর ছলাকলায় দুর্গা সবাইকে ভোলাতে পারে। ফলে মহিষ রাজাকে ফাঁদে ফেলা যাক! এক দিন রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে জঙ্গলে চলেছিল লোহা গলানোর কাজে। সুন্দরী দুর্গা হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। কাজ ফেলে মহিষাসুর তার সঙ্গে চলে যায়।
অতঃপর ভেসে যায় আদরের নৌকো। সুন্দরী দুর্গা প্রেমিককে কখনও নিয়ে যায় নদীর ধারে, কখনও বা হাঁড়িয়ার ভাটিখানায়। মহিষাসুরকে তার অস্ত্রগুলিও মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য করে সে। তার পর এক দিন নিরস্ত্র প্রেমিককে মেরে ফেলে। গুমলার টাঙিনাথ পাহাড়ের মাটিতে এখনও বড় বড় অনেক অস্ত্র পোঁতা রয়েছে। অনেক বার মাটি খুঁড়ে ঢাউস তলোয়ার, ত্রিশূল মিলেছে। অসুরবাবাকে ওখানেই মেরে ফেলেছিল’, জানালেন অনিল অসুর।
লোহা গলিয়ে মহিষাসুরের অস্ত্র! প্রত্নতাত্ত্বিকদের একাংশ আজও বলেন, অসুর উপজাতি সাবেক মগধ, পাটলিপুত্রে লোহা গলানোর কাজ করত। সেই বিদ্যায় তারা যে কত দূর এগিয়েছিল, অশোকস্তম্ভগুলিই নাকি তার প্রমাণ। সেই সব লোহায় আজও মরচে পড়েনি। সেই প্রযুক্তিবিদ্যার স্বীকৃতি আজও মিলল না, শুধু জনজাতির ওরাল ট্র্যাডিশনেই রয়ে গেল!
এক এক জনজাতির এক এক উপকথা, ঐতিহ্য। কিন্তু সাঁওতাল, মুণ্ডা, অসুর প্রতিটি আদিবাসী জনজাতিতেই রয়েছে জনপ্রিয় মহিষ রাজা ও ছলনাময়ী এক নারীর উপাখ্যান। মহিষ রাজার মাথায় মোটেই শিং ছিল না, তিনি লোহা গলাতেন, প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। নবরাত্রির সময় আজও সাঁওতালরা তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া রাজাকে খুঁজে বেড়ায়। যখন পায় না, একটা খড়, মাটির কাঠামো ভেঙে দেয়। সাঁওতালি উৎসবের এই হারিয়ে-যাওয়া রাজা বা হুদুর দুর্গা’-তে আজও মহিষরাজার স্মৃতি অম্লান। মুণ্ডারি উপকথায় আছে, জঙ্গলে এক বুনো মোষ খুঁজে পেল ছোট্ট এক মেয়েকে। তাকে যত্নে বড় করে তুলল সে, মেয়েটি ক্রমে পরমাসুন্দরী যুবতী হয়ে উঠল। রাজা তাকে তুলে নিয়ে যেতে লোক পাঠাল, মোষ তাদের গুঁতিয়ে ছারখার করে দিল। অতঃপর রাজার লোকে মোষকে ঘরে আটকে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল। মোষ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মারা গেল। রাজা মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে গেল। মহিষাসুর বধের বিকল্প আখ্যান?
সবাই জানে, অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে, দেবতারাই জয়ী হয়েছিলেন। দেবীর সেই যুদ্ধজয়ের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনা। দেবী সুরাপান করে আরক্তনয়না। হেসে অস্পষ্ট বাক্যে অসুরকে বলছেন, ‘আমি পান করি, তুই গর্জন কর।দুর্গা শুধুই সংহারমূর্তি ধারণ করেননি। মদ্যপান, আরক্তলোচন, অস্পষ্ট স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কথার মোহিনী মূর্তিও ছিল।
সেই মোহিনী এক লাফে মহিষাসুরের উপরে চড়ে বসেছিলেন। তার গলায় পা দিয়ে বুকে বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন শূল। শুম্ভ-নিশুম্ভ, রক্তবীজ, ধূম্রলোচন কোনও অসুরকে মারার সময়েই এ ভাবে সুরাপানে দেবীর কথা জড়িয়ে যায়নি। লাফ মেরে কারও শরীরে চড়ে বসেননি।
আদিবাসী জনজাতির উপকথায় এই মদ্যপানই হয়ে যেতে পারে হাঁড়িয়া খাওয়া। অসুরের শরীরে চড়ে বসা হয়ে উঠতে পারে প্রেম ও প্যাশনের আততি-ভরা রোমাঞ্চকর এক খুনের মুহূর্ত।
কিন্তু আদিবাসী জনজাতির ইতিহাস, পুরাণ রচনা করে না। তারা পরাজিত। যারা বিজয়ী, তারাই ইতিহাস লেখে। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, সবই বিজয়ীদের ব্যাখ্যা। আসিরিয়ার আসুরবানিপাল কেমন দেখতে ছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা শিলাপটে আজও তা দেখা যায়। কিন্তু এ দেশে বিজয়ীরা মহিষ রাজার স্মৃতিটুকুও রাখেনি। এক সাঁওতাল শিল্পীর আঁকা ছবিতে দেখেছিলাম, লাঠি হাতে পাগড়ি মাথায় এক রাজা। কাছে দুটো মোষ চড়ে বেড়াচ্ছে। বিজয়ীর জনসংস্কৃতি এই সব ছবির খবর রাখে না। কুমোরটুলিতে গড়া, ত্রিশূলবিদ্ধ পরাজিত ও রক্তাক্ত পুরুষই তাদের কাছে একমাত্র মহিষাসুর।
শাখুয়াপানি গ্রামে চমরু অসুর বলেন, এত হইচই কেনে বলেন তো। সবাই জানে, আমরা আলাদা। আগে জমিদার দুগ্গাপুজোর সময় আমাদের জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, পাতা এনে দিতে বলত। আমরা সে সব দিয়ে, পুজো শুরুর আগেই চলে আসতাম। পূর্বপুরুষদের কাছে বলতাম, তাঁরা যেন বিপদ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন।ঝোবিপাটের অনিল অসুর বলছিলেন, তাঁর মা এক সপ্তমীর সন্ধ্যায় দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাচ্ছিলেন। চার দিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ, অনিলের মায়ের পরনে নতুন শাড়ি। তখনই অনিলের বাবা বলেছিলেন, ‘কোথায় যাও? যে আমাদের পূর্বপুরুষকে মেরে ফেলেছিল, তার পুজো দেখতে?’ অনিলের মা আর যাননি। ছেড়ে ফেলেছিলেন নতুন শাড়ি, বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঘরের দরজা-জানলাও।
অনিলরা অবশ্য এখন দুর্গাপুজোর সময় নিঃশব্দে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেন না। ইন্টারভিউ দেন, সগর্বে জানান তাঁদের রীতিনীতি ও সংস্কারের কথা। হাজার বছর পরে পরাজিতরাও প্রত্যাঘাত করে। জানিয়ে দেয়, বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যবাদই সব নয়। কে বলতে পারে, কুমোরটুলি এক দিন ভিলেন মহিষাসুরের বদলে, মহিষ রাজাকে বেছে নেবে কি না? (মুল লেখাটি সামান্য সম্পাদনা করা হয়েছে।)
সৌজন্য – আনন্দবাজার পত্রিকা, অমিত পরামানিক, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ও গৌতম চক্রবর্তী, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬।